এলজিইডির ক্ষমতাধর মাহবুব পার পেয়ে গেলেন!
এলজিইডির সদ্য বিদায়ী অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের অন্ত নেই। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ ও লিফলেট বিতরণ ছাড়াও অফিসিয়ালি বিস্তর তদন্ত প্রতিবেদন রয়েছে। নিজ দফতর থেকেই তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাপরিপন্থী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে একাধিক চার্জ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। আবার বেশ কিছু অভিযোগ এখনও পেন্ডিং রয়েছে। ওদিকে তদন্ত অনুসন্ধান শেষে দুদকের দুজন কর্মকর্তা আটটি বিষয়ে দুর্নীতির মামলা করার সুপারিশ করলেও তা ৩ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ক্ষমতা ও অর্থের নানা প্রভাববলয়ের কারণে মন্ত্রণালয় তথা সরকার মাহবুবুর রহমানের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে করে নিচের দিকে তার সারির দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
যত অভিযোগ : সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে উত্থাপিত বিস্তর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে এলজিইডির নিজস্ব তদন্ত ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আনীত ৫টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রথমত রয়েছে, ১৯৯৮ সালে মুন্সীগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে তিনি সড়ক ও কালভার্ট মেরামত কর্মসূচির অব্যয়িত ১ কোটি ৫ লাখ টাকা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিধিবহির্ভূতভাবে অন্য খাতে স্থানান্তর করেন। পরবর্তীকালে এই টাকা এলজিইডির সদর দফতর সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকে পরিশোধ করেন।
এ বিষয়ে মাহবুবুর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিলেও তা ধোপে টেকেনি। এলজিইডির এ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ নির্দেশিকার বিধানাবলী অনুসরণ না করে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমোদনে ভবন সম্প্রসারণ কাজ পল্লী অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খাতের আওতায় গ্রহণ করেছেন। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ জেলার এলজিইডির পল্লী সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজের অব্যয়িত উল্লেখিত টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে এলজিইডির সদর দফতর ভবনের ১২ তলার সম্প্রসারণ কাজে সম্পূর্ণ নিজ এখতিয়ারে নিয়োজিত ঠিকাদারকে পরিশোধ করেছেন, যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
প্রতিবেদনে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, এই কর্মকর্তা পরবর্তীকালে ঢাকা জেলার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন বিভিন্ন দফতরের অব্যয়িত ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৩০ টাকা একইভাবে সদর দফতর নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার মেসার্স আবুল কালাম পরিশোধ করেন। এই টাকার মধ্যে এলজিইডির নরসিংদী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, যশোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, এনআইএলজির সড়ক নির্মাণ বাবদ ঢাকা জেলা পরিষদের খাত থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা, অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের ৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ও পল্লী অবকাঠমো উন্নয়ন প্রকল্পের ১৩ লাখ টাকা। এ বিষয়ে এলজিইডি কর্তৃক উত্থাপিত চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এলজিইডি সদর দফতর ভবনের ১২ তলা সম্প্রসারণ কাজের মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬৮ লাখ টাকা। সাড়ে ৭% ঊর্ধ্বদরে ঠিকাদার আবুল কালামের দর ছিল ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু অভিযুক্ত মাহবুবুর রহমান প্রায় ৮০ লাখ টাকার নন-টেন্ডার আইটেম অন্তর্ভুক্ত করে মূল প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় পৌনে তিনগুণ দর বৃদ্ধি করেন। এতে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি টাকা। ওদিকে নিুমানের কাজ করায় নির্মাণের অল্প কিছুদিনের মধ্যে ছাদ দিয়ে পানি পড়া শুরু করে। অথচ এ বিষয়ে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তার পুরো বিল পরিশোধ করে দেন।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, সদর দফতরের ১২ তলার নির্মাণ কাজ অত্যন্ত নিুমানের হওয়ায় পরবর্তীকালে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-২৬ এর আওতায় প্রায় পৌনে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়। আর এতে করে মাহবুবুর রহমানের অদক্ষতা ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে সরকারের ২ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, তিনি ১৯৯৯ সালে ঢাকা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন মুন্সীগঞ্জের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ৫১ লাখ ২৯ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। এই টাকা থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই এলজিইডি ঢাকা অফিসের পূর্ত কাজের বিল, সদর দফতরের ৪টি লিফট সংস্কারে টাকা পরিশোধ করা হয়। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির অভিযোগপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ঢাকা কার্যালয়ের পূর্ত কাজের বিল পরিশোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদন না থাকায় আর্থিক অনিয়ম করেছেন।
