শেষ ওভারেই সম্ভাবনার মৃত্যু-বাংলাদেশ : ৩৮৭ ও ২২৬/৬ ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৬৪৮/৯ ডিক্লেয়ার্ড (চতুর্থ দিন শেষে) by মাসুদ পারভেজ
শেষ বিকেলে বুদ্ধিমানেরও বুদ্ধিনাশ! দলের অন্যদের সঙ্গে সাকিব আল হাসানের পার্থক্য বোঝাতে বলা নাসির হোসেনের কথা থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যায়, 'স্কিলের দিক থেকে মনে হয় না সাকিব ভাইয়ের চেয়ে কেউ কম আছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, অন্যদের চেয়ে ওনার বুদ্ধি বেশি।'
এই বুদ্ধিমান দলের চরম বিপর্যয়ে এবং চার দিনেই টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কার মুখে দলের হাল ঠিকই ধরেছিলেন। সেখান থেকে নাসিরকে নিয়ে বিপদ পার করে ৫ উইকেটে ২২৬ বা তার কিছু বেশি রান নিয়ে দিন শেষ করার আগেই খেলে ফেললেন 'বোকা'র মতো শট। অন্যদের যেমন 'বোকামি'র জন্য কালই টেস্টটা হেরে যেতে বসেছিল বাংলাদেশ!বাঁ-হাতি স্পিনার বীরাস্বামী পেরমলের বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কা মেরে ৯৭ থেকে তৃতীয় টেস্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছাতে চাইলেন। কিন্তু ব্যাটে-বলে ঠিকমতো হলো না। ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে ক্যাচ উঠে গেল। সেই ক্যাচ ধরা টিনো বেস্ট যখন এটাকেই এ ম্যাচের 'টার্নিং পয়েন্ট' বলে ধরে নিচ্ছেন, তখন যে কারোরই বুঝতে পারার কথা, ক্যারিবীয়দের জন্য কতটা আরাধ্য উইকেট ছিল সেটা।
দিনের শেষ বলে নিজের উইকেট বিলিয়ে ক্যারিবীয়দের উৎসবের রংটা রঙিন করেছেন যেমন, তেমনি একই দিনে দুটো সেঞ্চুরির আনন্দ থেকেও তো নিজেকে বঞ্চিত করেছেন সাকিব। ঢাকা টেস্টে তাঁর ধারহীন বোলিং দলের উদ্বেগ বাড়াচ্ছিল। কিন্তু এখানে ধার কিছুটা ফিরলেও সাফল্য পাচ্ছিলেন না। অবশেষে কাল চতুর্থ দিনের সকালটা তাঁর জন্য দুই হাত ভরিয়ে নেওয়ার 'সকাল' হয়েই এলো। টেস্টে মোহাম্মদ রফিকের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁতে দুটো মাত্র উইকেটই আর দরকার ছিল।
সে দুটো এসে গেল একই ওভারে। তাঁকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে দীনেশ রামদিনের ক্যাচ হওয়ার দুই বল পর সাকিবের টেস্ট উইকেটের সেঞ্চুরি পুরো হয় ড্যারেন স্যামির বিদায়ে। এক ওভার পর পেরমল আর সুনীল নারিনকে টানা দুই বলে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগানো সাকিব ততক্ষণে রফিককে (১০০) ছাড়িয়ে টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিও বনে গেছেন। তিন ওভারের মধ্যে চার-চারটি (৫২-১১-১৫১-৪) তুলে নেওয়ায় ৫২ ওভার হাত ঘোরানোটা তাই একেবারে বৃথা যায়নি।
