দিগ্ভ্রষ্ট রাজনীতি আর কতকাল? by হায়দার আকবর খান রনো
১০ সেপ্টেম্বর 'দিকভ্রষ্ট রাজনীতি'- এই
শিরোনামে কালের কণ্ঠে যে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, তার মর্মবস্তুর সঙ্গে
দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। তার আগের দিন একই কাগজে 'পথহারা রাজনীতি,
দিশেহারা মানুষ'- এই শিরোনামে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, সেখানেও চলতি
রাজনীতি ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দৈন্য দশা ফুটে উঠেছে।
সম্পাদকীয়তে বর্তমান শাসক আওয়ামী লীগ সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতা ও অপশাসন
এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে- 'একের পর এক
কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও ব্যর্থতার ঘটনায় বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের
জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। দলটি ক্ষমতায় আসার পর পরই শুরু হয় শেয়ার
কেলেঙ্কারির ঘটনা। শেয়ারবাজারে ব্যাপক ধস নামে। সেটি আরো দৃষ্টিকটু রূপ নেয়
শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতার
কারণে। তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করায় দেশের মানুষ
আরেকবার হোঁচট খায়। নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ এবং তৎপরবর্তী
লাগামহীন বক্তৃতা মানুষকে রীতিমতো আহত করেছে। এ ছাড়া সাবেক রেলমন্ত্রীর
এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া, সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার
কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাসহ স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার-সন্ত্রাস,
চাঁদাবাজি, গুম-খুন, ঘুষ-দুর্নীতি, টিআর-কাবিখাসহ উন্নয়ন বাজেটের টাকা
আত্মসাৎ, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি- এ
সবই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে।'
বর্তমান সরকারের এই ব্যর্থতা ও অপশাসনের বিপরীতে বিএনপি যে কোনো আশা-ভরসার জায়গা তৈরি করেছে, তেমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, মাত্র কয়েক বছর আগে সেই আমলের দুঃশাসন জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তা ছাড়াও বিএনপি কেবল তারেক জিয়ার মামলা প্রত্যাহার বা এ ধরনের কিছু ইস্যু সামনে রেখে এবং সরকারের কিছু সমালোচনা রেখে বক্তৃতা-বিবৃতি অথবা কখনো নিষ্প্রাণ হরতাল ডাকা ছাড়া জনগণের প্রকৃত ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কোনো বিকল্প কর্মসূচি তুলে ধরতে পারেনি। উপরন্তু জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষভাবে অবস্থান গ্রহণ দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ১৯৯০ সাল থেকে দেখে আসছি, দুটি বড় দল পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে জনগণের ভোটেই। বারবার হতাশ হয়েও জনগণ আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু এবার বোধ হয় তেমনটি আর হতে যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ প্রধান দুই দলের ওপরই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা সত্যিকারের বিকল্পের সন্ধান করছে।
শাসক দল আওয়ামী লীগের 'জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায়'। সম্পাদকীয়তে এই অভিমতই প্রকাশ করা হয়েছে। আর এরূপ বক্তব্যের সপক্ষে সাম্প্রতিক আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি। বলা বাহুল্য, ঘটনাটি মোটেই তুচ্ছ নয়। আমার মনে পড়ছে, সত্তরের দশকের শেষদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সাত্তার সাহেবের শাসনামলে যখন রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন দুজন খুবই প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রিসভা থেকে সরে পড়লেন। সেই সময় অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, 'ডুবন্ত জাহাজ থেকে দুটি ইঁদুর ছিটকে পড়েছে।' এবারও মনে হচ্ছে দুজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা আর ডুবন্ত জাহাজে উঠতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
রাশেদ খান মেনন স্বীকার করেছেন, আগে মন্ত্রিত্বের অফার পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু এখন আর নয়। সম্ভবত তোফায়েল আহমেদের বেলায় ঘটনাটি একই। শেষ বেলায় তিনি আর মন্ত্রী হতে চাননি। অবশ্য কালের কণ্ঠের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তোফায়েল আহমেদের এই ভূমিকাকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে 'দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন' এবং 'দলের সিদ্ধান্তকে অপমানিত করেছেন'। কিন্তু দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে এই প্রশ্নের অন্যভাবে উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যেহেতু তিনি নিজে সরাসরি নির্দেশ দেননি, একজন সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, সেহেতু তোফায়েল আহমেদ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেননি। এমনকি বিষয়টিকে তিনি একেবারে গুরুত্বহীনরূপে দেখানোর চেষ্টাও করেছেন। তিনি বলেছেন, সাতজন নতুন মন্ত্রী করা দরকার ছিল। সাতজন হয়ে গেছে। ব্যস! তাহলে আর সমস্যা কি? যেন যাকে-তাকে দিয়ে মন্ত্রীর কোটা পূরণ করলেই হলো। সেখানে মন্ত্রীর গুণগত মান কোনো বিবেচনার বিষয় না। আমি সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে যাই, এভাবেই কি সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠিত হয়!