এদিকে মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সুনির্দিষ্ট এসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে রহস্যজনক কারণে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক মাধব রায়। ২০১১ সালে তিনি এ মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব (প্রশাসন) থাকাবস্থায় তিনি ২৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের শেষ পৃষ্ঠায় প্রকারান্তরে মাহবুবুর রহমানের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে এ কথাও উল্লেখ করেন, এলজিইডির এসব বিভাগীয় অনিয়মের বিষয়ে দীর্ঘদিন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আনীত অভিযোগের অধিকাংশ বিভাগীয় অনিয়ম বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিস্তারিত তদন্তপূর্বক এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত কারণে তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
রোববার এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অশোক মাধব রায় যুগান্তরকে বলেন, মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত বেশ কিছু অভিযোগ তিনি অনেকদিন আগে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছেন। পুরো বিষয় তার এখন মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে যে, এটি ছিল অনিয়ম, কিন্তু দুর্নীতি নয়। তিনি এক খাতের টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে অন্য খাতে খরচ করেছেন।
এ বিষয়ে এলজিইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতির মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদকে চিঠি পাঠালেও সেখানেও সবকিছু ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, এর বাইরেও শৃঙ্খলাপরিপন্থী বিভিন্ন অভিযোগে সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগ এসেছে এলজিইডি থেকে। কিন্তু বারবারই তিনি পার পেয়ে গেছেন।
জানা গেছে, সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এলজিইডির সদর দফতরে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাবস্থায় তিনিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোড কাটিং ও অন্যান্য কয়েকটি কাজে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়ে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেয় ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট। এ রিপোর্টের শেষাংশে মন্তব্যের কলামে বলা হয়, রোড কাটিং ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ নিয়মানুযায়ী সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ২০০১-০২ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত এই খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়, যা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। ভাউচার বা কোটেশনের মাধ্যমে খুচরা জিনিসপত্র বা যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখিয়ে টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। পূর্ত কাজে ৬৩টি প্যাকেজে কোটেশন আহবানে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বনের কারণে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। যাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ ২৮ হাজার টাকার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সরকারি অর্থে কোনো কর্মকর্তার নামে এফডিআর করা, এ ধরনের তথ্য যথাসময়ে ক্যাশবহিতে লিপিবদ্ধ না করাসহ এ সংক্রান্ত ৯ মাসের সুদের হিসাব না রাখাও গুরুতর আর্থিক অনিয়ম প্রভৃতি।
লিফলেট : কিছুদিন আগে এলজিইডির সর্বস্তরের সাধারণ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর পক্ষ থেকে অফিস চত্বরে একটি লিফলেট ছাড়া হয়। সেখানে মাহবুবুর রহমানকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেয়ার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পত্তির কিছু খতিয়ানও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ফিলিং স্টেশন ও টিভি চ্যানেলের গোপন শেয়ারের মালিক, উত্তরা ৯নং সেক্টরে রাজিয়া ভিলা, মিরপুরের পাইকপাড়ায় ৬ তলা বাড়ি, খুলনা ও বরিশালে আরও বাড়ি থাকার কথা বলা হয়।
এদিকে ওপরে উল্লেখিত বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এক খাতের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করা একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ক্ষমতার আওতায় পড়ে না। তাই আমি এটি করিনি, যা কিছু হয়েছে তা নিয়ম মেনেই হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুদক যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে তদন্ত করেছে। এমনকি ৫ বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে তেমন কিছু পায়নি। তাই মামলাও করেনি।
এছাড়া তার বেনামে কোনো ফিলিং স্টেশন থাকলে সেটি যে দেখিয়ে দিতে পারবে আমি তাকে সেটি দিয়ে দেব। আর যে টিভিতে আমার মালিকানা রয়েছে বলে প্রচার করা হয় আসলে তা সত্য নয়। বাস্তব তথ্য হল, আমার বন্ধু ওই টেলিভিশনের মালিকদের একজন। আর আমার ঢাকায় বা গ্রামে কোনো বহুতল ভবন নেই।
