দলবাজ নয়, চাই দায়িত্ববান পুলিশ by ড. মাহবুব উল্লাহ্
১৭৯২ সালে এতদঞ্চলের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দারোগা আইনের প্রবর্তন করেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এ দেশে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়। মুঘল শাসনে জমিদার শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। মুঘল সম্রাটরা মনসবদারি প্রথা চালু করেছিলেন। মনসবদাররা সবাই সমান ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন না। একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য একজন মনসবদার থাকতেন এবং তার অধীনে বিভিন্ন সংখ্যায় ও মাত্রায় পাইক থাকত। যে মনসবদারের পাইকের সংখ্যা বেশি থাকত, সে-ই ছিলেন অধিকতর ক্ষমতাশালী। পাইকরা এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ দমন, সম্রাটের জন্য কর, খাজনা আদায় এবং সম্রাটের প্রয়োজনে যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণ করত। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত খাজনা পাইকদের বেতন-ভাতা নির্বাহ করা, মনসবদারের প্রাপ্য পূরণ করা এবং সম্রাটের প্রাপ্য পরিশোধে ব্যবহার করা হতো। তবে ক্ষেত্রবিশেষে খোদ মনসবদাররা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন। ১৭৯২ সালের দারোগা আইন স্থানীয় আইনশৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে মুঘল ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কোম্পানি শাসকরা দারোগাদের জন্য খুবই সামান্য মাসমাহিনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তাদের দেয়া হয়েছিল বল প্রয়োগের প্রচুর ক্ষমতা। ধরে নেয়া হয়েছিল মাসমাহিনার ঘাটতি দারোগারা তাদের বল প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে আদায় করে নেবেন। আইন লংঘনকারীরা এভাবে দারোগাদের ঘুষ দিয়ে অনেক সময় রেহাই পেত। এক অর্থে বলা যায়, দারোগাদের প্রদেয় ঘুষই ছিল আইন লংঘনের জন্য এক ধরনের জরিমানা।
দারোগা আইনের ওপর ভিত্তি করে গত দুই শতাধিক বছরে এ দেশে পুলিশ প্রশাসন গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি আমল এবং বাংলাদেশ আমলেও এর চরিত্রগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেক আইন-কানুন রচিত হয়েছে। পুলিশি ক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে গণতন্ত্র চালু আছে বলেও দাবি করা হয়। এসব সত্ত্বেও একটি প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। প্রবাদটি হল, বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর ঘা। অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই ১৭৯২ সাল থেকে পুলিশ বেতন-ভাতা হিসেবে যা পায় তা অতি নগণ্যই। তাদের ক্ষমতার শাখা-প্রশাখা এতই বিস্তৃত যে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সব ক্ষেত্রের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ অবশ্যম্ভাবী। পুলিশকে বিচিত্র ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি-চামারি পর্যন্ত সব কিছুতেই পুলিশের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি। দেশের পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যে, কোথায় কখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে, সড়ক অবরোধ হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শত-সহস মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, অকল্পনীয় রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হবে- এর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পুলিশকে। কখনও কখনও পুলিশও খুন-জখমের শিকার হন। জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল। হাল আমলে পুলিশকে অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, জল কামান এবং সাউন্ড গ্রেনেড। এত কিছু করেও মাঝে মাঝে পুলিশকে অসহায় মনে হয়। আবার একথাও সত্য যে, পুলিশের বাড়াবাড়ি এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে পুলিশ পরোয়া করে বলে মনে হয় না। অনেক সময় নিরীহ মানুষকে আসামি সাজিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়। এমনকি ধৃতাবস্থায় তাদের পায়ে গুলি করা হয়। আইন যদিও বলছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাকিমের কাছে উপস্থিত করতে হবে, এখন তার ব্যত্যয়ই সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে আর পাওয়া যায় না। কখনও কখনও খালে-বিলে, রেললাইনের ধারে ভাগ্যাহত ব্যক্তির গলিত লাশটি উদ্ধার হয়। এসব কিছু আমরা জানতে পারি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে। অনেক সময় প্রতিবেদকও পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়া থেকে রেহাই পান না। এর সবকিছুই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। পুলিশের কাজ হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ঘটনা এমনভাবে ঘটে, মনে হয়, দুষ্টরাই পুলিশের কাছে আদৃত এবং শিষ্টরাই পুলিশের চক্ষুশূল। কারণ কোনো নীতিবান মানুষই পুলিশকে বেআইনিভাবে উপরি দিতে রাজি হয় না।
সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আমরা এখন নতুন সব শব্দ শিখছি। যেমন ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য ইত্যাদি। অর্থনীতি শাস্ত্রে বাণিজ্য শব্দটি যে দ্যোতনা প্রকাশ করে এসব বাণিজ্য সেই একই দ্যোতনা প্রকাশ করে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যথার্থ। এক সময় বলা হতো, In India from Vice Roy to Chowkidar every body is corrupt. যেখানেই ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে, সেখানেই দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ পর্যন্ত এতটা নিখুঁত হয়নি যে, ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ অবলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে পদে পদে ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ সুযোগটি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে এ কারণে, প্রশাসনে রিক্রুটমেন্ট দলীয় বিবেচনার দ্বারা অনেকাংশেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যারা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান, তারা তাদের পছন্দের দল এলে অনেকাংশেই দুর্বিনীত হয়ে ওঠেন। কুচপরোয়া নেই এমন একটি মনোভাব তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। নিজেদের রিক্রুটদের দিয়ে টেলিফোন নির্দেশের মাধ্যমে কীভাবে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম খুবই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। নিজ দলের সমর্থক ছাত্রদের মৌখিক পরীক্ষার সময় বিবেচনায় নেবেন বলে আশ্বস্ত করায় এ বিব্রতকর পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে। ম্যাক্স ওয়েবারের লেখায় পড়েছি- আমলারা হল Legal rational entity. আমলারা আইন অনুযায়ী নির্মোহভাবে কর্তব্য সম্পাদন করবেন, এটাই কাম্য। এক্ষেত্রে তারা যত নিষ্ঠাবান হবেন, দেশের আমলাতন্ত্র ততই দক্ষ ও যোগ্য হবে। দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে সৎ, নিষ্ঠাবান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিবেচক আমলা বা পুলিশ কর্মকর্তা নেই এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু তারা দুর্জনদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। থাকেন শাস্তিমূলক বদলি বা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার আশংকায়। এ কারণে দেশ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। আজ হোক কাল হোক, এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সৎভাবে কাজ করার সুযোগ না দিলে দেশে কখনও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সুশাসন না থাকলে দেশ বিশৃংখল অবস্থায় নিপতিত হবে। রাজনৈতিক নেতাদেরও এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসনকে বেআইনি কাজে প্রণোদিত করলে রাজনীতিকদের সাময়িক সুবিধা হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো লাভ হয় না।
দৈনিক যুগান্তর গত ১৪ ও ১৫ নভেম্বর দুটি প্রতিবেদন ছেপেছে। ১৪ নভেম্বরের প্রতিবেদনের শিরোনাম হল, সোনার খনি দোহার থানা! ঘাটে ঘাটে ওসির মাসোয়ারা। ১৫ নভেম্বরের শিরোনাম হল, ভয়াবহ মাদকের ছোবল দোহারে-চালকের আসনে ওসি। একজন ওসি সম্পর্কে এসব প্রতিবেদনে যা লেখা হয়েছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। প্রতিবেদনের কথাগুলো সত্য না হলেই ভালো লাগত। প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে, তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রয়াত একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। শিক্ষা জীবনে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে গর্ব করে অনেকের কাছে বলে বেড়ান। এছাড়া ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছাড়াও আরও উপরের মহলে রয়েছে হট কানেকশন। আর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক তো আছেই। ফলে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেন প্রতিনিয়ত। এর খেসারত দিতে হচ্ছে দোহারবাসীকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যুগান্তরের এই প্রতিবেদনগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় তাহলেও এটি নিন্দনীয়। ধরে নিচ্ছি সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনেই এসব প্রতিবেদন রচিত হয়েছে। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে ব্যবহৃত অংশ থেকে এটাই মনে হচ্ছে, ক্ষমতার নেটওয়ার্কই একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বিপথগামী করে তুলতে পারে। কবে কখন এ ধরনের নেটওয়ার্ক ছিন্ন করে কোনো এক দেবদূতসম রাষ্ট্রনায়ক দেশবাসীকে একটি নিরপেক্ষ ন্যায়পরায়ণ প্রশাসন উপহার দেবে, সেটার জন্যই আমরা অপেক্ষায় থাকব।
