মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট এখন টেকনাফে!
উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের এখন প্রধান টার্গেট টেকনাফের কাটাবুনিয়া ঘাট। এটি স্থানীয়দের কাছে ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামে ব্যাপক পরিচিত। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এ ঘাটটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে পাচারকারীরা। এছাড়া টেকনাফ-উখিয়া-কক্সবাজারের আরও নয়টি ঘাট দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই নির্বিঘ্নে চলছে মানব পাচার। আর এসব কাজে সরাসরি জড়িত রয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পাচারকারীদের সঙ্গে দেশের ২০টি সিন্ডিকেট। ‘অবৈধপথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যেতে নগদ টাকা দিতে হয় না’- দালালদের এমন প্রলোভনের ফাঁদে প্রায় প্রতিদিনই পা দিচ্ছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। প্রথম অবস্থায় বিনা খরচে তারা পৌঁছে যান থাইল্যান্ড সীমান্তে। ট্রলারে চড়ে সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছার পর তাদের ঠিকানা হয় পাচারকারীদের বন্দিশালা। থাইল্যান্ড উপকূলের পাহাড়-জঙ্গলে একাধিক বন্দিশালা তৈরি করে রেখেছে সেখানকার স্থানীয় পাচারকারীরা। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় অর্থ আদায়ে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এরপর পাচারকারীরা সেখান থেকে মোবাইল ফোনে বাংলাদেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই সময় ফোনে নির্যাতিতদের আর্তচিৎকারও শুনানো হয়। পাশাপাশি মালয়েশিয়া পৌঁছানো বাবদ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা টেকনাফ-কক্সবাজারের অবস্থানরত দালালদের হাতে পৌঁছানোর অনুরোধ জানানো হয়। তখন পরিবারের সদস্যরা নিরুপায় হয়ে, যেভাবে পারে দালালদের হাতে তুলে দেয় নির্ধারিত টাকা। এরপর তাদের থাইল্যান্ড সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে হাঁটা পথে পৌঁছানো হয় মালয়েশিয়ায়। সেখানে তাদের গ্রহণ করে দালাল সিন্ডিকেটের অপর একটি গ্রুপ। অবৈধ পথে প্রবেশ করায় থাইল্যান্ড-মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন কয়েক হাজার মালয়েশিয়াগামী নিরীহ মানুষ। মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী। পাশাপাশি স্বপ্নের মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে গত প্রায় পাঁচ বছরে সাগরে সলিল সমাধি অথবা নিখোঁজ হয়েছেন সহস্রাধিক। টেকনাফের লেদা আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার এখনও নিখোঁজ রয়েছেন পাঁচ শতাধিক লোক।
যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন কৌশলে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে ফেরত আসা বেশ ক’জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডার ডেইল এলাকার নূরুল ইসলামের ছেলে কামাল হোসেন দুঃস্বপ্নের কথা মনে করে এখনও শিউড়ে ওঠেন। রোমহর্ষক সেসব দিনের কথা এখন আর মনে করতে চান না তিনি। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে একদিন বিদেশে যাওয়ার আশায় দালালদের প্রলোভনে পড়েছিলেন এই যুবক। কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে সাবরাং কাটাবুনিয়া থেকে আরও অনেকের সঙ্গে প্রথমে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি সাগরে অপেক্ষমাণ একটি বড় ট্রলারে উঠি। ট্রলারটি আট দিন সাগরে চলার পর থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছাই। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় নির্যাতনের পালা।’ কামাল হোসেনের মতো দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন একই এলাকার জাফর আলমের ছেলে আবুল মঞ্জুর, শাহাব মিয়ার ছেলে সিরাজ মিয়া, লম্বরীর ইমাম হোসেন, কেরুনতলীর মো. আলী। তাদের একেকজনের প্রতারিত হওয়ার কাহিনী একেক রকম। তবে সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছানোর পর বন্দিশালায় নির্যাতনের কাহিনী প্রায় একই রকম।
কামাল হোসেন আরও জানান, দালালদের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার যাদের পরিবার টাকা পরিশোধ করতে পারে না, তাদের দীর্ঘদিন বন্দি রেখে চালানো হয় নির্যাতন। অনেককে হত্যাও করা হয়।
হতভাগ্য যুবকদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখে কামাল হোসেন নিজেকে খানিকটা ভাগ্যবান মনে করেন। কেননা যথারীতি থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছার পর টেকনাফের দালালদের হাতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে দিতে পেরেছিল তার পরিবার। ফলে তাকে থাইল্যান্ড সীমান্ত অতিক্রম করে মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে ঢুকিয়ে দেয় দালালরা। কামাল বলেন, সেখানে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার পর লোকালয়ে প্রবেশ করেন কাজের সন্ধানে। অবৈধ হওয়ায় সেখানে ছিল পুলিশের কাছে ধরা পড়ার ভয়। কাজ শেষ করে রাতে আবার ফিরে যেতে হতো জঙ্গলে। এভাবে এক বছর কাটানোর পর পোকামাকড়ের কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে দালালদের মাধ্যমে দেশে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমান ভাড়াসহ ফিরে আসার খরচ পাঠানো হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কামাল হোসেন জানান, তার মতো অনেকে ফিরে আসতে না পেরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্য থেকে শতাধিক কর্মী উদ্ধার হওয়ার পর জানা যায় রোমহর্ষক নানা কাহিনী। মানব পাচারের আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষকে জড়ো করেছিল ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট। এক সময় শুধু কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দালালরা সিন্ডিকেটের হাতে কর্মীদের তুলে দিত। কিন্তু এখন গোটা বাংলাদেশ থেকে দালালরা পাচারের উদ্দেশ্যে যুবকদের সংগ্রহ করে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপসহ উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ট্রলারে করে লোক পাচার করে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পাচারের ঘটনা মনিটর করে ‘আরাকান প্রজেক্ট’ নামের একটি সংস্থা। তাদের হিসাবে, ২০০৮ সালে ট্রলারযোগে পাচার হয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার। ২০০৯-২০১০ সালে পাচার হয়েছে এক হাজারেরও কম। এটি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় ২০১২ সালে। ওই বছরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাচার হয় প্রায় ২০,০০০ হাজার। