লন্ডনের চিঠি-বাঁচাতে হবে বাংলা টাউন by ফারুক যোশী
কিছু কিছু ঘটনা নানা কারণেই ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে যায়। ইতিহাসের এই অংশটি জানান দেয় অতীতের কথা। এটা হতে পারে কোনো মানুষ, কোনো জাতি, কোনো গোষ্ঠী কিংবা কোনো সম্প্রদায়ের ইতিহাস। ব্রিটেনের ব্রিকলেন ইতিহাসেরই এরকম একটা অংশ। বিশেষত ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের জন্য।
ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের বাঙালিরা এখানে তিল তিল করে তাদের একটা নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছে, ভিত গড়ে তুলেছে। বলতে গেলে মাত্র বিশ বছরের মাঝে এই ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করেই বাঙালিরা ব্রিটেন তো বটেই, এমনকি সারাবিশ্বে একটা অবস্থান দাঁড় করিয়েছে।ব্রিটেনের শহরে শহরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য স্ট্রিট-এভিনিউ-সড়ক। সেরকম হাজার হাজার স্ট্রিটের একটি ব্রিকলেন। যেমন এই এলাকার 'কেবল স্ট্রিট'ও একটি স্ট্রিট, ব্রিটেনের ইস্ট-এন্ডের। কিন্তু 'কেবল স্ট্রিট' ইতিহাসের স্মারক। এ স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে জমায়েত হওয়া ৬০ হাজার ইহুদি আজ থেকে প্রায় ছিয়াত্তর বছর আগে এই কেবল স্ট্রিটে ইতিহাস বানিয়েছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিল তারা উগ্র বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে। এমনকি প্রশাসন-মিডিয়া সেই বর্ণবাদীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্তু টিকে থাকতে পারেনি। ঐক্যের কারণেই। আর সে জন্যই 'কেবল স্ট্রিট' ইতিহাস। অভিবাসীদের জন্য প্রতিবাদের এ এক চিহ্ন, প্রতিবাদী স্ট্রিট 'কেবল স্ট্রিট'।
কেবল স্ট্রিটের মতোই ইস্ট-এন্ডের আরেকটি অংশ ব্রিকলেন। বাঙালিদের সংগ্রাম-সংঘর্ষ-রক্তপাত-আত্মাহুতি এই ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করেই। আর তাই তো বাঙালিদের এগিয়ে যাওয়া এই স্ট্রিটকে সামনে রেখেই। বাঙালিদের এগিয়ে যাওয়ার শুরু বিশ বছর আগে। ১৯৮২ সালে একজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। মূলধারার দলগুলোর অবজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে আজকের নিবন্ধের আলোচিত এলাকাটিতে (ব্রিকলেন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা) বিদ্রোহ করেছিলেন নুরুল ইসলাম। স্বতন্ত্র হিসেবে কাউন্সিলরও নির্বাচিত হয়েছিলেন বাঙালিদের এলাকায়। এভাবেই জানান দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিদের ঐক্য তখন ভিত তৈরি করে দেয় মূলধারার রাজনীতিতে। তারপর কাঠখড় পুড়েছে অনেক। কাঠখড় পুড়িয়ে পুড়িয়ে বাঙালিদের প্রতিনিধি আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ইতিহাস সৃষ্টি হওয়া প্রথম নির্বাচিত মেয়র ওই কাউন্সিলে, তা-ও বাঙালি। ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের উত্থান ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়েছে। ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যাম-রচডেল-বার্মিংহাম-হাইড-চেশায়ার-বার্নলি-ব্রাডফোর্ড প্রভৃতি শহরের স্থানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধি এখন বাঙালিরা। ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করেই যেন লাখো মানুষ জমায়েত হয় প্রতি বছর বৈশাখী মেলায়। ব্রিকলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রেক্ষাপট। এক সময়ের ব্রিটেনের সেরা দশটি উপন্যাসের একটি 'ব্রিকলেন' উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত ছবি ব্রিকলেন ব্রিটেনের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শিত হয়েছে গত চার-পাঁচ বছর আগে।
