স্মরণ : মো. মুজিবুর রহমান-সগৌরবে স্বমহিমায় ভাস্বর শহীদ ময়েজউদ্দিন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে একান্ত গভীরভাবে যাঁদের নাম ভাস্বর হয়ে রয়েছে, তাঁদের একজন হলেন শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
রাজনীতিতে, আইন পেশায় ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শহীদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা। সব পরিচয়ে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি মাটি ও মানুষের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, তা ভুলে যাওয়ার নয়। তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও অসাধারণ গুণাবলি বারবার তাঁর স্মৃতির কাছে নিয়ে যায়, আর অঙ্গীকার করতে শেখায় সমাজের কল্যাণে তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার জন্য।
সময়ের পরিক্রমায় আজ ২৭ সেপ্টেম্বর শহীদ ময়েজউদ্দিনের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বৈরাচারী শাসক হটাও এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এ রকম এক অবস্থায় ১৯৮৪ সালের এই দিনে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল। কালীগঞ্জে হরতাল সফল করা ও হরতালের পিকেটিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা ময়েজউদ্দিন। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক ময়েজউদ্দিন আন্দোলনরত অবস্থায় ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
যে জনপদে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম, সেই জনপদের জনসাধারণের কল্যাণসাধনে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি গ্রামবাসীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার অধিবাসীদের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদন কেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করেন। তিনি রোগীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সমন্বিত প্রকল্প হিসেবে তাঁর নিজ এলাকার ছয়টি গ্রামের গ্রামবাসীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তিনি বেকারত্ব হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানের জন্য তিনি বিদেশি দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর আন্তরিক যোগাযোগের ফলে এক বিদেশি দাতা সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে শহীদ ময়েজউদ্দিনের নিজ গ্রামে ১৯৮৩ সালে ৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি করে দেয়। শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আইন পেশা ও রাজনীতি- দুটিতেই সমান পারদর্শিতা, সমান কৃতিত্ব ও সমান একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৬৮ সাল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের মাধ্যমে বাংলার স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্তব্ধ করার চক্রান্ত শুরু করে। সে সময় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা ও সংগঠক কারাগারে। তখন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দেশব্যাপী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রচারে নেতৃত্বের ছাপ রাখেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জননেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন। তিনি ছিলেন বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহযোগী ও কর্মী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি আওয়ামী লীগের অনেক লিফলেট, সাংগঠনিক পেপার, অনেক বক্তব্যের খসড়া তৈরি করে দিতেন। লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন ও আইনজীবী থাকার কারণে তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ড্রাফট তৈরি করে দিতেন। তিনি গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে আসেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে সাধারণ সম্পাদক) তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে সার্বিক সহযোগিতাসহ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়। সেই উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তাজউদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধানে আস্থাবান রাজনৈতিক সহকর্মী মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, ঢাকায় তা তিনি নিজ চোখে অবলোকন করেন। এ অবস্থায় তিনি ও তাঁর পরিবার ঢাকা ত্যাগ করে নিজ গ্রাম বড়হরায় চলে আসে। এর পর বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার অভিপ্রায়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার উদ্দেশে রওনা হন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে তিনি সার্থক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। শত্রুমুক্ত ঢাকায় আসেন ১৮ ডিসেম্বর এবং ওই একই দিন বিকেলে ঢাকার জোনাকী সিনেমা হলে নাগরিক সভা আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন। ওই সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের ঢাকায় পেঁৗছতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে বিধায় আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার একটি সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর লক্ষ্যে এ নাগরিক সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সোনার বাংলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সাল। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ময়েজউদ্দিন আরো কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। তিনি অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে লিফলেট সাইক্লোস্টাইল করে শত শত কপি করার ব্যবস্থা নেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফ্রি-স্টাইলে চলাফেরা ও অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক সরকারের সময় এসব কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তারপর অক্টোবরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক বঙ্গভবনে আয়োজিত সভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে শহীদ ময়েজউদ্দিন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই প্রতিবাদের কারণে খুনিচক্র তাঁকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে। তিনি যে এত সাহসী ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন জীবনদানের মাধ্যমে।
শহীদ ময়েজউদ্দিনের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ, গাজীপুর
muktibang@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.