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার অবৈধ বাংলাদেশীকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করেছে কিংবা দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যেই থাইল্যান্ডের পুলিশ পাচারের অনেক নৌকা ফেরত পাঠানো শুরু করেছে। মাঝপথে ইঞ্জিন নৌকার তেল ফুরিয়ে গেলে সাগরে ডুবে যাওয়ায় অনেকে মারা গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৫ সালের দিকে ফয়েজ উল্লাহ মাঝি ও ধলু হোসেনের নেতৃত্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে ফিশিং বোটে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার শুরু হয়। এরপর রশিদ উল্লাহ মাঝি, পোয়া মাঝি, নবী হোসেন মাঝি, আইয়ুব আলী মাঝি, এজাহার মাঝির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে মালয়েশিয়ায় পাচার সম্প্রসারিত হতে থাকে। এরাই মূলত বঙ্গপোসাগরে ৭-৮ দিন ফিশিং ট্রলার চালিয়ে শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে থাইল্যান্ড উপকূলে অবৈধ অভিবাসীদের নামিয়ে দিয়ে আসত। সেখান থেকে পাচারকারী সিন্ডিকেটের অন্য দল তাদের গ্রহণ করত। থাইল্যান্ড থেকে প্রথম দিকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দিতে জনপ্রতি নগদে ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো আদায় করত। একেকটি ট্রলারের আয়তন অনুযায়ী ১০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত যাত্রী এভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে যেত। এখন টেকনাফ ছাড়িয়ে সারা বাংলাদেশে দালালের সংখ্যা শত শত।
স্থানীয় পর্যায়ের পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা জনান, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে মানবপাচার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, স্থানীয় জনগণের মধ্যে পাচারবিরোধী মনোভাব না থাকা এবং দালালদের আটক করতে না পারাতেই মূলত দিন দিন বেড়ে চলেছে মানব পাচার। এছাড়া জলসীমা প্রায় অরক্ষিত থাকায় সমুদ্রপথকে বেছে নিচ্ছে পাচারকারীরা। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ান সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ এবং ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে মানবপাচার চক্রকে আইনের আওতায় আনা, নৌপুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন, স্বেচ্ছায় যারা অবৈধপথে মালয়েশিয়ায় গমন করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনা এবং দালালদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে মানবপাচার কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘মানব পাচার একক কোনো দেশের উদ্যোগে বন্ধ করা সম্ভব নয়। মানব পাচারের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট জড়িত থাকে। ফলে যে দেশ থেকে, যে দেশের মধ্য দিয়ে এবং যে দেশের গন্তব্যে মানব পাচার হয়ে থাকে সেই দেশগুলোর মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগে সমুদ্রপথে মানব পাচার বন্ধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি’।
মানব পাচার রোধে নানা বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। এর নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী যুগান্তরকে বললেন, সমুদ্রপথে মানব পাচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু এটি প্রয়োগ হয় না। মানব পাচারের পেছনে সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া মানব পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাচারে আধুনিক ট্রলার : এক সময় ছোট ছোট ফিশিং ট্রলারে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার শুরু হলেও এখন ওই সব ট্রলার ব্যবহার করা হয় না। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বড় আকারের আধুনিক ট্রলার। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী গডফাদাররা এ দেশের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দেয় আধুনিক সুযোগসুবিধা সংবলিত এসব ট্রলার। থাইল্যান্ডের নাগরিকদের মালিকানাধীন এসব ট্রলারের একেকটিতে ৫০০ থেকে এক হাজার পর্যন্ত লোক ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ট্রলারগুলো থাইল্যান্ড উপকূল থেকে ছেড়ে এসে বাংলাদেশের জলসীমায় সেন্টমার্টিনের প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে মৌলভীর শীল নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকে। আঁধার ঘনিয়ে এলে ট্রলারগুলো আস্তে আস্তে মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি চলে আসে। তখন রাতের আঁধারে টেকনাফ-উখিয়া-কক্সবাজারের উপকূলীয় নৌঘাটগুলোতে হুলস্থূল পড়ে যায়। শুরু হয় ছোটাছুটি। দালালদের সহায়তায় শত শত লোক তখন ছোট ছোট ফিশিং ট্রলারে করে ছুটে বঙ্গপোসাগরে অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারগুলোর দিকে। মানব পাচারকারীদের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ মোবাইল নেটওয়ার্ক। সাগরে অপেক্ষমাণ ট্রলারের অবস্থান থেকে শুরু করে কোন্ ঘাট দিয়ে ক’টি ছোট ট্রলারে কতজন আদম নিয়ে রওয়ানা হয়েছে তা স্থনীয় সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে জেনে যাচ্ছে।
