গ্রামীণ ব্যাংক- বাংলাদেশের মাটির চারা ছড়াল দুনিয়ায় by জেমস গুস্তাভ স্পেথ
১৯৩৩ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সময় আমি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলাম দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্ভাবনাময় পথগুলোর ওপর। তত দিনে আমি গ্রামীণ ব্যাংক এবং বাংলাদেশের দরিদ্র নারীদের ঋণ দেওয়া সম্পর্কে জানতাম।
তা সত্ত্বেও আমি গ্রামীণ বিষয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে অধ্যয়ন করার পর আমার কাছে পরিষ্কার হলো যে মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীরা দারিদ্র্য মোকাবিলার জট চূড়ান্তভাবে ভাঙার এক গুচ্ছ কৌশল আবিষ্কার করেছেন। আগের বছরগুলোয় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা গ্রামীণকে জানতে বাংলাদেশে আসতেন এবং বাংলাদেশের মাটিতে অঙ্কুরিত হওয়া এই বৃক্ষটির বীজ নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে রোপণ করতেন।প্রথম দিকের এ রকম একজন দর্শনার্থী হলেন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সভাপতি পিটার গোল্ডমার্ক, পরে তিনি ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন-এর প্রকাশক হন। দুই দশক আগে পরিদর্শনের সময় গ্রামীণের অর্জনকে যেভাবে দেখেছিলেন, তা এ রকম:
যেদিন সেখানে গেলাম, দেখি নারীরা বসে আছেন, ঋণ-কর্মকর্তাকে রিপোর্ট করছেন, উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের ১৬টি সিদ্ধান্ত বা অঙ্গীকার উচ্চারণ করছেন।
দেখতে দেখতে আমি যেন ভিন্ন কিছুর আঁচ পেলাম। দেখতে পেলাম, প্রাচীন নিয়মকানুনের ভেঙে পড়া, ঐতিহ্যের কামান চুরমার হওয়া। আমি ধ্বংস দেখতে পেলাম। যা যা ধ্বংস হচ্ছিল তা এই:
গরিব মানুষ অসহায়, এই বিশ্বাস।
নারীরা সবচেয়ে অসহায়, এই বিশ্বাস।
গরিব ভূমিহীন নারীদের ঋণ দেওয়া বিরাট ঝুঁকির কাজ, এই বিশ্বাস।
গরিব মানুষ সহায়তা করে না, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারে না, নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, ঋণের সুদ দেওয়া বা ঋণ ব্যবস্থাপনা করা জানে না, এমন বিশ্বাস।
অল্প ঋণের থেকে বড় ঋণ দেওয়া ভালো, এই বিশ্বাস।
রাষ্ট্রের দ্বারা বিরাট কেন্দ্রীভূত প্রকল্পে ঋণ দেওয়াই অর্থনৈতিক উন্নতির সেরা উপায়, এই বিশ্বাস।
প্রকৃতিকে ধ্বংস করেই অর্থনীতি গঠন করা যায়, এই বিশ্বাস।
পুরোনো বিশ্বাস যদি মাটির তৈরি হয়, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের মেঝে খোলামকুচি বিছানো...
এটাই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যার নিজস্ব জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা আছে। এর সদস্যরা শপথ নেন: ‘আমরা আমাদের পরিবার ছোট রাখার পরিকল্পনা করব।’
এটাই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যার বিবাহ নীতিমালাও আছে। এর সদস্যরা শপথ নেন: ‘আমরা আমাদের ব্যাংকের কেন্দ্রকে যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখব। আমরা বাল্যবিবাহ দেব না।’
এটা পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যার পরিচ্ছন্নতা-বিষয়ক নীতিমালা আছে। এর সদস্যরা শপথ নেন: ‘আমরা পাকা পায়খানা বানাব এবং ব্যবহার করব।’
পৃথিবীর দিকে ভিন্ন চোখে তাকানোর ইচ্ছা করলে কত কিছু যে করা সম্ভব, তা কি আপনারা দেখা শুরু করেছেন?
