ছাত্রলীগের রাজনীতি : অতীত ও বর্তমান by মোয়াজ্জেম হোসেন
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতিতে প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের মূল দাবি নিয়েই আন্দোলন হতো। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং বাঙালিদের ন্যায্য হিস্যা দিতে অনীহা প্রকাশ করায় জাগ্রত ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পাকিস্তানি শাসকদের এহেন বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ছাত্র-জনতার ঐক্যের সোপান গড়ে তুলেছিল। ষাটের দশকে অনেক ছাত্র সংগঠন ছিল, যার বেশিরভাগই সাধারণ মানুষের মনমানসিকতার কথা চিন্তা না করে বিদেশী ভাবধারার রাজনীতি এদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তখন রাজপথে ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’।
ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে অন্য ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির গুণগত পার্থক্য ছিল। ছাত্রলীগের রাজনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। আর অন্য ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হতো। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ত্রিধাবিভক্ত হয়ে মস্কো, পিকিংপন্থীসহ বিদেশী ভাবধারায় রাজনীতি করেছে। তারা সমাজতন্ত্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে মাত্র।
পাকিস্তানি শাসকচক্র সে সময়ে ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের নীলনকশা হাসিল করতে চেয়েছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিল বিধায় তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লোভ-লালসার কাছে মাথানত করেননি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সুসংহতভাবে চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হতো। কোনো প্রলোভন ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারেনি। আইয়ুব-মোনায়েম শাসন যুগে টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে ভুল পথে পরিচালিত করার অনেক চেষ্টা চালিয়েও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করার পর আওয়ামী লীগে মতবিরোধ দেখা দেয়। অনেক নেতা দলত্যাগ করে ৬ দফার বিরুদ্ধাচরণ করেন। ছাত্রলীগই একমাত্র সংগঠন যারা সর্বপ্রথম ৬ দফার প্রতি সমর্থন দিয়ে কাজ শুরু করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ৬ দফার প্রচার শুরু করেছিল। বাঙালির স্বার্থে আপসহীন মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা প্রচারে তৎকালীন প্রতিটি জেলায় উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আমার হাতেগড়া ছাত্রলীগ যখন বাঙালির ৬ দফার পক্ষে, নির্যাতন উপেক্ষা করে প্রচার অভিযানের অগ্রযাত্রী, তখন আমার আর কোনো ভয় নেই।
বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রতিটি জায়গায় ছাত্রলীগের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও ভরসার জায়গা ছিল ছাত্রলীগ। তাই তিনি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রলীগকে বেছে নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্য থেকে ‘স্বাধীনতা নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের অনন্য ভূমিকার মূলে ছিল তাদের সততা, একাগ্রতা, সর্বোপরি লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকা। সত্যের মাপকাঠিতে স্বাধীনতাপূর্ব ছাত্রলীগ ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ছাত্রলীগের এ ভূমিকা চির উজ্জ্বল ও চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
ষাটের দশকে ছাত্রলীগের কর্মীদের মেধার যোগ্যতায় নেতৃত্বের সঠিক আসনে বসানো হতো। সে সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যারা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সংগঠনকে সুসংগঠিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেন- রফিকুল্লাহ চৌধুরী সভাপতি ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সাধারণ সম্পাদক, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক, কেএম ওবায়দুর রহমান সভাপতি ও সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক, ফেরদৌস আহম্মেদ কোরেশী সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ মোযহারুল হক বাকী সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক, আবদুর রউফ সভাপতি ও খালেক মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক, তোফায়েল আহমেদ সভাপতি ও আসম আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক, নূর-ই-আলম সিদ্দিকী সভাপতি ও মো. শাহজাহান সিরাজ সাধারণ সম্পাদক।
বর্তমান ছাত্রলীগ যেন ক্ষয়িষ্ণু এক ছাত্র সংগঠন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ও যোগ্যতার পারদ রাজনীতির ব্যারোমিটারে নিুগামী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের উত্তরণ ঘটাতে হবে। প্রায় একযুগ ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হওয়ার পর তাদের মধ্যে টাকা, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি করার প্রবণতা বাড়ছে। ছাত্রদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াসহ জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার চেয়ে নিজেদের আখের গোছাতেই যেন তারা বেশি ব্যস্ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে পাকিস্তান আমলে ‘ইডেন মহাবিদ্যালয় ছাত্রী সংসদে’ ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে নয়, শেখ হাসিনা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সাধারণ ছাত্রীদের মন জয় করে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
