নতুন সামাজিক ব্যবস্থা রচনায় অর্থনৈতিক চিন্তার পুনর্বিন্যাস by মুহাম্মদ ইউনূস
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি নৈতিক, সামাজিক এবং বস্তুগত ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে কাক্সিক্ষত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ যে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে তার মাধ্যমে এই ভারসাম্য কিছুতেই সম্ভব হবে না। বরং এর মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো আরও প্রকট হয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল এবং অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে এটা আসলে নৈর্ব্যক্তিক একটা শোষণ যন্ত্র। এর কাজ হল নিচ থেকে রস শুষে অনবরত উপরের দিকে পাঠাতে থাকা। বহু স্তরে বিন্যস্ত এই যন্ত্র ধাপে ধাপে নিচের স্তরের রস তার উপরের স্তরে পাঠায়। এর সর্বনিু স্তরটি সবচেয়ে বিশাল। সেখানে অসংখ্য কর্মী নিরলসভাবে বিন্দু বিন্দু করে রস তৈরি করে। তার উপরের স্তরটিতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানুষ, কিন্তু যন্ত্রে তাদের অবস্থানের কারণে শক্তিতে তারা অনেক বলবান। তাই তারা নিচের সংগ্রহ করা রস অনায়াসে নিজের কাছে টেনে নেয়। উপরে যারা আছে তারা খারাপ মানুষ হওয়ার কারণ এটা হচ্ছে তা নয়। যন্ত্রের কারণেই মূলত এটা হচ্ছে। যন্ত্রটাই এভাবে বানানো হয়েছে। স্তরে স্তরে সাজানো মানুষগুলো নিচের স্তরের রস উপরে টেনে নিয়ে নিচ্ছে তাদের শক্তির কারণে। এতে কেউ দোষের কিছু দেখে না। বরং ধরে নেয় যে এটাই জগতের নিয়ম। অথচ বিষয়টা জগতের নিয়ম না। কিছু পণ্ডিত বসে এ রকম একটা শাস্ত্র তৈরি করে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে যে, এটাই জগতের নিয়ম; এ নিয়ম মেনে চললে সবার জন্য মঙ্গল।
প্রত্যেক স্তরে মানুষের সংখ্যা তার ইমিডিয়েট পরের স্তরের মানুষের সংখ্যা থেকে অনেক কম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আয়ত্তে রসের পরিমাণ হতে থাকবে নিচের স্তরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মাত্র। কিন্তু তাদের আয়ত্তে এত রস সংগৃহীত থাকবে যে, নিচের দিকের অর্ধেক স্তরে জমানো সব রস একত্র করলেও সমপরিমাণ হবে না। এর জন্য কাউকে আমরা দোষী বলতে পারছি না, কারণ শাস্ত্রে বলে দেয়া আছে এমনটিই হওয়ার কথা। এতেই সবার মঙ্গল। বলাবাহুল্য, কোনো নৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ যন্ত্র তৈরি হয়নি। এ যন্ত্র মূলত তৈরি হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সব সময় সচল রাখার জন্য। সব সময় চোখ রাখা হয়েছে কখনও যেন অর্থনীতির চাকা কোনো চোরাবালিতে আটকে না যায়। শাস্ত্রে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের নানা অবতারণা থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। বাস্তবে তার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে পরিণত হয়েছে। সমাজ নিয়ে যারা চিন্তা করে তারা মাঝে মাঝে এটা স্মরণ করিয়ে দিলে এটা নিয়ে কিছু উদ্যোগ আয়োজনের কথা বলাবলি হয়, কিন্তু দ্রুত সবাই এসব কথা ভুলে যায়। যেহেতু যন্ত্রের গাঁথুনিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কাজেই এসব কখনও যন্ত্রের কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
যেমন ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। বর্তমান জগতের ব্যবসার সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণে শেয়ারবাজারের মূল্যায়নই চূড়ান্ত। কারা ব্যবসা ভালো করছে, কারা ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারছে, সব বিষয়ে রায় দিচ্ছে শেয়ারবাজার। এ মূল্যায়নে কোথাও কোনো নৈতিক কিংবা সামাজিক বিচারের মাপকাঠি ব্যবহৃত হয় না। কাজেই ব্যবসার প্রধান নির্বাহীর দৃষ্টিতে এসব বিষয় পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক এবং বাড়তি ঝামেলা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার এগিয়ে আসে নিচের মানুষকে কিছু স্বস্তি দেয়ার জন্য। সরকার উপরের স্তর থেকে রস সংগ্রহ করে নিচের স্তরে বিলি করে তাদের করুণ অবস্থা থেকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যন্ত্রের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
এ যন্ত্রকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছি বলে যন্ত্রটা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমাদের করেছে সেটা হল, আমরা সবাই আমাদের অজান্তে অর্থলোভী কলের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছি।