এই ব্রিকলেনকে ঘিরে আন্দোলন আর দাবি আদায়ের এক চূড়ান্ত রূপ ছিল বাংলা টাউন। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্পিটাল্ডফিল্ড ওয়ার্ডটি_ স্পিটাল্ডফিল্ড অ্যান্ড বাংলা টাউন নামে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায় ১৯৯৯ সালে। বলতে গেলে আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে এ অর্জনটা ছিল গর্ব করার মতো। কারণ ব্রিটেনে অভিবাসনের ইতিহাসে বাঙালিরা প্রথম তাদের নিজস্ব নাম লিখিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে এই ব্রিকলেনে এবং তখনই এখানে একটি তোরণও নির্মাণ হয় বাংলা টাউন নাম সংবলিত। বলতে গেলে ব্রিটেনে বাঙালিদের একটা প্রতীক ব্রিকলেনের এই বাংলা টাউন তোরণ।
সেই বাংলা টাউন শব্দ দুটি এখন বিলুপ্ত করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিস্ময়কর ঠেকছে, ইতিহাসের পাতা থেকে এই নামটি মুছে দেওয়ার একটা প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করেছে প্রশাসন। লোকাল গভর্নমেন্ট বাউন্ডারি কমিশন ফর ইংল্যান্ড এই নামটি কর্তনের পক্ষে সায় দিয়েছে ইতিমধ্যে। ইংল্যান্ডের নির্বাচনী এলাকাগুলো রিভিউ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কমিশন বিভিন্নভাবে স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব পেয়েছে। বর্তমান লেবার দলের সঙ্গে দূরত্ব থাকলেও এই ইস্যুতে কাউন্সিলররা (মেয়র সমর্থিত স্বতন্ত্র ও লেবার দলের) পূর্বের নামকরণের পক্ষে প্রস্তাব দেয় অথচ কনজারভেটিভ পার্টি বাংলা টাউন নামকরণটি না রাখার প্রস্তাব দেয়। কমিশন এ নামটি অর্থাৎ শুধু স্পিটাল্ডফিল্ড রাখার পক্ষেই প্রাথমিক সায় দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এতজন কাউন্সিলর, মেয়র, ডেপুটি মেয়র সব বাঙালি, অথচ বাংলা নামটি মুছে দেওয়ার নীরব কাজটিতে কমিশন প্রাথমিক সার্থকতা পেল। এখন এমনকি মেয়র-কাউন্সিলর সবাই উঠেপড়ে লেগেছেন, ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। আমার তো মনে হয় এ এক ব্যর্থতা স্থানীয় প্রশাসনের, বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের। কারণ কনজারভেটিভ পার্টির দলগত অবস্থান নিশ্চয়ই এখানে লেবার দলের মতো শক্ত নয়। অন্যদিকে কনজারভেটিভ পার্টিতেও এই এলাকায় আছেন বাঙালি প্রভাবশালী নেতারা। তারাও কি একটিবারের জন্য এর প্রতিবাদে কিছু একটা করতে পারলেন না? ব্রিটেনের রাজনীতিতে দলীয় স্বার্থ সবসময় সবাইকে যে মেনে নিতে হয়, তা নয়। কেন লিভিংস্টন লেবার দলের বাইরে গিয়ে এখানে নির্বাচন করেছিলেন, নির্বাচিতও হয়েছিলেন লন্ডন মেয়রের মতো একটা বিশাল পদে। টাওয়ার হ্যামলেটসের বর্তমান নির্বাহী মেয়রও দলের বাইরে গিয়ে স্থানীয় জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। টোরির বড় বড় বাঙালি নেতারা কি পারেননি এ ব্যাপারটা নিয়ে