গোল্ডমার্ক ব্যক্তিগত পর্যায়ে অন্যতম প্রাচীন একটি বিশ্বাস চুরমার হতে দেখেছিলেন। তা হলো, ‘গরিব মানুষ সহযোগিতা করতে পারে না, পারে না আগাম পরিকল্পনা করতে, পারে না নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে।’ এই বিশ্বাসের ভাঙন পরে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি পর্যায়েও প্রসারিত হয়েছিল। গ্রামীণের সদস্যরা কেবল তাঁদের জীবন এবং তাঁদের সমাজের জীবনের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতেন না, এমনকি পরিচালনা পরিষদের যে ১২ জন সদস্য সমগ্র প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, তাঁদের নয়জনকেও তাঁরাই নির্বাচন করতেন। বিশ্বের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যদি গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে এই শিক্ষা নিতে পারত, তারা যদি তাদের পরিচালনা পরিষদে সেসব গ্রাহক দিয়ে ভরিয়ে নিত, যাঁরা ব্যাংকের সাফল্যের জন্য বিনিয়োগ করেছেন, তাহলে হয়তো ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটটা আর ঘটতে পারত না।
বলতেই হবে যে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোনয়নের ক্ষমতা গ্রাহক-নিয়ন্ত্রিত পরিচালনা পরিষদ থেকে সরকার-মনোনীত কর্মকর্তার হাতে সরিয়ে আনার সরকারি সিদ্ধান্ত তাই গভীর দুঃখের একটা ব্যাপার। পরিচালনা পরিষদের নয় নারীসদস্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে ৮৪ লাখ সদস্যের দ্বারা নির্বাচিত হন, যাঁদের বেশির ভাগই আবার নারী। আর এই সদস্যরাই ব্যাংকের শেয়ারের ৯৭ শতাংশের মালিক, যেখানে সরকারের শেয়ার মাত্র ৩ শতাংশ।
মানতেই হবে যে নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্য বিমোচনের হাত ধরাধরি করে এগোয়। যে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সে সময়ই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের যতটাই ভুল প্রমাণিত হওয়া দরকার ছিল, সময় তাঁকে ততটাই ভুল প্রমাণ করেছে। এখন, ২০১৫ সালের মধ্যে যেসব দেশ জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে বলে মনে হচ্ছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষের ঘরে। যেকোনো আন্তরিক গবেষক অথবা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ আপনাকে জানাতে পারবেন যে বাংলাদেশে প্রগতি শিকড় গাড়তে পেরেছে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ এবং দেশটির জোরদার সিভিল সোসাইটির অন্যদের অবদানের কারণে। এই স্পন্দমান অবস্থাকে কেন কোনো সরকার তছনছ করবে, যেখানে এরা অবস্থাকে বদলে দিয়েছে এবং জনগণের জীবননালি হয়ে উঠেছে!
মনে রাখা জরুরি যে মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবনা কেবল ব্যাংক কার্যক্রমের মধ্যেই থেমে থাকেনি। ইউএনডিপিতে আমার কর্মমেয়াদের আগে, আমি যুগ্মভাবে ন্যাশনাল রিসোর্স ডিফেন্স কাউন্সিল এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ইউএনডিপি ছাড়ার পর আমি ইয়েলের স্কুল অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের ডিন হই। এখন আমি শিক্ষকতা করছি ভারমন্ট ল স্কুলে, এটিই পরিবেশ আইন অধ্যয়নে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান। কাজেই, পরিবেশের সুরক্ষা আমার জীবনকর্মের কেন্দ্রীয় অংশ হয়ে আছে। আমি যখন গ্রামীণ শক্তির অর্জনের দিকে তাকাই, বিস্ময়ে রুদ্ধশ্বাস হয়ে যায় আমার। এ বছরের আগস্ট মাসে গ্রামীণ ২৪ হাজার গার্হস্থ্য সৌরব্যবস্থা (সোলার হোম সিস্টেম) স্থাপন করেছে, আর জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত স্থাপন করেছে প্রায় ১০ লাখ। গ্রামীণ শক্তি এই আগস্ট মাসেই ১৪ হাজার উন্নত রান্নার স্টোভ বিক্রি করেছে, আর শুরুর পর থেকে বিক্রি হয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি। এর সুফল পাচ্ছে ৭০ লাখ মানুষ। এতে নিয়োজিত আছে ১২ হাজার কর্মী। বিশ্বের জ্বালানি কোম্পানিগুলো যদি গ্রামীণ শক্তির অর্জনকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের মুখোমুখি হওয়া জলবায়ু সমস্যাও এড়াতে পারতাম।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ছয় বছর আগে যখন গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে, তখন তারা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাখর্য দেখতে পেয়েছিল। পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তাঁকে কংগ্রেসের স্বর্ণপদক উপহার দেয়। তিনিই ইতিহাসের সপ্তম ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে শান্তি পুরস্কার, কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল এবং প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পেয়েছেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। (সংক্ষেপিত)
জেমস গুস্তাভ (গুজ) স্পেথ: জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির সাবেক প্রশাসক এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি ভারমন্ট ল স্কুলে অধ্যাপনা করছেন।
No comments