জীবনে অর্থ জমিয়ে নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরে যাওয়ার সাধনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে আর মনে থাকে না। আমরা এটা জেনেই চমৎকৃত যে, যে যত উপরের স্তরে যেতে পারবে, যন্ত্রের গঠনের কারণে সে তত অল্প আয়াসে, অনেক বেশি রস সংগ্রহ করার ক্ষমতা অর্জন
করবে। এমনকি সে বসে থাকলেও যন্ত্র তাকে ক্রমাগত রস জুগিয়ে দিতে থাকবে।
সামাজিক ব্যবসা বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেটি মৌলিক গলদ বলে আমি মনে করি সেটি হল, এমন একটি কাল্পনিক মানুষকে কেন্দ্র করে সমস্ত শাস্ত্রটিকে সাজানো হয়েছে যার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। শাস্ত্রবিদরা হয়তো নির্দোষ সরলীকরণ করেছেন। কিন্তু সেটা শাস্ত্রকে এবং এই শাস্ত্র অনুসরণকারী পুরো বিশ্বকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শাস্ত্রবিদরা ধরে নিয়েছেন অর্থনৈতিক জগতে যে মানুষ বিচরণ করে, সে হল শতভাগ স্বার্থপর জীব। স্বার্থপরতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আমি মনে করি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি আমরা করেছি তার মূলে রয়েছে মানুষের এই খণ্ডিত রূপকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা।
অর্থনৈতিক শাস্ত্রে স্বার্থপর মানুষের জায়গায় আমি এমন একটি মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে চাচ্ছি, যিনি একই সঙ্গে স্বার্থপর এবং স্বার্থহীন। কারণ প্রকৃত মানুষ এই দুয়ের সংমিশ্রণ। কে কত স্বার্থপরভাবে এবং কত স্বার্থহীনভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ওপর, তার সমাজ সচেতনতার ওপর, তার শিক্ষার ওপর, তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার ওপর। একই মানুষ স্থায়ীভাবে, কিংবা সাময়িকভাবে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে প্রচণ্ড স্বার্থপর হতে পারে, অথবা দিলদরিয়া স্বার্থহীন হতে পারে, অথবা একইসঙ্গে দুয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা করতে হলে আমাদের দুধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যখন মানুষ তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রয়োগ করতে চায় তখন সে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যখন স্বার্থহীন হতে চায়, তখন সে এমন ব্যবসা করবে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করার কোনো ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করবে না; তার একমাত্র লক্ষ্য হবে ব্যবসায়িক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজের সমস্যার সমাধান করা। আমি এ ব্যবসার নাম দিয়েছি সামাজিক ব্যবসা। এ ধরনের ব্যবসা থেকে মালিক তার বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত নেয়া ছাড়া আর কোনো অর্থ মুনাফা হিসেবে নিতে পারবে না। এ ধরনের এই নতুন মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক শাস্ত্র রচনা করলে সে শাস্ত্রে দুধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতেই হবে। একটা হবে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা, আরেকটি হবে সামাজিক ব্যবসা। তার ফলে সব পরিস্থিতিতে সব মানুষের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। এ বিকল্প না থাকার কারণেই আমরা অর্থনৈতিকক্ষেত্রে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছি এবং প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রচলিত অর্থনৈতিক শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোনো ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। স্বার্থহীনভাবে কিছু করতে চাইলে দান খয়রাতের জগতে প্রবেশ করতে হয়। দাতব্য কর্মকাণ্ডে সমাজের অবহেলিত মানুষের অনেক উপকার হয়। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড বরাবর পরমুখাপেক্ষী থেকে যায়। আত্মনির্ভর হওয়ার কোনো সুযোগ এদের থাকে না। কারণ সব সময় নতুন নতুন অর্থ সংগ্রহ করে দাতব্য কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। একবার কাজে লাগালে দানের টাকা খরচ হয়ে যায়। দানের টাকা ফেরত আসে না। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা, সে কারণে টাকাটা ফিরে আসে। একই টাকাকে বারবার ব্যবহার করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। এগুলোকে বলা হয় বিজনেস স্কুল। এই শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ ব্যবসা-যোদ্ধারা বের হয়ে আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন বাজার জয় করার জন্য আর কোম্পানির মালিকদের জন্য বেশি মুনাফা অর্জনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিজনেস স্কুলে পৃথক বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এ শিক্ষা নিয়ে তরুণরা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের লড়াইয়ে নামবে। দুই ব্যবসার দুই রকমের দক্ষতার প্রয়োজন। এক ক্ষেত্রে লাগবে মালিকদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সব কলাকৌশল আয়ত্ত করা, অন্যক্ষেত্রে লাগবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ যে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে তার মাধ্যমে এই ভারসাম্য কিছুতেই সম্ভব হবে না। বরং এর মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো আরও প্রকট হয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল এবং অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে এটা আসলে নৈর্ব্যক্তিক একটা শোষণ যন্ত্র। এর কাজ হল নিচ থেকে রস শুষে অনবরত উপরের দিকে পাঠাতে থাকা। বহু স্তরে বিন্যস্ত এই যন্ত্র ধাপে ধাপে নিচের স্তরের রস তার উপরের স্তরে পাঠায়। এর সর্বনিু স্তরটি সবচেয়ে বিশাল। সেখানে অসংখ্য কর্মী নিরলসভাবে বিন্দু বিন্দু করে রস তৈরি করে। তার উপরের স্তরটিতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানুষ, কিন্তু যন্ত্রে তাদের অবস্থানের কারণে শক্তিতে তারা অনেক বলবান। তাই তারা নিচের সংগ্রহ করা রস অনায়াসে নিজের কাছে টেনে নেয়। উপরে যারা আছে তারা খারাপ মানুষ হওয়ার কারণ এটা হচ্ছে তা নয়। যন্ত্রের কারণেই মূলত এটা হচ্ছে। যন্ত্রটাই এভাবে বানানো হয়েছে। স্তরে স্তরে সাজানো মানুষগুলো নিচের স্তরের রস উপরে টেনে নিয়ে নিচ্ছে তাদের শক্তির কারণে। এতে কেউ দোষের কিছু দেখে না। বরং ধরে নেয় যে এটাই জগতের নিয়ম। অথচ বিষয়টা জগতের নিয়ম না। কিছু পণ্ডিত বসে এ রকম একটা শাস্ত্র তৈরি করে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে যে, এটাই জগতের নিয়ম; এ নিয়ম মেনে চললে সবার জন্য মঙ্গল।
প্রত্যেক স্তরে মানুষের সংখ্যা তার ইমিডিয়েট পরের স্তরের মানুষের সংখ্যা থেকে অনেক কম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আয়ত্তে রসের পরিমাণ হতে থাকবে নিচের স্তরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মাত্র। কিন্তু তাদের আয়ত্তে এত রস সংগৃহীত থাকবে যে, নিচের দিকের অর্ধেক স্তরে জমানো সব রস একত্র করলেও সমপরিমাণ হবে না। এর জন্য কাউকে আমরা দোষী বলতে পারছি না, কারণ শাস্ত্রে বলে দেয়া আছে এমনটিই হওয়ার কথা। এতেই সবার মঙ্গল। বলাবাহুল্য, কোনো নৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ যন্ত্র তৈরি হয়নি। এ যন্ত্র মূলত তৈরি হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সব সময় সচল রাখার জন্য। সব সময় চোখ রাখা হয়েছে কখনও যেন অর্থনীতির চাকা কোনো চোরাবালিতে আটকে না যায়। শাস্ত্রে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের নানা অবতারণা থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। বাস্তবে তার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে পরিণত হয়েছে। সমাজ নিয়ে যারা চিন্তা করে তারা মাঝে মাঝে এটা স্মরণ করিয়ে দিলে এটা নিয়ে কিছু উদ্যোগ আয়োজনের কথা বলাবলি হয়, কিন্তু দ্রুত সবাই এসব কথা ভুলে যায়। যেহেতু যন্ত্রের গাঁথুনিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কাজেই এসব কখনও যন্ত্রের কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
যেমন ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। বর্তমান জগতের ব্যবসার সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণে শেয়ারবাজারের মূল্যায়নই চূড়ান্ত। কারা ব্যবসা ভালো করছে, কারা ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারছে, সব বিষয়ে রায় দিচ্ছে শেয়ারবাজার। এ মূল্যায়নে কোথাও কোনো নৈতিক কিংবা সামাজিক বিচারের মাপকাঠি ব্যবহৃত হয় না। কাজেই ব্যবসার প্রধান নির্বাহীর দৃষ্টিতে এসব বিষয় পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক এবং বাড়তি ঝামেলা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার এগিয়ে আসে নিচের মানুষকে কিছু স্বস্তি দেয়ার জন্য। সরকার উপরের স্তর থেকে রস সংগ্রহ করে নিচের স্তরে বিলি করে তাদের করুণ অবস্থা থেকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যন্ত্রের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
এ যন্ত্রকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছি বলে যন্ত্রটা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমাদের করেছে সেটা হল, আমরা সবাই আমাদের অজান্তে অর্থলোভী কলের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছি।
