নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে ভুল পথে এগোচ্ছে ইসি by হারুন আল রশীদ
নির্বাচন কমিশন (ইসি) মনে করছে, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন না করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে আইন সংশোধনের উদ্যোগ না নিয়ে সাংবিধানিক ও ফৌজদারি কার্যবিধির ক্ষমতাবলে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা নিয়েছে কমিশন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে ভুল পথে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কারণ, ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় বড় ধরনের কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না ঘটলে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) মোতায়েনের সুযোগ নেই। এর বাইরে বিকল্প পন্থা হলো, সাংবিধানিক ক্ষমতায় সরকারের কাছে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের চাহিদা জানানো। কিন্তু তা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নাম বাদ দিয়েছে। এখন নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকায় আছে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ড।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে কমিশনে কোনো দ্বিমত নেই। তবে সে জন্য কমিশন থেকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের কোনো প্রস্তাব করা হবে না। কমিশন মনে করে, বিদ্যমান ফৌজদারি আইন ও সাংবিধানিক ক্ষমতাবলেই নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব।
আরেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৮, ১২৯ ও ১৩০ ধারা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব। এরই মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশনে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য জেলা প্রশাসককে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৮, ১২৯ ও ১৩০ ধারায় বলা আছে, কোথাও কোনো বেআইনি সমাবেশ হলে বা জনশৃঙ্খলা নষ্ট হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশ বাহিনী তা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। পুলিশ বাহিনী ব্যর্থ হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর পুরুষ কর্মকর্তাদের (সৈনিক, নাবিক বা বৈমানিক নয়) সহযোগিতা কামনা করতে পারবেন। তার পরও ছত্রভঙ্গ করা না গেলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তা ছত্রভঙ্গ করতে পারবেন।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আনিসুল হক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের কোনো সুযোগ নেই। কোথাও কোনো দাঙ্গা লাগলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তা দমনে সশস্ত্র বাহিনীকে আহ্বান করতে পারবেন। তবে এর আগে পুলিশ বাহিনীকে দাঙ্গা দমনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতে হবে। তাই এ পদ্ধতিতে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা অর্থহীন। কারণ, ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাবে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়া সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে চাইলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট করা উচিত।
এ ছাড়া সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে। বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কারও কারও মতে, কমিশন থেকে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানানো হলে সরকার তাতে সাড়া না-ও দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ২০০৩ ও ২০১১ সালের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। ২০০৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এম এ সাঈদের নেতৃত্বাধীন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানালে সরকার তাতে সায় দেয়নি। সে নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের জন্য এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন থেকে দুটি চিঠি দেওয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য করে নেওয়াই ভালো। সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা হলে সরকার তা শুনবে না, এ অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’ তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হলেও ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া তারা কোনো কাজ করতে পারবে না। চোখের সামনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলেও তাদের কিছু করার থাকবে না।
No comments