পুলিশ জনগণের বন্ধু এমন কথাই বারবার শুনেছি। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবেই আমরা দেখতে চাই। যে ওসির বিরুদ্ধে প্রতিবেদনগুলো যুগান্তরে ছাপা হয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থন করে যদি তার কোনো বক্তব্য থাকে, সেটাও যুগান্তর ভবিষ্যতে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ছাপবে বলে আশা করি।
পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। Tomlins লিখেছেন, আমেরিকান রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে গিয়ে পুলিশের বংশ লতিকা উল্লেখ না করা হবে পুঁজিবাদের আলোচনা না করে আমেরিকান অর্থনীতির ইতিহাস লেখার চেষ্টা করা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে পুলিশ বলতে বোঝাত একটি সুশৃংখল পরিবেশের স্রষ্টা, যে পরিবেশ হবে বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। পুলিশ একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। পুলিশ শব্দটির মূল খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে এবং সেখান থেকে গ্রিসে। গ্রিসে এরিস্টটলের লেখায় পলিসি অথবা পলিটিক্সের উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে বোঝানো হতো, দেশের সমুদয় প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে বোঝানো হতো, যেগুলোর মাধ্যমে সমাজে শৃংখলা আসে এবং শৃংখলা থেকে আসে সমৃদ্ধি, প্রগতি এবং সুখ, বিশেষ করে যার ফলে বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বস্তুত এটাই হল শাসন ব্যবস্থার একটি অংশ, যার মাধ্যমে সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুলিশের কাজ হল- চুরি, ডাকাতি, সহিংসতা প্রতিরোধ করা। সমাজে এমন একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যার মাধ্যমে নিরাপত্তা বিধান, শ্রমের নিয়ন্ত্রণ, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, ব্যবসায়ে ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিত এবং ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। পুলিশের কাজের মধ্যে রয়েছে মাদকের লাইসেন্স দেয়া, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, গৃহনির্মাণ নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা, সড়ক ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। তবে পরবর্তীকালে পুলিশি কার্যক্রমের একটি অংশ বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ, গোষ্ঠীর ওপর গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণই মুখ্য বিষয়। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ভার পুলিশের হাতে ছেড়ে দিলে সমাজে বিপর্যয় ঘটবে। সেই শাসনই প্রকৃষ্ট শাসন যার ফলে ব্যক্তি ষড়রিপু তাড়না থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য সদাসর্বদা সজাগ থাকে। লোভ-প্রলোভন মানুষকে বিপথগামী করে। কিন্তু লোভ-প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকলেই প্রকৃত মানুষ হওয়া সম্ভব। সেজন্য এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যে ব্যবস্থা মানুষকে মানবিক হতে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে। বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে না পারলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও নিদারুণ ক্ষতি ঘটবে। সুতরাং একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য চাই উন্নতমানের নৈতিক শিক্ষা। এর ফলে পুলিশকে আমাদের যখন-তখন নিন্দা করতে হবে না এবং পুলিশ নিজেও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে অনেকটাই দূরে থাকবে। আমরা সে রকম একটি দিনের অপেক্ষায় আছি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
দারোগা আইনের ওপর ভিত্তি করে গত দুই শতাধিক বছরে এ দেশে পুলিশ প্রশাসন গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি আমল এবং বাংলাদেশ আমলেও এর চরিত্রগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেক আইন-কানুন রচিত হয়েছে। পুলিশি ক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে গণতন্ত্র চালু আছে বলেও দাবি করা হয়। এসব সত্ত্বেও একটি প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। প্রবাদটি হল, বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর ঘা। অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই ১৭৯২ সাল থেকে পুলিশ বেতন-ভাতা হিসেবে যা পায় তা অতি নগণ্যই। তাদের ক্ষমতার শাখা-প্রশাখা এতই বিস্তৃত যে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সব ক্ষেত্রের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ অবশ্যম্ভাবী। পুলিশকে বিচিত্র ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি-চামারি পর্যন্ত সব কিছুতেই পুলিশের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করি। দেশের পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যে, কোথায় কখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে, সড়ক অবরোধ হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শত-সহস মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, অকল্পনীয় রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হবে- এর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পুলিশকে। কখনও