জীবনে অর্থ জমিয়ে নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরে যাওয়ার সাধনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে আর মনে থাকে না। আমরা এটা জেনেই চমৎকৃত যে, যে যত উপরের স্তরে যেতে পারবে, যন্ত্রের গঠনের কারণে সে তত অল্প আয়াসে, অনেক বেশি রস সংগ্রহ করার ক্ষমতা অর্জন
করবে। এমনকি সে বসে থাকলেও যন্ত্র তাকে ক্রমাগত রস জুগিয়ে দিতে থাকবে।
সামাজিক ব্যবসা বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেটি মৌলিক গলদ বলে আমি মনে করি সেটি হল, এমন একটি কাল্পনিক মানুষকে কেন্দ্র করে সমস্ত শাস্ত্রটিকে সাজানো হয়েছে যার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। শাস্ত্রবিদরা হয়তো নির্দোষ সরলীকরণ করেছেন। কিন্তু সেটা শাস্ত্রকে এবং এই শাস্ত্র অনুসরণকারী পুরো বিশ্বকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শাস্ত্রবিদরা ধরে নিয়েছেন অর্থনৈতিক জগতে যে মানুষ বিচরণ করে, সে হল শতভাগ স্বার্থপর জীব। স্বার্থপরতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আমি মনে করি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি আমরা করেছি তার মূলে রয়েছে মানুষের এই খণ্ডিত রূপকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা।
অর্থনৈতিক শাস্ত্রে স্বার্থপর মানুষের জায়গায় আমি এমন একটি মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে চাচ্ছি, যিনি একই সঙ্গে স্বার্থপর এবং স্বার্থহীন। কারণ প্রকৃত মানুষ এই দুয়ের সংমিশ্রণ। কে কত স্বার্থপরভাবে এবং কত স্বার্থহীনভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ওপর, তার সমাজ সচেতনতার ওপর, তার শিক্ষার ওপর, তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার ওপর। একই মানুষ স্থায়ীভাবে, কিংবা সাময়িকভাবে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে প্রচণ্ড স্বার্থপর হতে পারে, অথবা দিলদরিয়া স্বার্থহীন হতে পারে, অথবা একইসঙ্গে দুয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা করতে হলে আমাদের দুধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যখন মানুষ তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রয়োগ করতে চায় তখন সে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যখন স্বার্থহীন হতে চায়, তখন সে এমন ব্যবসা করবে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করার কোনো ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করবে না; তার একমাত্র লক্ষ্য হবে ব্যবসায়িক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজের সমস্যার সমাধান করা। আমি এ ব্যবসার নাম দিয়েছি সামাজিক ব্যবসা। এ ধরনের ব্যবসা থেকে মালিক তার বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত নেয়া ছাড়া আর কোনো অর্থ মুনাফা হিসেবে নিতে পারবে না। এ ধরনের এই নতুন মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক শাস্ত্র রচনা করলে সে শাস্ত্রে দুধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতেই হবে। একটা হবে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা, আরেকটি হবে সামাজিক ব্যবসা। তার ফলে সব পরিস্থিতিতে সব মানুষের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। এ বিকল্প না থাকার কারণেই আমরা অর্থনৈতিকক্ষেত্রে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছি এবং প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রচলিত অর্থনৈতিক শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোনো ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। স্বার্থহীনভাবে কিছু করতে চাইলে দান খয়রাতের জগতে প্রবেশ করতে হয়। দাতব্য কর্মকাণ্ডে সমাজের অবহেলিত মানুষের অনেক উপকার হয়। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড বরাবর পরমুখাপেক্ষী থেকে যায়। আত্মনির্ভর হওয়ার কোনো সুযোগ এদের থাকে না। কারণ সব সময় নতুন নতুন অর্থ সংগ্রহ করে দাতব্য কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। একবার কাজে লাগালে দানের টাকা খরচ হয়ে যায়। দানের টাকা ফেরত আসে না। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা, সে কারণে টাকাটা ফিরে আসে। একই টাকাকে বারবার ব্যবহার করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। এগুলোকে বলা হয় বিজনেস স্কুল। এই শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ ব্যবসা-যোদ্ধারা বের হয়ে আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন বাজার জয় করার জন্য আর কোম্পানির মালিকদের জন্য বেশি মুনাফা অর্জনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিজনেস স্কুলে পৃথক বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এ শিক্ষা নিয়ে তরুণরা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের লড়াইয়ে নামবে। দুই ব্যবসার দুই রকমের দক্ষতার প্রয়োজন। এক ক্ষেত্রে লাগবে মালিকদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সব কলাকৌশল আয়ত্ত করা, অন্যক্ষেত্রে লাগবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা।
আয়-বৈষম্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী কাঠামোতে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত আছে। তার ওপর যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে উঠেছে তা এই আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি আরও জোরদার করে দিয়েছে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা- সবকিছুর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ভাগ্যবানদের পক্ষে। ভাগ্যহীনদের জন্য সব দরজা বন্ধ। তাদের পক্ষে এসব দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব। কাজেই মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলবে। যে যন্ত্র ক্রমাগতভাবে নিচ থেকে রস সংগ্রহ করে উপরে চালান দেয়ার কাজে নিয়োজিত, সে যন্ত্র কখনও উপর-নিচের আয়ের ব্যবধান ঘোচাতে পারবে না। আয়-বৈষম্য আমাদের এখন কোথায় নিয়ে এসেছে সেটা দেখলেই পরিস্থিতি বোঝা যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আয়ের দিক থেকে নিচে আছে পৃথিবীর এমন অর্ধেক মানুষ, অর্থাৎ ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের যোগফলের চেয়ে বেশি। অন্যভাবে তাকালেও একই দৃশ্য দেখা যাবে। আয়ের দিক থেকে উপরে আছে পৃথিবীতে এমন অর্ধেক মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র এক শতাংশ। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কি এ অবস্থার উন্নতি হবে? না, হবে না। কারণ অর্থনৈতিক যন্ত্রটিকে কাজ দেয়া হয়েছে উপরওয়ালাকে আরও রস জোগান দেয়ার। নিচের রস উপরের দিকে যেতেই থাকবে। আয়-বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। নিচের তলার মানুষের মাথাপিছু যে প্রবৃদ্ধি হবে, উপরতলার মানুষের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি যে তার থেকে বহুগুণ বেশি হবে এটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সামাজিক ব্যবসা নিচ থেকে উপরে রস চালান দেয়ার গতিটা কমাবে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনকে সামাজিক ব্যবসা একেবারে নিচের তলার লোকের কাছে সহজলভ্য করে দিতে পারে। তার ফলে তাদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। উপরের তলার অফুরন্ত সম্পদের অংশ সামাজিক ব্যবসায় নিয়োজিত হলে তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা কমবে। সামাজিক ব্যবসার পরিমাণ যদি ব্যক্তিগত মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার চেয়ে বেশি হতে আরম্ভ করে, তাহলে যত না নিচের রস উপরে যাবে তার চেয়ে বেশি উপরের রস নিচে আসতে শুরু করবে।
সামাজিক ব্যবসা তাত্ত্বিক কাঠামোতে একটা উল্টো যন্ত্র স্থাপন করছে। উপরের রস নিচে আনার যন্ত্র। ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই একই মার্কেটে দুযন্ত্র কাজ করবে। কোন যন্ত্রটির জোর বেশি হবে সেটা নির্ভর করবে আমরা কী চাই তার ওপর। সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, যন্ত্রের হাতে নয়। আমরা আমাদের পছন্দের যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করব। বর্তমানে যন্ত্র একটাই। কাজেই এখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত কাজে লাগে না। যন্ত্রই সিদ্ধান্ত স্থির করে দিয়েছে। আমাদের বলা হচ্ছে যে এটাই একমাত্র এবং সর্বোত্তম যন্ত্র। আমরা সে কথা বিশ্বাস করে কলের পুতুলের মতো এ যন্ত্র ব্যবহার করে তথাকথিত সাফল্যের পেছনে যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছি। আমাদের একটু থেমে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে- আমরা কি নিজের ইচ্ছাসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ হব, নাকি কলের পুতুল হব? মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য জয়ী হবে, নাকি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা জয়ী হবে? যন্ত্র জয়ী হবে, নাকি মানুষ জয়ী হবে?
বর্তমান যন্ত্র মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে তাকে প্রশ্নাতীত করে রেখেছে। স্বার্থপরতাকে একমাত্র গুণ ধরে নিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দারিদ্র্য, আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ কিছু থেকেই বের হওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতে হবে যে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আরও মানুষ আছে, আরও প্রাণী আছে। সবার সমবেত ভবিষ্যৎই আমার ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎই আমার ভবিষ্যৎ।
জিডিপি কার কথা বলে?
স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাফল্যের মাপকাঠি বানাই স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদকে উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেমন যে যত বেশি ধনী, সে তত বেশি সফল ব্যক্তি। যে ব্যবসায় যত বেশি লাভ করে, সে তত বেশি সফল। যে দেশের মাথাপিছু জিডিপি যত বেশি, যে দেশ তত বেশি উন্নত। জিডিপি দিয়ে আমরা কী জানলাম? আমাদের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কত হয়েছে তা জানলাম। কিন্তু তাতে দেশের এবং মানুষের পরিস্থিতির কতটুকু জানা হল? এর মাধ্যমে কি আমরা জানতে পারলাম দেশের দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কী? হয়তো দেশে বাঘা বাঘা কিছু ধনী লোক আছে যারা জিডিপির ৯৯ শতাংশের মালিক। তাতে সাধারণ মানুষের তো ভয় পাওয়ার কথা। আনন্দিত হওয়ার তো কোনো কারণই নেই। মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে হলে এমন একটা পরিমাপ বের করতে হবে যেটা আসবে জিডিপির সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বার্থহীনতা, আয়-বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ, সবার কাছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, মানবিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদির পরিমাপ যুক্ত করে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের যে চমৎকার সুযোগটা এসেছে সেটাও চলছে উল্টা দিকে। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব সৃষ্টির সুযোগ না হয়ে এটা হয়ে পড়ছে বাজার দখলের লড়াই। এক রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্র থাবা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে আরেক রাষ্ট্রের মানুষের ওপর। বিশ্বপরিবার গড়ার জায়গায় বিশ্ব পরিণত হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রণক্ষেত্রে।
প্রযুক্তি
যে মন ধাঁধানো, চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি একটার পর একটা আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তার চেয়ে দ্রুততর গতিতে আমাদের জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করছে, তার ফল আমাদের ওপর কেমন হবে? প্রতিদিন মনে হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের অতি পরিচিত পথে একটা অজানা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই চমক আমাদের জীবনকে আরও উপভোগ্য করবে, সহজ করবে, নাকি কারও জন্য সহজ, কারও জন্য কঠিন করবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটা ভালো হচ্ছে। কিন্তু যদি অর্থনীতির মূল যন্ত্রটিকে ঘিরে প্রযুক্তি এগোতে থাকে তাহলে এই নতুন প্রযুক্তি স্বার্থপরতার শক্তিকে আরও জোরদার করবে। যেহেতু স্বার্থপর পৃথিবীতে আর কিছু করণীয় দেখা যাবে না। অনেকে এ নিয়ে আপত্তি তুলবেন। সমাধান হিসেবে এদিকে-ওদিকে কিছু স্বার্থহীনতার প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা হবে। নিয়ম-নীতি ভেঙে কেউ কেউ প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে চাপা দেয়া স্বার্থহীনতার শক্তিকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু মূল যন্ত্র তার কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করে যাবে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এই পরিবর্তন আসছে বিচ্ছিন্নভাবে, মূলত খণ্ড খণ্ড স্বার্থপর লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো বৈশ্বিক স্বপ্নকে সামনে রেখে এই পরিবর্তন আসছে না। নতুন একটা প্রযুক্তি এলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, ইস এটাকে যদি সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন আনার কাজে লাগানো যেত, যদি দারিদ্র্য মোচনের কাজে লাগানো যেত, যদি পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগানো যেত। কিছু চেষ্টাও হয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু বেশিদূর এগোনো যায় না। সবার চোখে স্বার্থপরতার চশমা লাগানো। এ চশমা ভেদ করে স্বার্থহীন উদ্দেশ্য সাধনে বেশিদূর যাওয়া যায় না, কারণ এ চশমা দিয়ে স্বার্থহীনতার রাস্তায় বেশিদূর দেখা যায় না। নব-আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য ব্যবহারের কথা মনেই আসে না। স্বার্থহীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে তার জন্য আনকোরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। সৃজনশীলতা আর্থিক সাফল্যের রাজপথ ধরে চলতে থাকে। এ পথে এমন কোনো পথনির্দেশ দেয়া থাকে না যা থেকে জানা যাবে প্রযুক্তিকে কোন পথে নিয়ে গেলে সব সমস্যামুক্ত নতুন এক পৃথিবী গড়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা পথনির্দেশ স্থাপন করবে কে? কারা ঠিক করছে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মিলিত গন্তব্য কোথায় এটা কি আমরা স্থির করে রেখেছি? যদি সেটা স্থির করা না থাকে, তবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যার যার পথে এগোবো, এটাই তো স্বাভাবিক। এবং তাই হচ্ছে। তাই বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। জাতিসংঘ প্রণীত শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য ছিল একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। তাই এটা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মানবসমাজ হিসেবে আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই এটা ছিল তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা। এর কারণে আমরা অনেক সাফল্য অর্জনও করেছি। কিন্তু প্রযুক্তি এর পেছনে এসে দাঁড়ায়নি। জানা প্রযুক্তিকে আমরা এর জন্য মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছি, কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ প্রযুক্তির জগৎ চলছে স্বার্থপর অর্থনীতির কড়া শাসনে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
মুহাম্মদ ইউনূস : নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ
সামাজিক ব্যবসা তাত্ত্বিক কাঠামোতে একটা উল্টো যন্ত্র স্থাপন করছে। উপরের রস নিচে আনার যন্ত্র। ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই একই মার্কেটে দুযন্ত্র কাজ করবে। কোন যন্ত্রটির জোর বেশি হবে সেটা নির্ভর করবে আমরা কী চাই তার ওপর। সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, যন্ত্রের হাতে নয়। আমরা আমাদের পছন্দের যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করব। বর্তমানে যন্ত্র একটাই। কাজেই এখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত কাজে লাগে না। যন্ত্রই সিদ্ধান্ত স্থির করে দিয়েছে। আমাদের বলা হচ্ছে যে এটাই একমাত্র এবং সর্বোত্তম যন্ত্র। আমরা সে কথা বিশ্বাস করে কলের পুতুলের মতো এ যন্ত্র ব্যবহার করে তথাকথিত সাফল্যের পেছনে যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছি। আমাদের একটু থেমে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে- আমরা কি নিজের ইচ্ছাসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ হব, নাকি কলের পুতুল হব? মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য জয়ী হবে, নাকি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা জয়ী হবে? যন্ত্র জয়ী হবে, নাকি মানুষ জয়ী হবে?
বর্তমান যন্ত্র মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে তাকে প্রশ্নাতীত করে রেখেছে। স্বার্থপরতাকে একমাত্র গুণ ধরে নিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দারিদ্র্য, আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ কিছু থেকেই বের হওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতে হবে যে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আরও মানুষ আছে, আরও প্রাণী আছে। সবার সমবেত ভবিষ্যৎই আমার ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎই আমার ভবিষ্যৎ।
জিডিপি কার কথা বলে?
