বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৭৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। ইশতিয়াক হোসেন, বীর প্রতীক
সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে নভেম্বর মাসের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেন।
মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় তাঁরা সীমান্তসংলগ্ন পাকিস্তানি ঘাঁটিতে একের পর এক আক্রমণ চালান। এরই ধারাবাহিকতায় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় তাঁরা চৌগাছার গরীবপুরে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর একটি দলে ছিলেন ইশতিয়াক হোসেন (হিদি)।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত অন্যতম সফল অভিযান ছিল গরীবপুরের যুদ্ধ। যশোর জেলার অন্তর্গত চৌগাছা। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন বিশেষত ৮ নম্বর সেক্টরে আনুষ্ঠানিক বা চূড়ান্ত যুদ্ধের সূচনা হয়। যৌথ বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণের মধ্য দিয়ে ২৪ নভেম্বর চৌগাছা মুক্ত হয়।
এ ঘটনা ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট সাফল্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯ ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল যশোরে। ডিভিশনের অধীন ১০৭ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের ২২ এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) ঝিকরগাছা-বেনাপোল, ৩৮ এফএফ আফরা-সাজিয়ালি-আশানগর, ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যশোর-কলারোয়া-সাতক্ষীরা এবং ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যশোরে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল।
চৌগাছা উপজেলা (তখন থানা)। যশোর শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে এবং ভারতের বয়রা বালজ থেকে উত্তর-পূর্বে। চৌগাছার ভেতর দিয়ে কপোতাক্ষ নদ উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল প্রবাহিত। গরীবপুর, জাহাঙ্গীরপুর, জগন্নাথপুর, সিংহজুলি বুরিন্দা ও আফরা প্রভৃতি গ্রামের মাঝে ছিল চৌগাছা শহর। বেশ কয়েকটি ছোট-বড় রাস্তা চৌগাছার সঙ্গে সংযুক্ত। ১৯৭১ সালে সামরিক দিক থেকে এ এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
২০ নভেম্বর ইশতিয়াক হোসেনসহ মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে গরীবপুরে অবস্থান নেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল এবং ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থানের ঘটনায় নিহত)। তাঁরা সকালে বয়রা এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে নৌকায় কপোতাক্ষ নদ অতিক্রম করেন।
সন্ধ্যার মধ্যেই তাঁরা গরীবপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তোলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল মিত্র বাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। গ্রামের কাঁচা রাস্তা ও খেতের ওপর দিয়ে মিত্র বাহিনীর পিটি ৭৬ ট্যাংক গরীবপুরে পৌঁছে। এ ঘটনা পাকিস্তানিরা আশা করেনি। তারা বিস্মিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক (ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত) তার বাহিনীকে অবিলম্বে যৌথ বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দেয়।
২১ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীকে আক্রমণ করে। তখন চারদিক ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। এর সুযোগ নিয়ে তারা উঁচু ধানখেত ও নদী তীরের আড়ালে অবস্থান নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। তাদের অগ্রবর্তী দল মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেদ করে। ইশতিয়াক হোসেনসহ মুক্তিযোদ্ধারা এবং মিত্র বাহিনীর যোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ শুরু করেন। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে ওই এলাকা কনভেনশনাল (প্রথাগত) ব্যাটলফিল্ডে পরিণত হয়।
একপর্যায়ে দুই পক্ষে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁদের সাহসিকতায় থেমে যায় পাকিস্তানিদের গরীবপুর পুনর্দখলের প্রচেষ্টা। এই যুদ্ধে ইশতিয়াক হোসেন যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ২৪ নভেম্বর গরীবপুরসহ চৌগাছার একাংশ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
ইশতিয়াক হোসেন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ চৌগাছা-মাসলিয়া ও বেনাপোল আক্রমণ এবং ভাটিয়াপাড়ার (গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) যুদ্ধ। ভাটিয়াপাড়ার যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য ইশতিয়াক হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৭৯। তিনি ইশতিয়াক হোসেন হিদি নামে পরিচিত।
ইশতিয়াক হোসেন হিদি বর্তমানে ব্যবসায়ী। তাঁর আদি পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। বর্তমান পৈতৃক ঠিকানা ৩৯ এ লিচু বাগান রোড, জোয়ার সাহারা, ঢাকা। তবে তিনি বাস করেন বারিধারায় (৪৮ পার্ক রোড)। তাঁর বাবার নাম (ডা.) আফজাল হোসেন, মা রেজিয়া হোসেন। স্ত্রী শিলা রায়ান। তাঁদের তিন মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.