আমাকে আরো বিস্মিত করেছিল, যখন জানতে পারলাম যে যাঁকে মন্ত্রী করা হবে, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন না। সচিবকে দিয়ে জানানো হয় যে 'আপনাকে মন্ত্রী করা হলো।' যেন কোনো আমলা বা অফিসের বড় 'বস' কাউকে নিম্নতর কোনো পদে চাকরিতে নিয়োগ প্রদান করছেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের খবরটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জানান। এটাই নাকি রেওয়াজ এবং এখনই শুধু নয়, আগের থেকেই, সব আমলে এটাই নাকি হয়ে আসছে। এখন বুঝতে পারছি, গণতন্ত্র কেন এই দেশে বিকশিত হয়নি।
সত্যি কথা, আমি এই রেওয়াজের কথা জানতাম না। এরূপ রেওয়াজ থেকে বোঝা যায় যে মন্ত্রিসভা যে একটা টিম হিসেবে কাজ করে না। আমার ধারণা ছিল, এ রকম- মন্ত্রিসভা কেমন হবে, সে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ সংস্থায় গভীরভাবে আলোচিত হয়। তা যদি না-ও হয়, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী সম্ভাব্য মন্ত্রীদের ডেকে নিয়ে আলোচনা করবেন। আর তাঁদের সম্মতি তো লাগবেই। কিন্তু এখন যে রেওয়াজের কথা শুনছি, সেটা আর যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়। এই প্রথা প্রধানমন্ত্রীকে রাজা-বাদশা বা ডিক্টেটরের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। আর বাকি সবাই যেন তাঁর আজ্ঞাবহ ভৃত্যমাত্র। এটাই চলে আসছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সামরিক শাসক এরশাদ- সব আমলেই।
আমার তো মনে হয়, কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদের উচিত হবে না, সচিবের মাধ্যমে পাঠানো খবরের ভিত্তিতে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শপথ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করা। অবশ্য যাঁরা আমলা অথবা ব্যবসায়ী থেকে সদ্য রাজনীতিবিদ হয়েছেন, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। এই আমলে এবং পূর্ববর্তী বিএনপি আমলে এমন সাবেক আমলা ও কোটি কোটি টাকার মালিক ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য বেশি। পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদের প্রাধান্য কমে গেছে। দেশের দুর্ভাগ্যের জন্য এটাও দায়ী।
রাশেদ খান মেনন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রিত্বের অফার এসেছিল বলে তিনি অপমানবোধ করেছেন, তাই তিনি তা গ্রহণ করেননি। রাশেদ খান মেনন বা হাসানুল হক ইনু অন্য দলের নেতা। তাঁরা নিজ নিজ দলের সর্বোচ্চ নেতা। তাঁদের মন্ত্রী বানানোর আগে প্রধানমন্ত্রী কি একবারও তাঁদের সঙ্গে কথা বলে নেবেন না? নাকি ধরেই নেওয়া হয়েছে যে মন্ত্রিত্বের টোপ তো গিলবেই। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে।
মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে এই যে আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, তা-ও এই দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বলে আমার মনে হয়। এই একই আচরণ করে এসেছেন বর্তমানের বা অতীতের প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানরা। এ ধরনের আচরণ এক বিশেষ মানসিকতার পরিচয় বহন করে, যা গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিপন্থী। এসব কারণেই বড় বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, আর একই কারণে দেশেও গণতন্ত্র নেই। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে পরিবারতন্ত্র। এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়তে তাই সঠিকভাবেই বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে.... রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি মানুষকে খুব একটা আকৃষ্ট করছে না।'
সাধারণ মানুষ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। বিকল্পের সন্ধানে রয়েছে তারা। কিন্তু কোথায় বিকল্প? গত দুই দশক জনগণ বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে বড় দুই দলের কোনো একটিকে। বিএনপির বিকল্প আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। এখন উভয়ের বিকল্প খুঁজছেন তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখনো কোনো দৃশ্যমান বিকল্প নেই। এই দুই দলের বিকল্প হিসেবে কখনো আসছে সেনা শাসন, অথবা এক-এগারোর মতো কোনো সরকার। কখনো কখনো সুশীল সমাজের বিকল্পের কথা বাতাসে ভাসে।