অপহরণ চক্র : টেকনাফে মানব পাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি অপহরণকারী চক্র। এরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যেতে আসা লোকদের অপহরণ করে থাকে। এক দালালের মাধ্যমে টেকনাফে আসা লোকদের এরা অপহরণ করে অন্য দালালের হাতে তুলে দেয়। এই চক্রের সদস্যরা যে কোনো লোককে অপহরণ করে দালালের কাছে পৌঁছে দিলেই জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পেয়ে যায়। ফলে লাভজনক এই অপহরণ ব্যবসায় নেমে পড়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এরা প্রথমে ওতপেতে থাকে টেকনাফ বাস স্টেশনে। এখানে নাইট কোচগুলো চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে খুব ভোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই বেবিট্যাক্সি, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে মালয়েশিয়াগামীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোনো কোনো সময় অপহরণের শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়া যেতে না চাওয়া লোকজনও। এক্ষেত্রে টেকনাফে কাজের সন্ধানে আসা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক অপহরণ করে দালালদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দালালরা তাদের হাত-পা বেঁধে তুলে দেয় মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে। পরে থাইল্যান্ড পৌঁছার পর পরিবারকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করতে হয় তাদের। কিছুদিন আগে টেকনাফে মোবাইল টাওয়ারের কাজ করতে আসা বাংলালিংকের এক ইঞ্জিনিয়ারকে সাবরাং এলাকা থেকে তারা অপহরণ করে মালয়েশিয়ার ট্রলারে পৌঁছে দিয়েছিল। পরে মিডিয়া ও প্রশাসনের চাপে পড়ে সেই ব্যক্তিকে কক্সবাজারের মহেষখালী থেকে ফেরত দিতে বাধ্য হয় পাচারকারীরা। এছাড়া ২২ অক্টোবর টেকনাফে ভোলার এক যুবককে দিন-দুপুরে অপহরণকালে জনতা এক অপহরণকারীকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে। অপহরণকারী চক্রের মধ্যে রয়েছে লেঙ্গুরবিল এলাকার ডাকাত মোস্তাকের নেতৃত্বে একটি গ্র“প, কায়ুকখালী পাড়া এলাকার চোরা সাইফুলের নেতৃত্বে অপর একটি গ্র“প। এছাড়া, গোদারবিল এলাকার সাদ্দাম, শামসু, তারেক, গফুর আলম বাইট্টা, আমির হোসেন অন্যতম। এদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে বাস স্টেশনকেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক বেবিট্যাক্সি (সিএনজি) চালক। এরা ট্যাক্সিতে অপহৃতদের উঠিয়ে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়।
২০ সিন্ডিকেট : অনুসন্ধানে জানা আরও জনা গেছে, টেকনাফ থেকে সারা দেশজুড়ে ২০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মানব পাচার পরিচালিত হয়ে আসছে। সারা দেশে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে যুক্ত রয়েছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গডফাদাররা। এসব দালাল সিন্ডিকেট কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়া-মহেষখালী-চকরিয়া-চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ১০টি মানব পাচার ঘাট আলাদাভাবে পরিচলানা করে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্কে কাজ করছে সহস্রাধিক দালাল। কাটাবুনিয়া, কচুবনিয়া ও হারিয়াখালী এলাকার মানব পাচারকারীরা সাধারণত কাটাবুনিয়া ঘাট ব্যবহার করে। দুর্গম এলাকা ও যাতায়াত সমস্যার কারণে এই অঞ্চলে সহজেই পৌঁছতে পারে না আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্যরা। এই ঘাট দিয়েই প্রতি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানব পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে ঘাটটি ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’- নামে সবার কাছে পরিচিত।
সিন্ডিকেটে যারা : ১. সাবরাং কচুবনিয়া এলাকার নজির আহমদ (ডাকাত নজির-আজম উল্লাহর নেতৃত্বে চলে কাটাবুনিয়া ঘাট। এক সময় গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ে। থাইল্যান্ডের গডফাদারদের সঙ্গে রয়েছে তার সরাসরি যোগাযোগ। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযান চলাকালে নজির থাইল্যান্ডে গিয়ে আত্মগোপন করে। ২. রমজান-হামিদ-ফিরুজ সিন্ডিকেট : হামিদ ও রমজান মালয়েশিয়া অবস্থান করে পাচার নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে। এরা কচুবনিয়া এলাকার আবদুল খালেকের পুত্র। এক সময় দিনমজুর থাকলেও এরা এখন কোটি টাকার মালিক। সাবরাং, টেকনাফ-কক্সবাজার-নয়াপাড়ায় নামে-বেনামে রয়েছে তাদের কোটি টাকার সম্পদ। ৩. কচুবনিয়ার মোজাফফর আহমদের পুত্র গুরা মিয়া নেতৃত্ব দেন একটি সিন্ডিকেটের ৪. হারিয়াখালী এলাকার নুর আহমদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন পরিচালনা করে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে অর্ধশত ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। ৫. শওকত-আলমগীর-জাহাঙ্গীর- এই তিন সহোদর নেতৃত্ব দেন একটি সিন্ডিকেটের। তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা গ্রেফতার অথবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের মুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে পুলিশকে অ্যাসল্ট করার মামলাসহ কয়েক ডজন মানব পাচারের মামলা। তারা এলাকায় কাউকে পরোয়া করে না। ৬. একটি সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে সৈয়দুর রহমানের ছেলে মৌলভী সালামত উল্লাহ ও কালুর ছেলে বাদ কোম্পানি। ৭. শফিক সিন্ডিকেট : টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদারবিল এলাকার মো. শফিক। তার ভাই জাহাঙ্গীর থাকে মালয়েশিয়ায়। দুই ভাই মিলে কাটাবুনিয়া ঘাট ব্যবহার করে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে।
শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া ঘাটকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট
৮. ধলু হোসেন-বেলাল সিন্ডিকেট : ধলু হোসেন মানব পাচারের গডফাদার হিসাবে পরিচিত। তার রয়েছে কয়েক ডজন মামলা। ধলু হোসনের পুত্র বেলাল। বাপ-বেটা মিলে এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। শাহপরীর দ্বীপ বাজার পাড়ায় বসে এরা মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। ৯. শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার হাজী সালেহ আহমদের দ্ইু ছেলে ইসমাঈল-জিয়াবুলের নেতৃত্বে আছে একটি মানব পাচার সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে রয়েছে কয়েক ডজন মামলা। ১০. মো. আইয়াজ-লম্বা সেলিম : আইয়াজের পিতা মীর আহমদ, লম্বা সেলিমের পিতা মো. হাশিম। শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া দিয়ে এরা মানব পাচার করে থাকে। ১১. ফিরুজ : শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ার আবু শামার পুত্র ফিরুজ। পশ্চিম সৈকতে রাত নামলেই সবকিছু ফিরুজের কথামতো চলে। একাই সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। এই সিন্ডিকেটে শতাধিক সদস্য রয়েছে। ১২. সৈয়দ-জিয়াবুল সিন্ডিকেট : মৃত নজির আহমদের ছেলে। রাজনৈতিক পরিবার হওয়ায় এদের রয়েছে বিরাট প্রভাব প্রতিপত্তি। এরা মিয়ানমার আদম ঘাটও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ১৩. ফয়েজ উল্লাহ মাঝি সিন্ডিকেট : শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ায় বসে এই সিন্ডিকেট পাচারে যাবতীয় কাজ চালিয়ে থাকে।
কুয়ানছড়িপাড়া ঘাট : ১৪. এজাহার মাঝি ও মাজেদ মাঝি সিন্ডিকেট। মৃত আমির হোসেনের পুত্র এজাহার মাঝি আবদুল জব্বারের পুত্র মাজেদ মাঝি। তাদের ৪ ভাই থাকে মালয়েশিয়া। সেখান থেকে থাইল্যান্ডের দালালদের মাধ্যমে ট্রলার পাঠায় টেকনাফ উপকূলে। এছাড়া কুয়ানছড়িপাড়া ঘাটকেন্দ্রিক অন্য সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে ১৫. জাহেদ হোসেন পুতিক্কা-আমান উল্লাহ সিন্ডিকেট, ১৬. সলিম উল্লাহ-সিরাজ সিন্ডিকেট। আর সাবরাংয়ের মুন্ডার ডেইলঘাট ব্যবহার করে মানব পাচার করে ১৭. নুরুল আলম নুরু ও শাকের মাঝি সিন্ডিকেট। কবির আহমদের পুত্র সাকের মাঝি, নাজির হোসেনের পুত্র নুরুল আলম নুরু। পুলিশের হাতে আটক হয়ে সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসে। এদের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করে মুন্ডার ডেইল এলাকার জহির মেম্বারের ছেলে রব্বানী ও মাস্টার সৈয়দ আহমদের ছেলে দানু। নুরুর মাধ্যমে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে শত শত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে আটক হয়ে জেল খেটে ফেরত এসেছে ২৬ জন। চলতি বছরের ২৬ মার্চ বিজিবির মাধ্যমে তাদের পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হয়। যারা ফেরত এসেছে তারা জানিয়েছেন, তারা ২০ মাস কারাভোগের পর ছাড়া পেয়ে দেশে আসতে পেরেছেন। তারা নুরুর নেটওয়ার্কে ৮৩ জন যাত্রীসহ তাদের বহনকারী মালয়েশিয়াগামী ট্রলার বঙ্গোপসাগরের অদূরে বিকল হয়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।
সিন্ডিকেট ১৮. টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উপকূলীয় হাবিরছড়া নৌঘাট ব্যবহার করে শফিক আহমদের পুত্র মো. হোসেন প্রকাশ লম্বা হোসেন। হোসেনের ভাই নুরুল আমিন, মীর আহমদের পুত্র সরোয়ার। রাজারছড়ার মৃত কালা মিয়ার পুত্র সিরাজ মিয়া। মিঠাপানির ছড়ার মোতায়াল্লীর পুত্র মো. আলী।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক ২টি সিন্ডিকেট : টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিঃ ক্যাম্প ও লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক দুটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে মানব পাচারে জড়িত রয়েছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের এনে ক্যাম্পে জড়ো করে পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে নাফ নদী হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষে তাদের মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তুলে দেয়। আবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও তারা লোক সংগ্রহ করে থাকে। জাদিমুড়া নৌঘাটকে এরা যাতায়াতে ব্যবহার করে। সিন্ডিকেট দুটি আলাদাভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমান উল্লাহ আনু ও হাফেজ আইয়ুব ও নুর মোহাম্মদ মাঝি।
অর্থ আদান-প্রদানে হুন্ডি ও বিকাশ : সাধারণত হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়া মানব পাচারের অর্থ আদান-প্রদান হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক হুন্ডি চক্র এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া টেকনাফের বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে হুন্ডি চক্রের একাধিক অ্যাকাউন্ট। নারীদের নামে অ্যাকাউন্ট করে এরা টাকা লেনদেন করে। প্রতিদিন শত শত নারী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে। এর অধিকাংশই মানব পাচারের টাকা। আবার বিকাশের মাধ্যমেও মানব পাচারের বড় একটি অংক লেনদেন হয়। বিকাশ এজেন্টরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একাধিক সিম ব্যবহার করে পাচারের এই অর্থ লেনদেন করেন। আবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার দালালদের কাছে সেই অর্থ প্রেরণের জন্য ব্যবহার করা হয় হুন্ডি। এই হুন্ডি চক্রের মধ্যে টেকনাফ জালিয়াপাড়ার জাফর প্রকাশ টিটি জাফর রয়েছে শীর্ষে। এছাড়া টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়া মো. আনোয়ার, টেকনাফ লামার বাজারের জলিল প্রকাশ বার্মাইয়া হুন্ডি জলিল, টেকনাফ ডেইলপাড়ার কালা মোহাম্মদ আলির ছেলে মো. আমিন তার ভাই নুরুল আমিন ও সৈয়দ আমিন। এছাড়া রয়েছে, কুলালপাড়ার মৃত আলী আহমদের পুত্র কাদের ও ভেক্কু, বাজার পাড়ার বাট্টা আইয়ুব ও তার ভাই বাট্টা ইউনুচ, হ্নীলা পুরাতন বাজার এলাকার নির্মল ধর- এরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে মানব পাচার ও ইয়াবার অর্থ লেনদেন করে।