স্বাধীনতাপূর্ব কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ হাতেগোনা নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা হতো এবং প্রয়োজনবোধে তিনি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিকনির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনা সংগঠনের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে যেত। বর্তমানে নিু পর্যায়ের একজন ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে তাদের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রতি অবজ্ঞাই প্রকাশ পায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঠনের কাজ থেকে দূরে থেকে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে লিপ্ত। ছাত্রলীগ একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল থেকে কাজ করে যাবেন, ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একদিন মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেবেন এটাই কাম্য। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, ছাত্রলীগ ছাড়ার পর অনেকে এক ধাপে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ফলে রাজনীতিতে মেধা ও যোগ্যতা যাচাই করা যায় না।
স্বাধীনতার আগে ছাত্র নেতৃত্ব শেষে যারা ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ সংগঠনে মহুকুমা ও জেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু যোগ্যতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যেসব নেতাকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেক নেতার নিজ জেলা বা থানায় গ্রহণযোগ্যতা খুব কম। কারণ তারা কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে নিজ জেলা বা থানার নেতৃত্বকে বাঁকা চোখে দেখেন এবং তাদের ওপর খবরদারি করার চেষ্টা করেন। ফলে নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। আজও জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এখনও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আওয়ামী লীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা জেলা ও থানা পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজকর্ম মনিটর করা থেকে বিরত থেকে তদবির ও চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। প্রতি স্তরে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোর আজ মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অন্ধকারের কবল থেকে সংগঠনগুলোকে বাঁচাতে হবে নেত্রীকেই।
আওয়ামী লীগের মূল সংগঠনের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন। যে দল ক্ষমতায় থাকে, ওই দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক ভূইফোঁড় সংগঠন জন্ম নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই ভূইফোঁড় সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে যাদের দেখা যায়, তারা বসন্তের কোকিল। ওরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় এসব সংগঠন গড়ে তোলেন। তাদের আদর্শগত কোনো চিন্তা নেই। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ওদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভূইফোঁড় সংগঠন সম্পর্কে সংগঠনের সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার।
ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন : আইনজীবী
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ছাত্র-জনতার ঐক্যের সোপান গড়ে তুলেছিল। ষাটের দশকে অনেক ছাত্র সংগঠন ছিল, যার বেশিরভাগই সাধারণ মানুষের মনমানসিকতার কথা চিন্তা না করে বিদেশী ভাবধারার রাজনীতি এদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তখন রাজপথে ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’।
ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে অন্য ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির গুণগত পার্থক্য ছিল। ছাত্রলীগের রাজনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। আর অন্য ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হতো। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ত্রিধাবিভক্ত হয়ে মস্কো, পিকিংপন্থীসহ বিদেশী ভাবধারায় রাজনীতি করেছে। তারা সমাজতন্ত্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে মাত্র।
পাকিস্তানি শাসকচক্র সে সময়ে ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের নীলনকশা হাসিল করতে চেয়েছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিল বিধায় তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লোভ-লালসার কাছে মাথানত করেননি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সুসংহতভাবে চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হতো। কোনো প্রলোভন ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারেনি। আইয়ুব-মোনায়েম শাসন যুগে টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে ভুল পথে পরিচালিত করার অনেক চেষ্টা চালিয়েও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করার পর আওয়ামী লীগে মতবিরোধ দেখা দেয়। অনেক নেতা দলত্যাগ করে ৬ দফার বিরুদ্ধাচরণ করেন। ছাত্রলীগই একমাত্র সংগঠন যারা সর্বপ্রথম ৬ দফার প্রতি সমর্থন দিয়ে কাজ শুরু করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ৬ দফার প্রচার শুরু করেছিল। বাঙালির স্বার্থে আপসহীন মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা প্রচারে তৎকালীন প্রতিটি জেলায় উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আমার হাতেগড়া ছাত্রলীগ যখন বাঙালির ৬ দফার পক্ষে, নির্যাতন উপেক্ষা করে প্রচার অভিযানের অগ্রযাত্রী, তখন আমার আর কোনো ভয় নেই।
বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রতিটি জায়গায় ছাত্রলীগের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও ভরসার জায়গা ছিল ছাত্রলীগ। তাই তিনি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রলীগকে বেছে নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্য থেকে ‘স্বাধীনতা নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের অনন্য ভূমিকার মূলে ছিল তাদের সততা, একাগ্রতা, সর্বোপরি লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকা। সত্যের মাপকাঠিতে স্বাধীনতাপূর্ব ছাত্রলীগ ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ছাত্রলীগের এ ভূমিকা চির উজ্জ্বল ও চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
ষাটের দশকে ছাত্রলীগের কর্মীদের মেধার যোগ্যতায় নেতৃত্বের সঠিক আসনে বসানো হতো। সে সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যারা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সংগঠনকে সুসংগঠিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেন- রফিকুল্লাহ চৌধুরী সভাপতি ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সাধারণ সম্পাদক, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক, কেএম ওবায়দুর রহমান সভাপতি ও সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক, ফেরদৌস আহম্মেদ কোরেশী সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ মোযহারুল হক বাকী সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক, আবদুর রউফ সভাপতি ও খালেক মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক, তোফায়েল আহমেদ সভাপতি ও আসম আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক, নূর-ই-আলম সিদ্দিকী সভাপতি ও মো. শাহজাহান সিরাজ সাধারণ সম্পাদক।
বর্তমান ছাত্রলীগ যেন ক্ষয়িষ্ণু এক ছাত্র সংগঠন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ও যোগ্যতার পারদ রাজনীতির ব্যারোমিটারে নিুগামী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের উত্তরণ ঘটাতে হবে। প্রায় একযুগ ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হওয়ার পর তাদের মধ্যে টাকা, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি করার প্রবণতা বাড়ছে। ছাত্রদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াসহ জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার চেয়ে নিজেদের আখের গোছাতেই যেন তারা বেশি ব্যস্ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে পাকিস্তান আমলে ‘ইডেন মহাবিদ্যালয় ছাত্রী সংসদে’ ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে নয়, শেখ হাসিনা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সাধারণ ছাত্রীদের মন জয় করে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
স্বাধীনতাপূর্ব কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ হাতেগোনা নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা হতো এবং প্রয়োজনবোধে তিনি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিকনির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনা সংগঠনের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে যেত। বর্তমানে নিু পর্যায়ের একজন ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে তাদের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রতি অবজ্ঞাই প্রকাশ পায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঠনের কাজ থেকে দূরে থেকে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে লিপ্ত। ছাত্রলীগ একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল থেকে কাজ করে যাবেন, ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একদিন মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেবেন এটাই কাম্য। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, ছাত্রলীগ ছাড়ার পর অনেকে এক ধাপে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ফলে রাজনীতিতে মেধা ও যোগ্যতা যাচাই করা যায় না।
স্বাধীনতার আগে ছাত্র নেতৃত্ব শেষে যারা ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ সংগঠনে মহুকুমা ও জেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু যোগ্যতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যেসব নেতাকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেক নেতার নিজ জেলা বা থানায় গ্রহণযোগ্যতা খুব কম। কারণ তারা কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে নিজ জেলা বা থানার নেতৃত্বকে বাঁকা চোখে দেখেন এবং তাদের ওপর খবরদারি করার চেষ্টা করেন। ফলে নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। আজও জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এখনও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আওয়ামী লীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা জেলা ও থানা পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজকর্ম মনিটর করা থেকে বিরত থেকে তদবির ও চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। প্রতি স্তরে আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোর আজ মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অন্ধকারের কবল থেকে সংগঠনগুলোকে বাঁচাতে হবে নেত্রীকেই।
আওয়ামী লীগের মূল সংগঠনের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন। যে দল ক্ষমতায় থাকে, ওই দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক ভূইফোঁড় সংগঠন জন্ম নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই ভূইফোঁড় সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে যাদের দেখা যায়, তারা বসন্তের কোকিল। ওরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় এসব সংগঠন গড়ে তোলেন। তাদের আদর্শগত কোনো চিন্তা নেই। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ওদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভূইফোঁড় সংগঠন সম্পর্কে সংগঠনের সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার।
ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন : আইনজীবী
No comments