কিন্তু এসব তথাকথিত বিকল্প স্বাভাবিক কারণেই কোনো আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে না। অরাজনৈতিক বিকল্প কোনো বিকল্প নয়। অগণতান্ত্রিক কোনো শাসনব্যবস্থাও বিকল্প হতে পারে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিকল্পকে হতে হবে রাজনৈতিক বিকল্প। সেই বিকল্পের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে বিকল্প নেতৃত্ব ও বিকল্প আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি। এ পর্যন্ত যেসব বিকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো, তারা কেউই ভিন্নতর উন্নয়ন দর্শন এবং বিকল্প আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি তুলে ধরতে পারেনি। তারা সবাই একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃত্ত ভাঙারও কোনো উদ্যোগ নেই। সেই বৃত্তটি হচ্ছে পুঁজিবাদের বৃত্ত। সাম্রাজ্যবাদনির্ভর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলিত বৃত্ত, যা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সৃষ্টি করে, দারিদ্র্যকে অধিকতর গভীর ও প্রসারিত করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, রাজনীতিকে কলুষিত করে। সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ বহুজাতিক করপোরেশনের লুণ্ঠন অব্যাহত রেখে সুশীল সমাজের এনজিও মার্কা উন্নয়ন দর্শন অথবা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে প্রতারণা অথবা তথাকথিত সামাজিক ব্যবসার নামে উদ্ভট অবাস্তব প্রস্তাবনা- সবটাই একই বৃত্তের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা কখনোই প্রকৃত বিকল্প হতে পারে না।
পুঁজিবাদ ও বাজার-অর্থনীতিভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের বাইরে এসে সত্যিকারের বিকল্প হতে পারে বাম গণতান্ত্রিক কর্মসূচিভিত্তিক বিকল্প, যা বিকশিত করে তুলবে নতুন ধারার রাজনীতি। এই কর্মসূচির মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী, গরিব অভিমুখী, সত্যিকারের উন্নয়ন অভিমুখী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান। এর মধ্যে অবশ্যই থাকবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান। এই বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পের সম্ভাবনা এখনো দৃশ্যমান নয়। কারণ কমিউনিস্ট ও বাম দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি এখনো যথেষ্ট নয়। কিন্তু তারা ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। বুর্জোয়া জৌলুস, অর্থের দাপট, বিদেশি শক্তির অপতৎপরতা এবং বুর্জোয়া প্রচারের ধাঁধায় দেশবাসী এখনো বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পকে ভালোভাবে দেখতে পারছে না। তবে যত দিন দেখতে না পারবে, তত দিন দুর্ভাগ্যের বোঝা বয়ে বেড়াতেই হবে। এ জন্য কমিউনিস্ট ও বাম নেতৃত্বকে যেমন সাহস ও যোগ্যতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যাখ্যা করতে হবে বিকল্প কর্মসূচি, দৃঢ়তার সঙ্গে শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলে মেহনতি মধ্যবিত্তের শক্তিভিত গড়ে তুলতে হবে, তেমনই দেশের সৎ, দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে, পুরনো পরীক্ষিত ব্যর্থ পথ পরিত্যাগ করে বাম গণতান্ত্রিক বলয়কে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, প্রগতিশীল পতাকার তলে সমবেত হতে হবে। বিকল্প মানে কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তনই নয়, আদর্শের ও কর্মসূচিরও বিকল্প।
লেখক : রাজনীতিবিদ
বর্তমান সরকারের এই ব্যর্থতা ও অপশাসনের বিপরীতে বিএনপি যে কোনো আশা-ভরসার জায়গা তৈরি করেছে, তেমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, মাত্র কয়েক বছর আগে সেই আমলের দুঃশাসন জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তা ছাড়াও বিএনপি কেবল তারেক জিয়ার মামলা প্রত্যাহার বা এ ধরনের কিছু ইস্যু সামনে রেখে এবং সরকারের কিছু সমালোচনা রেখে বক্তৃতা-বিবৃতি অথবা কখনো নিষ্প্রাণ হরতাল ডাকা ছাড়া জনগণের প্রকৃত ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কোনো বিকল্প কর্মসূচি তুলে ধরতে পারেনি। উপরন্তু জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষভাবে অবস্থান গ্রহণ দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ১৯৯০ সাল থেকে দেখে আসছি, দুটি বড় দল পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে জনগণের ভোটেই। বারবার হতাশ হয়েও জনগণ আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু এবার বোধ হয় তেমনটি আর হতে যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ প্রধান দুই দলের ওপরই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তারা সত্যিকারের বিকল্পের সন্ধান করছে।