বিজিবির টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, টেকনাফ থেকে সমুদ্র পথে দালাল চক্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের নাগরিকদের অবৈধভাবে মায়য়েশিয়া পাচার করে থাকে। সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া গমনের রুটগুলোর মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের ‘খুরের মুখ’ অন্যতম। এখানে একটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোক্তার হোসেন জানান, চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ৩১টি মামলা করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। এসব মামলায় ৮০ জনের অধিক পাচারকারীকে আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিজিবি-কোস্টগার্ড ও পুলিশ সর্বমোট ১১৪টি মামলা করেছে। এ পর্যন্ত আটক হয়েছে ১১৩ জন মানব পাচারকারী। মামলাগুলোর আসামির সংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে আড়াইশ’ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করেছে পুলিশ। এছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১ হাজারের অধিক ভিকটিমকে।
যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন কৌশলে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে ফেরত আসা বেশ ক’জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডার ডেইল এলাকার নূরুল ইসলামের ছেলে কামাল হোসেন দুঃস্বপ্নের কথা মনে করে এখনও শিউড়ে ওঠেন। রোমহর্ষক সেসব দিনের কথা এখন আর মনে করতে চান না তিনি। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে একদিন বিদেশে যাওয়ার আশায় দালালদের প্রলোভনে পড়েছিলেন এই যুবক। কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে সাবরাং কাটাবুনিয়া থেকে আরও অনেকের সঙ্গে প্রথমে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি সাগরে অপেক্ষমাণ একটি বড় ট্রলারে উঠি। ট্রলারটি আট দিন সাগরে চলার পর থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছাই। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় নির্যাতনের পালা।’ কামাল হোসেনের মতো দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন একই এলাকার জাফর আলমের ছেলে আবুল মঞ্জুর, শাহাব মিয়ার ছেলে সিরাজ মিয়া, লম্বরীর ইমাম হোসেন, কেরুনতলীর মো. আলী। তাদের একেকজনের প্রতারিত হওয়ার কাহিনী একেক রকম। তবে সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছানোর পর বন্দিশালায় নির্যাতনের কাহিনী প্রায় একই রকম।
কামাল হোসেন আরও জানান, দালালদের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার যাদের পরিবার টাকা পরিশোধ করতে পারে না, তাদের দীর্ঘদিন বন্দি রেখে চালানো হয় নির্যাতন। অনেককে হত্যাও করা হয়।
হতভাগ্য যুবকদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখে কামাল হোসেন নিজেকে খানিকটা ভাগ্যবান মনে করেন। কেননা যথারীতি থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছার পর টেকনাফের দালালদের হাতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে দিতে পেরেছিল তার পরিবার। ফলে তাকে থাইল্যান্ড সীমান্ত অতিক্রম করে মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে ঢুকিয়ে দেয় দালালরা। কামাল বলেন, সেখানে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার পর লোকালয়ে প্রবেশ করেন কাজের সন্ধানে। অবৈধ হওয়ায় সেখানে ছিল পুলিশের কাছে ধরা পড়ার ভয়। কাজ শেষ করে রাতে আবার ফিরে যেতে হতো জঙ্গলে। এভাবে এক বছর কাটানোর পর পোকামাকড়ের কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে দালালদের মাধ্যমে দেশে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমান ভাড়াসহ ফিরে আসার খরচ পাঠানো হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কামাল হোসেন জানান, তার মতো অনেকে ফিরে আসতে না পেরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্য থেকে শতাধিক কর্মী উদ্ধার হওয়ার পর জানা যায় রোমহর্ষক নানা কাহিনী। মানব পাচারের আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষকে জড়ো করেছিল ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট। এক সময় শুধু কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দালালরা সিন্ডিকেটের হাতে কর্মীদের তুলে দিত। কিন্তু এখন গোটা বাংলাদেশ থেকে দালালরা পাচারের উদ্দেশ্যে যুবকদের সংগ্রহ করে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপসহ উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে ট্রলারে করে লোক পাচার করে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পাচারের ঘটনা মনিটর করে ‘আরাকান প্রজেক্ট’ নামের একটি সংস্থা। তাদের হিসাবে, ২০০৮ সালে ট্রলারযোগে পাচার হয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার। ২০০৯-২০১০ সালে পাচার হয়েছে এক হাজারেরও কম। এটি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় ২০১২ সালে। ওই বছরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাচার হয় প্রায় ২০,০০০ হাজার। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার অবৈধ বাংলাদেশীকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করেছে কিংবা দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যেই থাইল্যান্ডের পুলিশ পাচারের অনেক নৌকা ফেরত পাঠানো শুরু করেছে। মাঝপথে ইঞ্জিন নৌকার তেল ফুরিয়ে গেলে সাগরে ডুবে যাওয়ায় অনেকে মারা গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৫ সালের দিকে ফয়েজ উল্লাহ মাঝি ও ধলু হোসেনের নেতৃত্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে ফিশিং বোটে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার শুরু হয়। এরপর রশিদ উল্লাহ মাঝি, পোয়া মাঝি, নবী হোসেন মাঝি, আইয়ুব আলী মাঝি, এজাহার মাঝির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে মালয়েশিয়ায় পাচার সম্প্রসারিত হতে থাকে। এরাই মূলত বঙ্গপোসাগরে ৭-৮ দিন ফিশিং ট্রলার চালিয়ে শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে থাইল্যান্ড উপকূলে অবৈধ অভিবাসীদের নামিয়ে দিয়ে আসত। সেখান থেকে পাচারকারী সিন্ডিকেটের অন্য দল তাদের গ্রহণ করত। থাইল্যান্ড থেকে প্রথম দিকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দিতে জনপ্রতি নগদে ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো আদায় করত। একেকটি ট্রলারের আয়তন অনুযায়ী ১০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত যাত্রী এভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছে যেত। এখন টেকনাফ ছাড়িয়ে সারা বাংলাদেশে দালালের সংখ্যা শত শত।
স্থানীয় পর্যায়ের পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা জনান, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে মানবপাচার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, স্থানীয় জনগণের মধ্যে পাচারবিরোধী মনোভাব না থাকা এবং দালালদের আটক করতে না পারাতেই মূলত দিন দিন বেড়ে চলেছে মানব পাচার। এছাড়া জলসীমা প্রায় অরক্ষিত থাকায় সমুদ্রপথকে বেছে নিচ্ছে পাচারকারীরা। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ান সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ এবং ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে মানবপাচার চক্রকে আইনের আওতায় আনা, নৌপুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন, স্বেচ্ছায় যারা অবৈধপথে মালয়েশিয়ায় গমন করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনা এবং দালালদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে মানবপাচার কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘মানব পাচার একক কোনো দেশের উদ্যোগে বন্ধ করা সম্ভব নয়। মানব পাচারের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় সিন্ডিকেট জড়িত থাকে। ফলে যে দেশ থেকে, যে দেশের মধ্য দিয়ে এবং যে দেশের গন্তব্যে মানব পাচার হয়ে থাকে সেই দেশগুলোর মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগে সমুদ্রপথে মানব পাচার বন্ধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি’।
মানব পাচার রোধে নানা বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। এর নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী যুগান্তরকে বললেন, সমুদ্রপথে মানব পাচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু এটি প্রয়োগ হয় না। মানব পাচারের পেছনে সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া মানব পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাচারে আধুনিক ট্রলার : এক সময় ছোট ছোট ফিশিং ট্রলারে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার শুরু হলেও এখন ওই সব ট্রলার ব্যবহার করা হয় না। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বড় আকারের আধুনিক ট্রলার। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী গডফাদাররা এ দেশের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দেয় আধুনিক সুযোগসুবিধা সংবলিত এসব ট্রলার। থাইল্যান্ডের নাগরিকদের মালিকানাধীন এসব ট্রলারের একেকটিতে ৫০০ থেকে এক হাজার পর্যন্ত লোক ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ট্রলারগুলো থাইল্যান্ড উপকূল থেকে ছেড়ে এসে বাংলাদেশের জলসীমায় সেন্টমার্টিনের প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে মৌলভীর শীল নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকে। আঁধার ঘনিয়ে এলে ট্রলারগুলো আস্তে আস্তে মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি চলে আসে। তখন রাতের আঁধারে টেকনাফ-উখিয়া-কক্সবাজারের উপকূলীয় নৌঘাটগুলোতে হুলস্থূল পড়ে যায়। শুরু হয় ছোটাছুটি। দালালদের সহায়তায় শত শত লোক তখন ছোট ছোট ফিশিং ট্রলারে করে ছুটে বঙ্গপোসাগরে অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারগুলোর দিকে। মানব পাচারকারীদের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ মোবাইল নেটওয়ার্ক। সাগরে অপেক্ষমাণ ট্রলারের অবস্থান থেকে শুরু করে কোন্ ঘাট দিয়ে ক’টি ছোট ট্রলারে কতজন আদম নিয়ে রওয়ানা হয়েছে তা স্থনীয় সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে জেনে যাচ্ছে।
অপহরণ চক্র : টেকনাফে মানব পাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি অপহরণকারী চক্র। এরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যেতে আসা লোকদের অপহরণ করে থাকে। এক দালালের মাধ্যমে টেকনাফে আসা লোকদের এরা অপহরণ করে অন্য দালালের হাতে তুলে দেয়। এই চক্রের সদস্যরা যে কোনো লোককে অপহরণ করে দালালের কাছে পৌঁছে দিলেই জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পেয়ে যায়। ফলে লাভজনক এই অপহরণ ব্যবসায় নেমে পড়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এরা প্রথমে ওতপেতে থাকে টেকনাফ বাস স্টেশনে। এখানে নাইট কোচগুলো চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে খুব ভোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই বেবিট্যাক্সি, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে মালয়েশিয়াগামীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোনো কোনো সময় অপহরণের শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়া যেতে না চাওয়া লোকজনও। এক্ষেত্রে টেকনাফে কাজের সন্ধানে আসা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক অপহরণ করে দালালদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দালালরা