কখনও পুলিশও খুন-জখমের শিকার হন। জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল। হাল আমলে পুলিশকে অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, জল কামান এবং সাউন্ড গ্রেনেড। এত কিছু করেও মাঝে মাঝে পুলিশকে অসহায় মনে হয়। আবার একথাও সত্য যে, পুলিশের বাড়াবাড়ি এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে পুলিশ পরোয়া করে বলে মনে হয় না। অনেক সময় নিরীহ মানুষকে আসামি সাজিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়। এমনকি ধৃতাবস্থায় তাদের পায়ে গুলি করা হয়। আইন যদিও বলছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাকিমের কাছে উপস্থিত করতে হবে, এখন তার ব্যত্যয়ই সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে আর পাওয়া যায় না। কখনও কখনও খালে-বিলে, রেললাইনের ধারে ভাগ্যাহত ব্যক্তির গলিত লাশটি উদ্ধার হয়। এসব কিছু আমরা জানতে পারি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে। অনেক সময় প্রতিবেদকও পুলিশের হাতে হেনস্থা হওয়া থেকে রেহাই পান না। এর সবকিছুই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। পুলিশের কাজ হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ঘটনা এমনভাবে ঘটে, মনে হয়, দুষ্টরাই পুলিশের কাছে আদৃত এবং শিষ্টরাই পুলিশের চক্ষুশূল। কারণ কোনো নীতিবান মানুষই পুলিশকে বেআইনিভাবে উপরি দিতে রাজি হয় না।
সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আমরা এখন নতুন সব শব্দ শিখছি। যেমন ঘুষ বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য ইত্যাদি। অর্থনীতি শাস্ত্রে বাণিজ্য শব্দটি যে দ্যোতনা প্রকাশ করে এসব বাণিজ্য সেই একই দ্যোতনা প্রকাশ করে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যথার্থ। এক সময় বলা হতো, In India from Vice Roy to Chowkidar every body is corrupt. যেখানেই ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে, সেখানেই দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ পর্যন্ত এতটা নিখুঁত হয়নি যে, ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ অবলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে পদে পদে ইচ্ছামাফিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ সুযোগটি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে এ কারণে, প্রশাসনে রিক্রুটমেন্ট দলীয় বিবেচনার দ্বারা অনেকাংশেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যারা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান, তারা তাদের পছন্দের দল এলে অনেকাংশেই দুর্বিনীত হয়ে ওঠেন। কুচপরোয়া নেই এমন একটি মনোভাব তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। নিজেদের রিক্রুটদের দিয়ে টেলিফোন নির্দেশের মাধ্যমে কীভাবে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম খুবই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। নিজ দলের সমর্থক ছাত্রদের মৌখিক পরীক্ষার সময় বিবেচনায় নেবেন বলে আশ্বস্ত করায় এ বিব্রতকর পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে। ম্যাক্স ওয়েবারের লেখায় পড়েছি- আমলারা হল Legal rational entity. আমলারা আইন অনুযায়ী নির্মোহভাবে কর্তব্য সম্পাদন করবেন, এটাই কাম্য। এক্ষেত্রে তারা যত নিষ্ঠাবান হবেন, দেশের আমলাতন্ত্র ততই দক্ষ ও যোগ্য হবে। দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে সৎ, নিষ্ঠাবান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিবেচক আমলা বা পুলিশ কর্মকর্তা নেই এমনটি বলা যাবে না। কিন্তু তারা দুর্জনদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। থাকেন শাস্তিমূলক বদলি বা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার আশংকায়। এ কারণে দেশ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। আজ হোক কাল হোক, এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সৎভাবে কাজ করার সুযোগ না দিলে দেশে কখনও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সুশাসন না থাকলে দেশ বিশৃংখল অবস্থায় নিপতিত হবে। রাজনৈতিক নেতাদেরও এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসনকে বেআইনি কাজে প্রণোদিত করলে রাজনীতিকদের সাময়িক সুবিধা হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো লাভ হয় না।