এর আগেই অবশ্য টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটা গড়া হয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ২০০৭ সালের মে মাসে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের ৩ উইকেটে ৬১০ রান তুলে ডিক্লেয়ার করা ইনিংসটাই এত দিন সর্বোচ্চ ছিল। কাল ক্যারিবীয়রা দান ছাড়ল ৯ উইকেটে ৬৪৮ রান তুলে। ২৬১ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগে মাঠে ১৩ ঘণ্টারও বেশি ফিল্ডিং করা হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। শ্রমক্লান্ত কয়েকটা দিনের পর ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশও যেন ১৩ ওভার যেতে না যেতেই হারার আগে হেরে বসতে যাচ্ছিল।
১৩ ওভারে ৬৭ রান তুলতেই যে ৪ উইকেট খুইয়ে বসেছিল বাংলাদেশ! ৪ ওভারের এক স্পেলে (৪-০-১১-৩) যার তিনটিই তুলে নেওয়া 'হাফ ফিট' টিনো বেস্টের জবাব যেন হতে পারছিলেন না কেউই। এ ফাস্ট বোলাররা দ্বিতীয় ইনিংসে বল করতে পারবেন বলে এমনকি জানা ছিল না বাংলাদেশ শিবিরেরও। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে যাঁর খেলারই কথা নয়, সেই বেস্ট নিজেও দিনের শেষে জানিয়েছেন, তাঁর গতির ঘোড়া পুরোদমে ছোটেনি। তিনি শুধু সুইং-টুইং করানোর চেষ্টা করে গেছেন। নবম ওভারে এসে করা প্রথম বলটায় অবশ্য তেমন কোনো মুভমেন্টই ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, তামিম ইকবাল (২৮) তাতেই বোল্ড! ওভারের চতুর্থ বলটায় অবশ্য মুভমেন্ট কিছুটা ছিল। বেরিয়ে যাবে ভেবে ব্যাট উঁচিয়ে ছেড়ে দিতে গিয়ে এবার বোল্ড হলেন ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান নাঈম ইসলামও (২)।
প্রথম ইনিংসে ৪ রান করা নাজিমউদ্দিনকে এবার মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই এলবিডাব্লিউ করে দেন ফিডেল এডওয়ার্ডস। ইনিংসের প্রথম ওভারেই তামিমের সঙ্গী হওয়া শাহরিয়ার নাফীসও 'কখন যাবেন, কখন যাবেন' করছিলেন। বিশেষ শর্ট বলে তাঁর ব্যাট চালানোটা দৃষ্টিকটু লাগছিল খুব। পঞ্চম ওভারেই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এডওয়ার্ডসের বলে গালিতে মারলন স্যামুয়েলসের ক্যাচ হয়েও বেঁচে যান ওভারস্টেপিংয়ের জন্য ডেলিভারিটা 'নো বল' ঘোষিত হওয়ায়। ত্রয়োদশ ওভারেই বেস্ট তাই সেই ফর্মুলাতেই গেলেন। শরীর তাক করে বোলিং করলেন। নাফীস (২১) কিছু বুঝে ওঠার আগেই বল গ্লাভস ছুঁয়ে স্লিপ ফিল্ডারের সহজ ক্যাচ হয়ে যায়। ৬২ রানে ৪ উইকেট হারানো দলে পরিণত বাংলাদেশের বিপদ আরো বাড়িয়ে যান খোদ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম (১০)। পেরমলকে তিনিও ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান। বাংলাদেশ হয়ে যায় ৮২/৫!
৫২ ওভার হাত ঘোরানো সাকিবকে অবশ্য দলের ইনিংস ৫২ মিনিট পেরোনোর আগেই নেমে পড়তে হয়েছিল। মুশফিকের বিদায়ের পর নামা নাসিরকে (৬৪*) নিয়ে ১৪৪ রানের পার্টনারশিপটা যখন আরেকটু বড় করে দিন শেষ করার অপেক্ষা, তখনই অন্যদের হাওয়া 'মাতাল' করে দেয় ৬৯ বলে ফিফটিতে পৌঁছানো সাকিবকেও।
বুদ্ধিমানের 'বোকার মতো' যে শটে পঞ্চম দিনে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাটা কাল শেষ বিকেলেই থেমে গেছে!
No comments