তাদের হাত-পা বেঁধে তুলে দেয় মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে। পরে থাইল্যান্ড পৌঁছার পর পরিবারকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করতে হয় তাদের। কিছুদিন আগে টেকনাফে মোবাইল টাওয়ারের কাজ করতে আসা বাংলালিংকের এক ইঞ্জিনিয়ারকে সাবরাং এলাকা থেকে তারা অপহরণ করে মালয়েশিয়ার ট্রলারে পৌঁছে দিয়েছিল। পরে মিডিয়া ও প্রশাসনের চাপে পড়ে সেই ব্যক্তিকে কক্সবাজারের মহেষখালী থেকে ফেরত দিতে বাধ্য হয় পাচারকারীরা। এছাড়া ২২ অক্টোবর টেকনাফে ভোলার এক যুবককে দিন-দুপুরে অপহরণকালে জনতা এক অপহরণকারীকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে। অপহরণকারী চক্রের মধ্যে রয়েছে লেঙ্গুরবিল এলাকার ডাকাত মোস্তাকের নেতৃত্বে একটি গ্র“প, কায়ুকখালী পাড়া এলাকার চোরা সাইফুলের নেতৃত্বে অপর একটি গ্র“প। এছাড়া, গোদারবিল এলাকার সাদ্দাম, শামসু, তারেক, গফুর আলম বাইট্টা, আমির হোসেন অন্যতম। এদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে বাস স্টেশনকেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক বেবিট্যাক্সি (সিএনজি) চালক। এরা ট্যাক্সিতে অপহৃতদের উঠিয়ে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়।
২০ সিন্ডিকেট : অনুসন্ধানে জানা আরও জনা গেছে, টেকনাফ থেকে সারা দেশজুড়ে ২০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মানব পাচার পরিচালিত হয়ে আসছে। সারা দেশে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে যুক্ত রয়েছে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গডফাদাররা। এসব দালাল সিন্ডিকেট কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়া-মহেষখালী-চকরিয়া-চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ১০টি মানব পাচার ঘাট আলাদাভাবে পরিচলানা করে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্কে কাজ করছে সহস্রাধিক দালাল। কাটাবুনিয়া, কচুবনিয়া ও হারিয়াখালী এলাকার মানব পাচারকারীরা সাধারণত কাটাবুনিয়া ঘাট ব্যবহার করে। দুর্গম এলাকা ও যাতায়াত সমস্যার কারণে এই অঞ্চলে সহজেই পৌঁছতে পারে না আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্যরা। এই ঘাট দিয়েই প্রতি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানব পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে ঘাটটি ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’- নামে সবার কাছে পরিচিত।
সিন্ডিকেটে যারা : ১. সাবরাং কচুবনিয়া এলাকার নজির আহমদ (ডাকাত নজির-আজম উল্লাহর নেতৃত্বে চলে কাটাবুনিয়া ঘাট। এক সময় গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ে। থাইল্যান্ডের গডফাদারদের সঙ্গে রয়েছে তার সরাসরি যোগাযোগ। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযান চলাকালে নজির থাইল্যান্ডে গিয়ে আত্মগোপন করে। ২. রমজান-হামিদ-ফিরুজ সিন্ডিকেট : হামিদ ও রমজান মালয়েশিয়া অবস্থান করে পাচার নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে। এরা কচুবনিয়া এলাকার আবদুল খালেকের পুত্র। এক সময় দিনমজুর থাকলেও এরা এখন কোটি টাকার মালিক। সাবরাং, টেকনাফ-কক্সবাজার-নয়াপাড়ায় নামে-বেনামে রয়েছে তাদের কোটি টাকার সম্পদ। ৩. কচুবনিয়ার মোজাফফর আহমদের পুত্র গুরা মিয়া নেতৃত্ব দেন একটি সিন্ডিকেটের ৪. হারিয়াখালী এলাকার নুর আহমদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন পরিচালনা করে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে অর্ধশত ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। ৫. শওকত-আলমগীর-জাহাঙ্গীর- এই তিন সহোদর নেতৃত্ব দেন একটি সিন্ডিকেটের। তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা গ্রেফতার অথবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের মুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে পুলিশকে অ্যাসল্ট করার মামলাসহ কয়েক ডজন মানব পাচারের মামলা। তারা এলাকায় কাউকে পরোয়া করে না। ৬. একটি সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে সৈয়দুর রহমানের ছেলে মৌলভী সালামত উল্লাহ ও কালুর ছেলে বাদ কোম্পানি। ৭. শফিক সিন্ডিকেট : টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদারবিল এলাকার মো. শফিক। তার ভাই জাহাঙ্গীর থাকে মালয়েশিয়ায়। দুই ভাই মিলে কাটাবুনিয়া ঘাট ব্যবহার করে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে।
শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া ঘাটকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট
৮. ধলু হোসেন-বেলাল সিন্ডিকেট : ধলু হোসেন মানব পাচারের গডফাদার হিসাবে পরিচিত। তার রয়েছে কয়েক ডজন মামলা। ধলু হোসনের পুত্র বেলাল। বাপ-বেটা মিলে এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। শাহপরীর দ্বীপ বাজার পাড়ায় বসে এরা মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। ৯. শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার হাজী সালেহ আহমদের দ্ইু ছেলে ইসমাঈল-জিয়াবুলের নেতৃত্বে আছে একটি মানব পাচার সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে রয়েছে কয়েক ডজন মামলা। ১০. মো. আইয়াজ-লম্বা সেলিম : আইয়াজের পিতা মীর আহমদ, লম্বা সেলিমের পিতা মো. হাশিম। শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া দিয়ে এরা মানব পাচার করে থাকে। ১১. ফিরুজ : শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ার আবু শামার পুত্র ফিরুজ। পশ্চিম সৈকতে রাত নামলেই সবকিছু ফিরুজের কথামতো চলে। একাই সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। এই সিন্ডিকেটে শতাধিক সদস্য রয়েছে। ১২. সৈয়দ-জিয়াবুল সিন্ডিকেট : মৃত নজির আহমদের ছেলে। রাজনৈতিক পরিবার হওয়ায় এদের রয়েছে বিরাট প্রভাব প্রতিপত্তি। এরা মিয়ানমার আদম ঘাটও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ১৩. ফয়েজ উল্লাহ মাঝি সিন্ডিকেট : শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ায় বসে এই সিন্ডিকেট পাচারে যাবতীয় কাজ চালিয়ে থাকে।