প্রসঙ্গত, ২৮ আগস্ট চাকরি থেকে অবসরোত্তর ছুটিতে গেছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান। তবে তার বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় ও দুদক আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ক্ষমতা ও অর্থের নানা প্রভাববলয়ের কারণে মন্ত্রণালয় তথা সরকার মাহবুবুর রহমানের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে করে নিচের দিকে তার সারির দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
যত অভিযোগ : সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে উত্থাপিত বিস্তর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে এলজিইডির নিজস্ব তদন্ত ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আনীত ৫টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রথমত রয়েছে, ১৯৯৮ সালে মুন্সীগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে তিনি সড়ক ও কালভার্ট মেরামত কর্মসূচির অব্যয়িত ১ কোটি ৫ লাখ টাকা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিধিবহির্ভূতভাবে অন্য খাতে স্থানান্তর করেন। পরবর্তীকালে এই টাকা এলজিইডির সদর দফতর সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকে পরিশোধ করেন।
এ বিষয়ে মাহবুবুর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিলেও তা ধোপে টেকেনি। এলজিইডির এ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ নির্দেশিকার বিধানাবলী অনুসরণ না করে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমোদনে ভবন সম্প্রসারণ কাজ পল্লী অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খাতের আওতায় গ্রহণ করেছেন। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ জেলার এলজিইডির পল্লী সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজের অব্যয়িত উল্লেখিত টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে এলজিইডির সদর দফতর ভবনের ১২ তলার সম্প্রসারণ কাজে সম্পূর্ণ নিজ এখতিয়ারে নিয়োজিত ঠিকাদারকে পরিশোধ করেছেন, যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
প্রতিবেদনে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, এই কর্মকর্তা পরবর্তীকালে ঢাকা জেলার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন বিভিন্ন দফতরের অব্যয়িত ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৩০ টাকা একইভাবে সদর দফতর নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার মেসার্স আবুল কালাম পরিশোধ করেন। এই টাকার মধ্যে এলজিইডির নরসিংদী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, যশোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, এনআইএলজির সড়ক নির্মাণ বাবদ ঢাকা জেলা পরিষদের খাত থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা, অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের ৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ও পল্লী অবকাঠমো উন্নয়ন প্রকল্পের ১৩ লাখ টাকা। এ বিষয়ে এলজিইডি কর্তৃক উত্থাপিত চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এলজিইডি সদর দফতর ভবনের ১২ তলা সম্প্রসারণ কাজের মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬৮ লাখ টাকা। সাড়ে ৭% ঊর্ধ্বদরে ঠিকাদার আবুল কালামের দর ছিল ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু অভিযুক্ত মাহবুবুর রহমান প্রায় ৮০ লাখ টাকার নন-টেন্ডার আইটেম অন্তর্ভুক্ত করে মূল প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় পৌনে তিনগুণ দর বৃদ্ধি করেন। এতে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি টাকা। ওদিকে নিুমানের কাজ করায় নির্মাণের অল্প কিছুদিনের মধ্যে ছাদ দিয়ে পানি পড়া শুরু করে। অথচ এ বিষয়ে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তার পুরো বিল পরিশোধ করে দেন।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, সদর দফতরের ১২ তলার নির্মাণ কাজ অত্যন্ত নিুমানের হওয়ায় পরবর্তীকালে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-২৬ এর আওতায় প্রায় পৌনে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়। আর এতে করে মাহবুবুর রহমানের অদক্ষতা ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে সরকারের ২ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, তিনি ১৯৯৯ সালে ঢাকা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন মুন্সীগঞ্জের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ৫১ লাখ ২৯ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। এই টাকা থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই এলজিইডি ঢাকা অফিসের পূর্ত কাজের বিল, সদর দফতরের ৪টি লিফট সংস্কারে টাকা পরিশোধ করা হয়। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির অভিযোগপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ঢাকা কার্যালয়ের পূর্ত কাজের বিল পরিশোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদন না থাকায় আর্থিক অনিয়ম করেছেন।
