পরাগ উদ্ধারের রাতে ৩২ বার ফোনালাপ- ‘৫০-ই নিয়া আসছি’

‘কসম, আপনে যা বলছেন, ৫০ বলছেন, আমি ৫০-ই নিয়া আসছি।’ ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে অপহরণকারীদের হাত থেকে শিশু পরাগকে ছাড়িয়ে আনার আগে টেলিফোনে এভাবেই কথা বলেন পরাগের বাবা বিমল মণ্ডল। গোয়েন্দাদের হাতে এ রকম ৩২টি কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে।
১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত এসব কথোপকথন হয়।
তবে অপহরণকারী দলের ‘নেতা’ আমিরকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিপণ দিয়ে পরাগ ছাড়া পেয়েছে, এমন তথ্যের সত্যতা তাঁরা পাননি। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি পরাগের বাবা বিমল মণ্ডলকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করান। পরাগের বাবাও মুক্তিপণ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে সরকার বিব্রত। তা ছাড়া, মুক্তিপণের বিষয়টি বেআইনি। পুলিশ বা কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারে না।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পরাগ অপহরণের পর থেকে তার বাবাসহ পরিবারের লোকদের ফোনে আড়ি পাতে গোয়েন্দারা। ওই সব ফোনে যেসব কথাবার্তা হয় তার প্রায় সবই রেকর্ড করা হয়। এসব রেকর্ডের মধ্যে পরাগের বাবার ফোন নম্বরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরাগকে ছেড়ে দেওয়ার দিন সন্ধ্যা থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত অপহরণকারী দলের এক সদস্য মোট ৩২ বার কথা বলেছে। এসব কথার মধ্যে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিষয়টি বারবার এসেছে। শুরুতে অপহরণকারীদের দাবি ছিল দুই কোটি টাকা।
১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টা ৩৬ মিনিটে পরাগের বাবার ফোনে কল করে এক অপহরণকারী। তাদের কথোপকথন ছিল এ রকম:
অপহরণকারী: কী ব্যাপার, আপনি এত খারাপ...?
পরাগের বাবা: ভাই লোক পাঠাইছি, একটু সময় দেন।
অপহরণকারী: আপনি গহনাগাটি বিক্রি করেন আর যাই করেন, আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আপনার পোলা আব্বু-আম্মু করতাছে।
পরাগের বাবা: আমার কাছে ৩৫-৪০ লাখ টাকার কাছাকাছি আছে।
অপহরণকারী: বস তো বলছে ৫০ লাখ। প্রশাসন নিয়ে হয়রানি করাইছেন। আপনার পোলার ক্ষতি হইব।
পরাগের বাবা: আপনি একটু দয়া করেন ভাই। আমার পোলারে দিয়া দেন।
অপহরণকারী: দেখেন, আপনার পোলাকে কিছু করব না। আপনি টাকা দেন, আপনি সবকিছু বুঝে পাবেন। টাকার জন্য আমরা ছেলেকে আনছি। আপনার ছেলের কোনো ক্ষতি করব না।
সন্ধ্যা সাতটা ৪৬ মিনিটে আবার ফোন।
পরাগের বাবা: আমার পোলাডারে দেন, আমি এখানে থাকুম না।
অপহরণকারী: তোর পোলা ১০০% বাসায় যাইব। টাকা বুইঝা পাওয়ার আগে যদি কোনো প্রকার কিছু হয়, তাহলে তোর পোলা শেষ। র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিআইডি পিছু আইলে আমরা এর দায় লমু না।
রাত ১০টা ৫৫ মিনিটের কথোপকথন ছিল এ রকম:
অপহরণকারী: আপনার হাতের বাম দিক দিয়ে একটা রাস্তা গেছে, ওই রাস্তায় টাকা হাতে নিয়ে একলা হাঁটেন। মোবাইলের লাইট ব্যবহার করেন। তাড়াতাড়ি করেন।
পরাগের বাবা: আমি কি একা আসব?
অপহরণকারী: একা মানে, একদম একা আসবেন। একা মানে বুঝেন?
পরাগের বাবা: জি।
অপহরণকারী: পারলে জামা-কাপড় রেখে শুধু মালটা নিয়ে আসেন। আপনার পেছনে কেউ আছে?
পরাগের বাবা: না ভাই, কসম আপনে যা বলছেন, ৫০ বলছেন, আমি ৫০-ই নিয়া আসছি।
অপহরণকারী: যান, সোজা চলে যান। ভয় পাইছেন ক্যান। আমার পোলা হলে আমি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যেতাম। পোলার জন্য দেখি আপনার কোনো স্যাক্রিফাইস নাই।
ওই দিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে অপহরণকারীদের হাতে মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার পর পরাগের বাবা তাঁর বন্ধুকে ফোন করেন। তাঁদের ফোনের কথা ছিল এ রকম।
বন্ধু: তুই কই?
পরাগের বাবা: আমি কাঁচা রাস্তায়। যাইয়া দেখি পোলা নাই। পিস্তল ঠেকাইয়া টাকা রাইখ্যা দিছে।

No comments

Powered by Blogger.