কুয়ানছড়িপাড়া ঘাট : ১৪. এজাহার মাঝি ও মাজেদ মাঝি সিন্ডিকেট। মৃত আমির হোসেনের পুত্র এজাহার মাঝি আবদুল জব্বারের পুত্র মাজেদ মাঝি। তাদের ৪ ভাই থাকে মালয়েশিয়া। সেখান থেকে থাইল্যান্ডের দালালদের মাধ্যমে ট্রলার পাঠায় টেকনাফ উপকূলে। এছাড়া কুয়ানছড়িপাড়া ঘাটকেন্দ্রিক অন্য সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে ১৫. জাহেদ হোসেন পুতিক্কা-আমান উল্লাহ সিন্ডিকেট, ১৬. সলিম উল্লাহ-সিরাজ সিন্ডিকেট। আর সাবরাংয়ের মুন্ডার ডেইলঘাট ব্যবহার করে মানব পাচার করে ১৭. নুরুল আলম নুরু ও শাকের মাঝি সিন্ডিকেট। কবির আহমদের পুত্র সাকের মাঝি, নাজির হোসেনের পুত্র নুরুল আলম নুরু। পুলিশের হাতে আটক হয়ে সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসে। এদের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করে মুন্ডার ডেইল এলাকার জহির মেম্বারের ছেলে রব্বানী ও মাস্টার সৈয়দ আহমদের ছেলে দানু। নুরুর মাধ্যমে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে শত শত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে আটক হয়ে জেল খেটে ফেরত এসেছে ২৬ জন। চলতি বছরের ২৬ মার্চ বিজিবির মাধ্যমে তাদের পরিবারের মাঝে হস্তান্তর করা হয়। যারা ফেরত এসেছে তারা জানিয়েছেন, তারা ২০ মাস কারাভোগের পর ছাড়া পেয়ে দেশে আসতে পেরেছেন। তারা নুরুর নেটওয়ার্কে ৮৩ জন যাত্রীসহ তাদের বহনকারী মালয়েশিয়াগামী ট্রলার বঙ্গোপসাগরের অদূরে বিকল হয়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।
সিন্ডিকেট ১৮. টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উপকূলীয় হাবিরছড়া নৌঘাট ব্যবহার করে শফিক আহমদের পুত্র মো. হোসেন প্রকাশ লম্বা হোসেন। হোসেনের ভাই নুরুল আমিন, মীর আহমদের পুত্র সরোয়ার। রাজারছড়ার মৃত কালা মিয়ার পুত্র সিরাজ মিয়া। মিঠাপানির ছড়ার মোতায়াল্লীর পুত্র মো. আলী।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক ২টি সিন্ডিকেট : টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিঃ ক্যাম্প ও লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক দুটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে মানব পাচারে জড়িত রয়েছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের এনে ক্যাম্পে জড়ো করে পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে নাফ নদী হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষে তাদের মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তুলে দেয়। আবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও তারা লোক সংগ্রহ করে থাকে। জাদিমুড়া নৌঘাটকে এরা যাতায়াতে ব্যবহার করে। সিন্ডিকেট দুটি আলাদাভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে আমান উল্লাহ আনু ও হাফেজ আইয়ুব ও নুর মোহাম্মদ মাঝি।
অর্থ আদান-প্রদানে হুন্ডি ও বিকাশ : সাধারণত হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়া মানব পাচারের অর্থ আদান-প্রদান হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক হুন্ডি চক্র এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া টেকনাফের বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে হুন্ডি চক্রের একাধিক অ্যাকাউন্ট। নারীদের নামে অ্যাকাউন্ট করে এরা টাকা লেনদেন করে। প্রতিদিন শত শত নারী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে। এর অধিকাংশই মানব পাচারের টাকা। আবার বিকাশের মাধ্যমেও মানব পাচারের বড় একটি অংক লেনদেন হয়। বিকাশ এজেন্টরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একাধিক সিম ব্যবহার করে পাচারের এই অর্থ লেনদেন করেন। আবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার দালালদের কাছে সেই অর্থ প্রেরণের জন্য ব্যবহার করা হয় হুন্ডি। এই হুন্ডি চক্রের মধ্যে টেকনাফ জালিয়াপাড়ার জাফর প্রকাশ টিটি জাফর রয়েছে শীর্ষে। এছাড়া টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়া মো. আনোয়ার, টেকনাফ লামার বাজারের জলিল প্রকাশ বার্মাইয়া হুন্ডি জলিল, টেকনাফ ডেইলপাড়ার কালা মোহাম্মদ আলির ছেলে মো. আমিন তার ভাই নুরুল আমিন ও সৈয়দ আমিন। এছাড়া রয়েছে, কুলালপাড়ার মৃত আলী আহমদের পুত্র কাদের ও ভেক্কু, বাজার পাড়ার বাট্টা আইয়ুব ও তার ভাই বাট্টা ইউনুচ, হ্নীলা পুরাতন বাজার এলাকার নির্মল ধর- এরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে মানব পাচার ও ইয়াবার অর্থ লেনদেন করে।
বিজিবির টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, টেকনাফ থেকে সমুদ্র পথে দালাল চক্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের নাগরিকদের অবৈধভাবে মায়য়েশিয়া পাচার করে থাকে। সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া গমনের রুটগুলোর মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের ‘খুরের মুখ’ অন্যতম। এখানে একটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোক্তার হোসেন জানান, চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ৩১টি মামলা করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। এসব মামলায় ৮০ জনের অধিক পাচারকারীকে আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিজিবি-কোস্টগার্ড ও পুলিশ সর্বমোট ১১৪টি মামলা করেছে। এ পর্যন্ত আটক হয়েছে ১১৩ জন মানব পাচারকারী। মামলাগুলোর আসামির সংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে আড়াইশ’ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করেছে পুলিশ। এছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১ হাজারের অধিক ভিকটিমকে।
No comments