দেনদরবার চালিয়ে যেতে দলের ভেতর? অথবা চলে আসতে পারেননি জনগণের সারিতে? কারণ তাদের তো এখানকার জনগণ নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। এমনিতেই এই বারা নিয়ে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি চালু আছে, সব দলের মাঝেই। অভিজাত শ্রেণী এই বারাকে তাদের আয়ত্তে রাখতে পারছে না। কিন্তু অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যতই এই বারা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি চলুক না কেন, বাঙালিরা একটু সচেতন থাকলে এই বারার নেতৃত্ব কোনোভাবেই হাতছাড়া হবে না। কমিউনিটির ঐক্য বাংলা টাউন নামটার প্রয়োজনীয়তার কথা আবারও আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে পেছনে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে ৫২টি কাউন্সিলর পদ এবং এই কাউন্সিলে লেবার দলের প্রাধান্য। অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাউন্সিলর এখানে বাঙালি। এদিকে বাউন্ডারি কমিশন এখানে ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়িয়ে ১৭টির পরিবর্তে ২০টি ওয়ার্ডের প্রস্তাব রেখেছে। অন্যদিকে ৫২ থেকে কমিয়ে ৪৫টি কাউন্সিলর পদ রাখার পক্ষে প্রস্তাব গেছে তাদের পক্ষ থেকে। বাউন্ডারি কমিশনকে আমরা সাধুবাদ জানাতাম তারা যদি স্পিটাল্ডফিল্ড অ্যান্ড বাংলা টাউন ওয়ার্ডের নামের শেষের বাংলা টাউন নিয়ে এককভাবে একটি ওয়ার্ডের নামকরণ করত। তারা তা করেনি। যেহেতু ওয়ার্ড বাড়ছে, সেহেতু বাংলা টাউন নাম কর্তনের ব্যাপারটা আসতেই পারে না।
মেয়রের নেতৃত্বে ক্যাম্পেইনে স্থানীয় জনগণের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হয়েছে। লেবার পার্টিও তাদের অবস্থান থেকে কমিউনিটির মানুষকে নিয়ে শুরু করেছে ক্যাম্পেইন। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই এ ক্যাম্পেইন কাজ দেবে। কমিউনিটিতে পড়েছে এর ব্যাপক প্রভাব। বলতে গেলে এখন এটাই লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটিতে প্রধান আলোচ্য। আলোচ্য এ কারণে যে, মূলত বাঙালিদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এটি। বাংলা টাউন মূলত একটা প্রতীক। ব্রিটেনের আইকন এই ব্রিকলেন, কারি ক্যাপিটেল। আইকনের ব্রিকলেন, উপন্যাসের ব্রিকলেন, চলচ্চিত্রের ব্রিকলেন, বাঙালিদের স্মৃতির ব্রিকলেন তথা বাংলা টাউন নামটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের টানে। যেমন পর্যটক আকর্ষণ করে 'চায়না টাউন' লন্ডনে, ম্যানচেস্টারে। সে কারণে আমরা বিশ্বাস করি বাউন্ডারি কমিশনের এ প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বাংলা টাউনের অধিকারই এখানে শুধু খর্ব করা হচ্ছে না, একটা কমিউনিটির ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতেও এ সিদ্ধান্তটি আঘাত হানছে। বাংলা টাউনের নাম মুছে দেওয়া মানে ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা করা। অথচ ব্রিটেন ঐতিহ্যগতভাবেই ভিন্ন বর্ণ-গোত্রের হ্যারিটেজকে সম্মান করে। এই সম্মান দেখিয়েই বাউন্ডারি কমিশনকে এ ব্যাপারটি ভাবনায় নিতে হবে এখনই। আমরা বিশ্বাস করি, কমিউনিটির আবেগ-অনুভূতি-ঐক্যকে সম্মান দেখাবে বাউন্ডারি কমিশন।
ফারুক যোশী : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com
No comments