স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাফল্যের মাপকাঠি বানাই স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদকে উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেমন যে যত বেশি ধনী, সে তত বেশি সফল ব্যক্তি। যে ব্যবসায় যত বেশি লাভ করে, সে তত বেশি সফল। যে দেশের মাথাপিছু জিডিপি যত বেশি, যে দেশ তত বেশি উন্নত। জিডিপি দিয়ে আমরা কী জানলাম? আমাদের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কত হয়েছে তা জানলাম। কিন্তু তাতে দেশের এবং মানুষের পরিস্থিতির কতটুকু জানা হল? এর মাধ্যমে কি আমরা জানতে পারলাম দেশের দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কী? হয়তো দেশে বাঘা বাঘা কিছু ধনী লোক আছে যারা জিডিপির ৯৯ শতাংশের মালিক। তাতে সাধারণ মানুষের তো ভয় পাওয়ার কথা। আনন্দিত হওয়ার তো কোনো কারণই নেই। মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে হলে এমন একটা পরিমাপ বের করতে হবে যেটা আসবে জিডিপির সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বার্থহীনতা, আয়-বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ, সবার কাছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, মানবিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদির পরিমাপ যুক্ত করে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের যে চমৎকার সুযোগটা এসেছে সেটাও চলছে উল্টা দিকে। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব সৃষ্টির সুযোগ না হয়ে এটা হয়ে পড়ছে বাজার দখলের লড়াই। এক রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্র থাবা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে আরেক রাষ্ট্রের মানুষের ওপর। বিশ্বপরিবার গড়ার জায়গায় বিশ্ব পরিণত হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রণক্ষেত্রে।
প্রযুক্তি
যে মন ধাঁধানো, চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি একটার পর একটা আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তার চেয়ে দ্রুততর গতিতে আমাদের জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করছে, তার ফল আমাদের ওপর কেমন হবে? প্রতিদিন মনে হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের অতি পরিচিত পথে একটা অজানা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই চমক আমাদের জীবনকে আরও উপভোগ্য করবে, সহজ করবে, নাকি কারও জন্য সহজ, কারও জন্য কঠিন করবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটা ভালো হচ্ছে। কিন্তু যদি অর্থনীতির মূল যন্ত্রটিকে ঘিরে প্রযুক্তি এগোতে থাকে তাহলে এই নতুন প্রযুক্তি স্বার্থপরতার শক্তিকে আরও জোরদার করবে। যেহেতু স্বার্থপর পৃথিবীতে আর কিছু করণীয় দেখা যাবে না। অনেকে এ নিয়ে আপত্তি তুলবেন। সমাধান হিসেবে এদিকে-ওদিকে কিছু স্বার্থহীনতার প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা হবে। নিয়ম-নীতি ভেঙে কেউ কেউ প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে চাপা দেয়া স্বার্থহীনতার শক্তিকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু মূল যন্ত্র তার কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করে যাবে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এই পরিবর্তন আসছে বিচ্ছিন্নভাবে, মূলত খণ্ড খণ্ড স্বার্থপর লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো বৈশ্বিক স্বপ্নকে সামনে রেখে এই পরিবর্তন আসছে না। নতুন একটা প্রযুক্তি এলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, ইস এটাকে যদি সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন আনার কাজে লাগানো যেত, যদি দারিদ্র্য মোচনের কাজে লাগানো যেত, যদি পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগানো যেত। কিছু চেষ্টাও হয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু বেশিদূর এগোনো যায় না। সবার চোখে স্বার্থপরতার চশমা লাগানো। এ চশমা ভেদ করে স্বার্থহীন উদ্দেশ্য সাধনে বেশিদূর যাওয়া যায় না, কারণ এ চশমা দিয়ে স্বার্থহীনতার রাস্তায় বেশিদূর দেখা যায় না। নব-আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য ব্যবহারের কথা মনেই আসে না। স্বার্থহীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে তার জন্য আনকোরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। সৃজনশীলতা আর্থিক সাফল্যের রাজপথ ধরে চলতে থাকে। এ পথে এমন কোনো পথনির্দেশ দেয়া থাকে না যা থেকে জানা যাবে প্রযুক্তিকে কোন পথে নিয়ে গেলে সব সমস্যামুক্ত নতুন এক পৃথিবী গড়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা পথনির্দেশ স্থাপন করবে কে? কারা ঠিক করছে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মিলিত গন্তব্য কোথায় এটা কি আমরা স্থির করে রেখেছি? যদি সেটা স্থির করা না থাকে, তবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যার যার পথে এগোবো, এটাই তো স্বাভাবিক। এবং তাই হচ্ছে। তাই বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। জাতিসংঘ প্রণীত শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য ছিল একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। তাই এটা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মানবসমাজ হিসেবে আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই এটা ছিল তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা। এর কারণে আমরা অনেক সাফল্য অর্জনও করেছি। কিন্তু প্রযুক্তি এর পেছনে এসে দাঁড়ায়নি। জানা প্রযুক্তিকে আমরা এর জন্য মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছি, কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ প্রযুক্তির জগৎ চলছে স্বার্থপর অর্থনীতির কড়া শাসনে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
মুহাম্মদ ইউনূস : নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ
No comments