দৈনিক যুগান্তর গত ১৪ ও ১৫ নভেম্বর দুটি প্রতিবেদন ছেপেছে। ১৪ নভেম্বরের প্রতিবেদনের শিরোনাম হল, সোনার খনি দোহার থানা! ঘাটে ঘাটে ওসির মাসোয়ারা। ১৫ নভেম্বরের শিরোনাম হল, ভয়াবহ মাদকের ছোবল দোহারে-চালকের আসনে ওসি। একজন ওসি সম্পর্কে এসব প্রতিবেদনে যা লেখা হয়েছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। প্রতিবেদনের কথাগুলো সত্য না হলেই ভালো লাগত। প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে, তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রয়াত একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। শিক্ষা জীবনে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে গর্ব করে অনেকের কাছে বলে বেড়ান। এছাড়া ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছাড়াও আরও উপরের মহলে রয়েছে হট কানেকশন। আর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক তো আছেই। ফলে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেন প্রতিনিয়ত। এর খেসারত দিতে হচ্ছে দোহারবাসীকে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যুগান্তরের এই প্রতিবেদনগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় তাহলেও এটি নিন্দনীয়। ধরে নিচ্ছি সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনেই এসব প্রতিবেদন রচিত হয়েছে। উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে ব্যবহৃত অংশ থেকে এটাই মনে হচ্ছে, ক্ষমতার নেটওয়ার্কই একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বিপথগামী করে তুলতে পারে। কবে কখন এ ধরনের নেটওয়ার্ক ছিন্ন করে কোনো এক দেবদূতসম রাষ্ট্রনায়ক দেশবাসীকে একটি নিরপেক্ষ ন্যায়পরায়ণ প্রশাসন উপহার দেবে, সেটার জন্যই আমরা অপেক্ষায় থাকব।
পুলিশ জনগণের বন্ধু এমন কথাই বারবার শুনেছি। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবেই আমরা দেখতে চাই। যে ওসির বিরুদ্ধে প্রতিবেদনগুলো যুগান্তরে ছাপা হয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থন করে যদি তার কোনো বক্তব্য থাকে, সেটাও যুগান্তর ভবিষ্যতে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ছাপবে বলে আশা করি।
পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। Tomlins লিখেছেন, আমেরিকান রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে গিয়ে পুলিশের বংশ লতিকা উল্লেখ না করা হবে পুঁজিবাদের আলোচনা না করে আমেরিকান অর্থনীতির ইতিহাস লেখার চেষ্টা করা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে পুলিশ বলতে বোঝাত একটি সুশৃংখল পরিবেশের স্রষ্টা, যে পরিবেশ হবে বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। পুলিশ একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। পুলিশ শব্দটির মূল খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে এবং সেখান থেকে গ্রিসে। গ্রিসে এরিস্টটলের লেখায় পলিসি অথবা পলিটিক্সের উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে বোঝানো হতো, দেশের সমুদয় প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে বোঝানো হতো, যেগুলোর মাধ্যমে সমাজে শৃংখলা আসে এবং শৃংখলা থেকে আসে সমৃদ্ধি, প্রগতি এবং সুখ, বিশেষ করে যার ফলে বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বস্তুত এটাই হল শাসন ব্যবস্থার একটি অংশ, যার মাধ্যমে সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুলিশের কাজ হল- চুরি, ডাকাতি, সহিংসতা প্রতিরোধ করা। সমাজে এমন একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যার মাধ্যমে নিরাপত্তা বিধান, শ্রমের নিয়ন্ত্রণ, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, ব্যবসায়ে ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিত এবং ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। পুলিশের কাজের মধ্যে রয়েছে মাদকের লাইসেন্স দেয়া, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, গৃহনির্মাণ নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা, সড়ক ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। তবে পরবর্তীকালে পুলিশি কার্যক্রমের একটি অংশ বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ, গোষ্ঠীর ওপর গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণই মুখ্য বিষয়। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ভার পুলিশের হাতে ছেড়ে দিলে সমাজে বিপর্যয় ঘটবে। সেই শাসনই প্রকৃষ্ট শাসন যার ফলে ব্যক্তি ষড়রিপু তাড়না থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য সদাসর্বদা সজাগ থাকে। লোভ-প্রলোভন মানুষকে বিপথগামী করে। কিন্তু লোভ-প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকলেই প্রকৃত মানুষ হওয়া সম্ভব। সেজন্য এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যে ব্যবস্থা মানুষকে মানবিক হতে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে। বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে না পারলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও নিদারুণ ক্ষতি ঘটবে। সুতরাং একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য চাই উন্নতমানের নৈতিক শিক্ষা। এর ফলে পুলিশকে আমাদের যখন-তখন নিন্দা করতে হবে না এবং পুলিশ নিজেও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে অনেকটাই দূরে থাকবে। আমরা সে রকম একটি দিনের অপেক্ষায় আছি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments