চট্টগ্রামে জনতার ওপর ভেঙে পড়ল ফ্লাইওভার-৯ লাশ উদ্ধার, পুলিশ বক্স, ঠিকাদার অফিসে আগুন

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্মাণাধীন একটি ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার পরপর ধসে পড়েছে। এ ঘটনায় গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ধসে পড়া গার্ডারও সরানো যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব গার্ডারের নিচে আরো লাশ আছে।
গতকাল শনিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বহদ্দার পুকুরপাড় খাজা রোডের মুখে ফ্লাইওভারের গার্ডার তিনটি ভেঙে পড়ে। প্রতিটি গার্ডার ১২০ ফুট লম্বা ও সাত ফুট চওড়া, প্রতিটির ওজন প্রায় ৮০ টন।
ঘটনার পর উচ্ছৃঙ্খল জনতার বাধার মুখে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেনি। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ ও সাংবাদিকদের অন্তত ১০টি গাড়ি, বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স, ঠিকাদারের অফিস এবং বেশ কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগান থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। রাত সাড়ে ১০টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। তবে এসব ভারী গার্ডারের তুলনায় উদ্ধারকারী যান অপ্রতুল হওয়ায় রাতের মধ্যে গার্ডারগুলো সরিয়ে উদ্ধারকাজ শেষ করা যাবে কি না- এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। রাত সাড়ে ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চলছিল।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে নির্মিত বহদ্দারহাটে এই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করছিল মীর আক্তার ও পারিসা এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। গত জুন মাসে নির্মাণাধীন এই ফ্লাইওভারের একটি গার্ডার ভেঙে পড়েছিল। এরপর গত বৃহস্পতিবার ফ্লাইওভার থেকে রড পড়ে একটি প্রাইভেটকারের ওপর।
গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত আমরা ৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি। এ ছাড়া আহত ২১ জনকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বহদ্দার পুকুরপাড়ের ফুটপাতে সন্ধ্যার পর এই সময়টিতে অসংখ্য মানুষ চলাচল করে। সেখানে পুকুরপাড়ের একটি অংশে বসে অনেক লোকজন আড্ডা দেয়। ভেঙে পড়া তিনটি গার্ডারের মধ্যে দুটি ফুটপাতে এবং অন্যটি পুকুরে গিয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, পুকুর পাড়ে আড্ডারত লোকজনের অনেকেই গার্ডার চাপা পড়ে পুকুরে ডুবে গেছেন।
ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে থাকলে সিএমপির কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দামপাড়া পুলিশ লাইন থেকে সব ফোর্স ঘটনাস্থলে মোতায়েনের নির্দেশ দেন এবং সেনাবাহিনীকে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু পথে উত্তেজিত জনতার বাধার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে পারেনি। পরে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে নির্মাণসামগ্রী থাকার কারণে সেনাবাহিনীর ক্রেন তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি। ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ১০টায় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে ৯ জনকে আহত অবস্থায় এবং একজনকে মৃত উদ্ধার করে।
জনতার আগুন
পরপর তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ার পর উৎসুক জনতা বহদ্দারহাট এলাকায় জড়ো হয়। সেখানে পুলিশ পৌঁছার পর তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। জনতার অভিযোগ, ঘটনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কেন উদ্ধার অভিযান শুরু হচ্ছে না। ভেঙে পড়া গার্ডারের কাছে মানুষের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখার পর মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে জনতা বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অফিস কক্ষ, কয়েকটি দোকান এবং পুলিশ ও সাংবাদিকদের ১০টি গাড়িতে আগুন দেয়।
পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ও বুলেট
হাজারো জনতার এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বাধ্য হয়ে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। বিপুলসংখ্যক জনতাকে সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের ঘটনাস্থল যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। রাত ১০টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
সরেজমিন
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, গার্ডারের নিচে কারো পা, কারো হাতে দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি স্থানে পানি আর রক্তে একাকার অবস্থা। এ ছাড়া ঘটনার পরপরই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন জানান, গার্ডার তিনটি ভেঙে পড়ার পর পুরো এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লোকজন দিগ্বিবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এর মধ্যে আহতদের আহাজারি শুরু হয়। কিন্তু অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
সীমানাপ্রাচীর ভাঙায় অনেকেই আহত
ঘটনা দেখতে যাওয়া উৎসুক অনেক লোকজন পাশের একটি বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে উঠে পড়ে। রাত সাড়ে ১০টার পর সীমানাপ্রাচীরটি ভেঙে পড়লে অনেকে আহত হয়। প্রাচীর ভেঙে সবাই একটি ড্রেনে গিয়ে পড়ে। এতে অনেকের হাত-পা ভেঙে যায়। এদের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
পুলিশের বক্তব্য
সিএমপির গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. তারেক আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল উদ্ধার অভিযান শুরু করে।'
ফ্লাইওভারধসে আহতদের পরিচয়
বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারধসে আহতদের মধ্যে ২৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন- পুলিশ কনস্টেবল দেলোয়ার, রাসেল, মাসুম, সোহেল, নাজমা বেগম, খোকন, হাফিজুল, শাহাবুদ্দিন, রিপন ধর, আজিজুল হক, সুমন, ডা. স্নেহাশীষ বড়ুয়া, জসিম, নূরুল আলম, জাহাঙ্গীর, মহিউদ্দীন চৌধুরী সুমন ও আসাদ। অন্যদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে আনুমানিক ৩৫ বছর বয়স্ক একজনের মৃত্যু হয়। আহতদের চিকিৎসার সুবিধার্থে হাসপাতালের সব চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া হাসপাতালেও বিপুলসংখ্যক র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
আহতদের দেখতে হাসপাতালে মন্ত্রী ও মেয়র
এ ঘটনায় আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মনজুর আলম ও আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাসির উদ্দীন।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন : শিমুল নজরুল, ভূঁইয়া নজরুল, নূপুর দেব, রাশেদুল তুষার ও এস এম রানা)

No comments

Powered by Blogger.