অর্জনের দিনে না-পাওয়ার বেদনাও পোড়াল সাকিবকে by উৎপল শুভ্র
স্টেডিয়ামে পিন পড়লেও বোধ হয় সেই শব্দটা শোনা যেত! স্তব্ধ গ্যালারিতে দর্শকদের চোখে অবিশ্বাস—এতক্ষণ ধরে যে মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা, সেটির এমন পরিণতি! মিড অফে ক্যাচটি নিয়ে টিনো বেস্ট তখন উল্লাসে মাতোয়ারা। ফিরে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান।
যে দিনে বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছেন, সেই দিনটি কোথায় অপরাজিত সেঞ্চুরির গৌরবে শেষ হবে, উল্টো ৯৭ রানে আউট!সেঞ্চুরিটা পেতে তর সইছিল না। দিনের শেষ ওভারের প্রথম বলটিকেই তাই উড়িয়ে মারতে গিয়েছিলেন। কেন যে গেলেন! এক-এক করে নিয়েও তো সেঞ্চুরি করা যেত। এ দিনই না হলে না-ই হতো। আরেকটা দিন তো সামনে পড়েই ছিল।
তা ছাড়া প্রশ্নটা তো শুধু সাকিবের সেঞ্চুরির ছিল না। চতুর্থ দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দূর করে ম্যাচ পঞ্চম দিনে নিয়ে গেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আবার ব্যাট করাতে দরকার মাত্র ৩৫ রান। নাসিরের সঙ্গে জুটিটা যদি কাল লাঞ্চ পর্যন্ত টিকে যায়! এরপর মাহমুদউল্লাহ আছেন। আছেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান আবুল হাসান। ম্যাচটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যত সহজে জিতবে বলে ভেবেছিল, ব্যাপারটা এত সহজ হবে না। কে জানে, অলৌকিক কিছু ঘটেও যায় কি না! জনমানুষের এই ভাবনা কি সাকিবের মনেও কাজ করেনি! তাহলে কী ব্যাখ্যা ওই শটের?
নাসির হোসেন সংবাদ সম্মেলনে খুব ভালো বললেন, মএত সেঞ্চুরি করার পরও নব্বইয়ের ঘরে এসে শচীন টেন্ডুলকারেরও হাঁটু কাঁপে।’ নব্বইয়ের নার্ভাসনেসই তাহলে কারণ! টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট এখন তাঁর, সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটাও একদিন তাঁর হয়ে যাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। সাকিবকে পোড়ানোর জন্য এই রেকর্ডটাও থাকছে যে, বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার নব্বইয়ের ঘরে কাটাও পড়েছেন তিনিই!
আগের দুটি ৯৬-এর সঙ্গে কালকের ৯৭। ৯৬ রানে অপরাজিতও ছিলেন একবার।
লাঞ্চের মিনিট দশেক পর ৯ উইকেটে ৬৪৮ রানে ইনিংস ঘোষণা করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ডটি উপমহাদেশে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ স্কোরও (আগের সর্বোচ্চ: ৬৪৪, বিপক্ষ ভারত, দিল্লি, ১৯৫৯)।
সাকিব টপাটপ উইকেট নিতে শুরু না করলে রানটা নির্ঘাত আরও বাড়ত। ৪৮.১ ওভার উইকেটশূন্য। পরের ১৭ বলে ৪ উইকেট! লাঞ্চের আগে পর পর দুই বলে উইকেট নিয়ে জাগিয়েছিলেন হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও। মোহাম্মদ রফিক ঠিক এক শ উইকেট নিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেটকে। প্রায় পৌনে পাঁচ বছর পর আরেক বাঁহাতি স্পিনারই পেরিয়ে গেলেন তাঁকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে ২৬১ রানে পিছিয়ে, সামনে প্রায় পাঁচ সেশন। দুর্গম গিরি কান্তার মরু পেরোনোর পথে যাত্রার শুরু যত জঘন্য হওয়া সম্ভব, সেটিই হলো। প্রথম ওভারেই নাজিমউদ্দিন আউট। ইনিংসের তৃতীয় বল, তবে তাঁর জন্য মগোল্ডেন ডাক’। জুনায়েদ সিদ্দিক অট্টহাসি দিলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। এক টেস্টের ব্যর্থতাতেই তাঁকে ছুড়ে ফেলাটা তো আসলে অন্যায়ই হয়েছে।
শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাটিং দেখে থাকলেও জুনায়েদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘আমি না শর্ট বল খেলতে পারি না। এ কী করছে!’ শর্ট বলে শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাটিং দেখে কারও মনে হতেই পারে, ওই রবীন্দ্রসংগীতটাই বোধ হয় তাঁর ‘থিম সং’। মযে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না...’, শেষ শব্দটা এখানে ‘মা’ না হয়ে শুধু ‘বাউন্সার’ হবে। ‘বাউন্সার’ ছেড়ে দেওয়াটাও যে ব্যাটিংয়ের মধ্যে পড়ে, হয় এটা তিনি জানেনই না অথবা জানলেও তা পারেন না। ফিদেল এডওয়ার্ডসের শর্ট বলে হুক করতে গিয়ে গালিতে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন বলটা মনো’ ছিল বলে। কিন্তু যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন, তাতে কতক্ষণ আর বাঁচবেন! টিনো বেস্টের আরেকটি বাউন্সারই ডেকে আনল মৃত্যু!
হ্যাঁ, টিনো বেস্টই! হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেলে সপ্তাহ খানেক কারও মাঠে নামতে পারার কথা নয়। ফাস্ট বোলারদের ক্ষেত্রে তো সময়টা আরও বাড়ার কথা। সেখানে বেস্ট শুধু মাঠে নামলেনই না, ঢাকায় প্রথম টেস্টের মতো এখানেও এলোমেলো করে দিলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। গতির ঝড় তুলতে পারবেন না জেনে আশ্রয় নিলেন সুইংয়ের। নাঈম কেতাবি ঢঙে ব্যাট তুলে বল ছেড়ে দিয়ে সেই সুইংয়েরই শিকার হলেন। তামিমকে তুলে নিয়েছেন এর দুই বল আগেই। শাহরিয়ারকেও যখন যোগ করলেন শিকার-তালিকায়, বেস্টের স্পেল তখন ২.৪-০-৬-৩!
২০০ ওভারের বেশি কিপিং আর অধিনায়কত্বের ধকল মুশফিকুরকে ক্লান্তির চরমে পৌঁছে দিয়ে থাকবে। পেরমলকে যেভাবে বাইরে বেরিয়ে মারতে গেলেন, এর আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইনিংসের ৮৮ বলের মধ্যে বাংলাদেশ ৫ উইকেটে ৮২। প্রেসবক্সের ছাদে পেছনে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের দলটাকে দাঁড়ানো দেখেও টেলিভিশন ক্রুরা পঞ্চম দিনটা ছুটি পাওয়া যাচ্ছে ভেবে নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগলেন।
সাকিব ও নাসিরের ১৪৪ রানের জুটি সেই উল্লাসে জল ঢেলে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু দিনের শেষটা সেই বিয়োগান্তই হয়ে রইল!
চতুর্থ দিনের শেষে
বাংলাদেশ: ৩৮৭ ও ২২৬/৬
উইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ৬৪৮/৯ ডি.
No comments