এদিকে মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সুনির্দিষ্ট এসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে রহস্যজনক কারণে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক মাধব রায়। ২০১১ সালে তিনি এ মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব (প্রশাসন) থাকাবস্থায় তিনি ২৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের শেষ পৃষ্ঠায় প্রকারান্তরে মাহবুবুর রহমানের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে এ কথাও উল্লেখ করেন, এলজিইডির এসব বিভাগীয় অনিয়মের বিষয়ে দীর্ঘদিন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আনীত অভিযোগের অধিকাংশ বিভাগীয় অনিয়ম বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিস্তারিত তদন্তপূর্বক এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত কারণে তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
রোববার এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অশোক মাধব রায় যুগান্তরকে বলেন, মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত বেশ কিছু অভিযোগ তিনি অনেকদিন আগে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছেন। পুরো বিষয় তার এখন মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে যে, এটি ছিল অনিয়ম, কিন্তু দুর্নীতি নয়। তিনি এক খাতের টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে অন্য খাতে খরচ করেছেন।
এ বিষয়ে এলজিইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতির মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদকে চিঠি পাঠালেও সেখানেও সবকিছু ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, এর বাইরেও শৃঙ্খলাপরিপন্থী বিভিন্ন অভিযোগে সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে একাধিক লিখিত অভিযোগ এসেছে এলজিইডি থেকে। কিন্তু বারবারই তিনি পার পেয়ে গেছেন।
জানা গেছে, সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এলজিইডির সদর দফতরে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাবস্থায় তিনিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোড কাটিং ও অন্যান্য কয়েকটি কাজে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়ে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেয় ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট। এ রিপোর্টের শেষাংশে মন্তব্যের কলামে বলা হয়, রোড কাটিং ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ নিয়মানুযায়ী সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ২০০১-০২ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত এই খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়, যা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। ভাউচার বা কোটেশনের মাধ্যমে খুচরা জিনিসপত্র বা যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখিয়ে টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। পূর্ত কাজে ৬৩টি প্যাকেজে কোটেশন আহবানে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বনের কারণে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। যাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ ২৮ হাজার টাকার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সরকারি অর্থে কোনো কর্মকর্তার নামে এফডিআর করা, এ ধরনের তথ্য যথাসময়ে ক্যাশবহিতে লিপিবদ্ধ না করাসহ এ সংক্রান্ত ৯ মাসের সুদের হিসাব না রাখাও গুরুতর আর্থিক অনিয়ম প্রভৃতি।
লিফলেট : কিছুদিন আগে এলজিইডির সর্বস্তরের সাধারণ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর পক্ষ থেকে অফিস চত্বরে একটি লিফলেট ছাড়া হয়। সেখানে মাহবুবুর রহমানকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেয়ার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পত্তির কিছু খতিয়ানও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ফিলিং স্টেশন ও টিভি চ্যানেলের গোপন শেয়ারের মালিক, উত্তরা ৯নং সেক্টরে রাজিয়া ভিলা, মিরপুরের পাইকপাড়ায় ৬ তলা বাড়ি, খুলনা ও বরিশালে আরও বাড়ি থাকার কথা বলা হয়।
এদিকে ওপরে উল্লেখিত বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এক খাতের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করা একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ক্ষমতার আওতায় পড়ে না। তাই আমি এটি করিনি, যা কিছু হয়েছে তা নিয়ম মেনেই হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুদক যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে তদন্ত করেছে। এমনকি ৫ বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে তেমন কিছু পায়নি। তাই মামলাও করেনি।
এছাড়া তার বেনামে কোনো ফিলিং স্টেশন থাকলে সেটি যে দেখিয়ে দিতে পারবে আমি তাকে সেটি দিয়ে দেব। আর যে টিভিতে আমার মালিকানা রয়েছে বলে প্রচার করা হয় আসলে তা সত্য নয়। বাস্তব তথ্য হল, আমার বন্ধু ওই টেলিভিশনের মালিকদের একজন। আর আমার ঢাকায় বা গ্রামে কোনো বহুতল ভবন নেই।
প্রসঙ্গত, ২৮ আগস্ট চাকরি থেকে অবসরোত্তর ছুটিতে গেছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান। তবে তার বিরুদ্ধে এখনও বিভাগীয় ও দুদক আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
No comments