পবিত্র আশুরা- কারবালার অনুপ্রেরণা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

যুগে যুগে ১০ মহররম বা আশুরা দিবসে ঐতিহাসিক বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতই এ দিবসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
আশুরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তথা রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামী চেতনায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যময় একটি দিবস। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরেরা ৬১ হিজরি সালে এই দিন ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর হাতে কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ সুমহান আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
নবী-দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হক প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের রক্তচক্ষু এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। ক্ষমতালোভী ইয়াজিদকে সমর্থন না করায় পরিস্থিতি অনিবার্য সংঘর্ষের দিকে এগোতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামল পর্যন্ত ইসলামি আদর্শ তথা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো; কিন্তু ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদ নিজেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা দাবি করে দামেস্ককে রাজধানী ঘোষণা করেন। কিন্তু মদিনার অধিবাসীরা তাঁর এই অন্যায় দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের আসন গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। ইমাম হোসাইন (রা.) নিজেকে খলিফা দাবি না করলেও ইয়াজিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। দুর্ভাগ্যবশত খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রতিষ্ঠিত ন্যায়নীতি লঙ্ঘন ও পদদলিত করে ইয়াজিদ অন্যায় ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে মুসলিম জাহানের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং খিলাফতের পরিবর্তে প্রথম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ পদে থেকে ইয়াজিদ ইসলামি আদর্শবিরোধী জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন এবং খলিফা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য সাম্রাজ্যে ভীতি সঞ্চার করে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালান।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও বায়তুল মাল দখলকারী ইয়াজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিরোধ ছিল আদর্শিক। ইয়াজিদ ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ছিলেন না, তাঁর ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভ এবং শাসক হিসেবে ছিল হীন চরিত্রের স্বৈরতন্ত্রী। মুসলিম সমাজের সুযোগ্য প্রতিনিধিরা খলিফা বা আমিরুল মুমিনিন পদে তাঁকে মনোনয়নও দেননি, বরং ইয়াজিদ জবরদস্তিমূলকভাবে খলিফার পদ দখল করেছিলেন। এমতাবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিণতিতে একপর্যায়ে মদিনা থেকে কুফা যাওয়ার পথে ফোরাত নদীর তীরবর্তী ‘কারবালা’ নামক স্থানে ইয়াজিদের তাঁবেদার বাহিনীর হাতে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি সপরিবারে জীবন বিসর্জন দেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হয়েছেন, যাঁর দেহে আল্লাহর পিয়ারা হাবিবের রক্তধারা প্রবাহিত, তিনি কীভাবে তাঁরই আদর্শবিরোধী পন্থায় অধিষ্ঠিত শাসকের হাতে বায়াত বা আনুগত্য গ্রহণ করতে পারেন? কারবালা মানবজাতির ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ শোকাবহ কাহিনি হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজ, এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষ এই বিয়োগান্ত ঘটনাকে স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কারবালার ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সুমহান আত্মত্যাগের কাহিনি নয়। এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিবাদের এক অনন্য সাধারণ বীরত্বগাথা।
হজরত ইমাম (রা.)-এর সপরিবারে শাহাদাতবরণের ঘটনা ১০ মহররম আশুরাকে বিশেষ মাত্রা ও ত্যাগের মহিমা প্রদান করেছে। এই দিন শুধু শোক আর বেদনা নয়, বরং কারবালা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে, আত্মত্যাগে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ইমাম হোসাইন (রা.) অসত্য ও অন্যায়ের কাছে বিনা লড়াইয়ে মাথা নত করেননি। ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদের অন্যায় দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে তিনি এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, ইসলামের ইতিহাস তাঁদের অমর করেছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী তাই আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.) সহ নবী-বংশের আত্মত্যাগ ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য; তাই আশুরার ঘটনাবহুল ঐতিহ্য শৌর্য-বীর্য ও ত্যাগের অপূর্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন যে আত্ম কোরবানির অনন্য নজির স্থাপন করেন, তা যুগে যুগে শান্তিকামী মানুষকে এক দুর্দমনীয় অনুপ্রেরণাসহ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উৎসাহ দিয়ে আসছে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেদিন ইমাম হোসাইন (রা.) যদি দুরাত্মা ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করতেন, তাহলে রাজসিংহাসন তাঁর বশীভূত হতো। কিন্তু নিজের ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতালিন্সা তাঁকে গ্রাস করেনি। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের চির শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে জয় করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তাই কবির ভাষায় যথার্থই বলা হয়েছে, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়/ হর কারবালা কি বাদ’—ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
কারবালার ঘটনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইমাম হোসাইন (রা.) আজ অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গণ্য। বিশ্বজুড়েই আজ সত্যাসত্যের, ন্যায় ও অন্যায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবী-দৌহিত্র কারবালায় আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই চেতনার অভাবের কারণে আজ অসত্য ও অন্যায়ের প্রবল প্রতাপ। আশুরার শিক্ষা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সাহস জোগায়, আত্মত্যাগের আহ্বান জানায়। কারবালার সেই চেতনাকে ধারণ করতে না পারলে শুধু শোক আর মাতম করে কোনো লাভ নেই। যাবতীয় দুর্নীতি-অন্যায়-অবিচার-অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কোনো দেশ-জাতি-রাষ্ট্র বা সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই কারবালার অতুলনীয় শিক্ষা। তাই আসুন, আমরা কারবালার মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা বিশ্বের দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.