শাসক দল আওয়ামী লীগের 'জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায়'। সম্পাদকীয়তে এই অভিমতই প্রকাশ করা হয়েছে। আর এরূপ বক্তব্যের সপক্ষে সাম্প্রতিক আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি। বলা বাহুল্য, ঘটনাটি মোটেই তুচ্ছ নয়। আমার মনে পড়ছে, সত্তরের দশকের শেষদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সাত্তার সাহেবের শাসনামলে যখন রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন দুজন খুবই প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রিসভা থেকে সরে পড়লেন। সেই সময় অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, 'ডুবন্ত জাহাজ থেকে দুটি ইঁদুর ছিটকে পড়েছে।' এবারও মনে হচ্ছে দুজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা আর ডুবন্ত জাহাজে উঠতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
রাশেদ খান মেনন স্বীকার করেছেন, আগে মন্ত্রিত্বের অফার পেলে তিনি তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু এখন আর নয়। সম্ভবত তোফায়েল আহমেদের বেলায় ঘটনাটি একই। শেষ বেলায় তিনি আর মন্ত্রী হতে চাননি। অবশ্য কালের কণ্ঠের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তোফায়েল আহমেদের এই ভূমিকাকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে 'দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন' এবং 'দলের সিদ্ধান্তকে অপমানিত করেছেন'। কিন্তু দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে এই প্রশ্নের অন্যভাবে উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যেহেতু তিনি নিজে সরাসরি নির্দেশ দেননি, একজন সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, সেহেতু তোফায়েল আহমেদ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেননি। এমনকি বিষয়টিকে তিনি একেবারে গুরুত্বহীনরূপে দেখানোর চেষ্টাও করেছেন। তিনি বলেছেন, সাতজন নতুন মন্ত্রী করা দরকার ছিল। সাতজন হয়ে গেছে। ব্যস! তাহলে আর সমস্যা কি? যেন যাকে-তাকে দিয়ে মন্ত্রীর কোটা পূরণ করলেই হলো। সেখানে মন্ত্রীর গুণগত মান কোনো বিবেচনার বিষয় না। আমি সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে যাই, এভাবেই কি সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠিত হয়!
আমাকে আরো বিস্মিত করেছিল, যখন জানতে পারলাম যে যাঁকে মন্ত্রী করা হবে, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন না। সচিবকে দিয়ে জানানো হয় যে 'আপনাকে মন্ত্রী করা হলো।' যেন কোনো আমলা বা অফিসের বড় 'বস' কাউকে নিম্নতর কোনো পদে চাকরিতে নিয়োগ প্রদান করছেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের খবরটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জানান। এটাই নাকি রেওয়াজ এবং এখনই শুধু নয়, আগের থেকেই, সব আমলে এটাই নাকি হয়ে আসছে। এখন বুঝতে পারছি, গণতন্ত্র কেন এই দেশে বিকশিত হয়নি।
সত্যি কথা, আমি এই রেওয়াজের কথা জানতাম না। এরূপ রেওয়াজ থেকে বোঝা যায় যে মন্ত্রিসভা যে একটা টিম হিসেবে কাজ করে না। আমার ধারণা ছিল, এ রকম- মন্ত্রিসভা কেমন হবে, সে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ সংস্থায় গভীরভাবে আলোচিত হয়। তা যদি না-ও হয়, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী সম্ভাব্য মন্ত্রীদের ডেকে নিয়ে আলোচনা করবেন। আর তাঁদের সম্মতি তো লাগবেই। কিন্তু এখন যে রেওয়াজের কথা শুনছি, সেটা আর যা-ই হোক, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়। এই প্রথা প্রধানমন্ত্রীকে রাজা-বাদশা বা ডিক্টেটরের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। আর বাকি সবাই যেন তাঁর আজ্ঞাবহ ভৃত্যমাত্র। এটাই চলে আসছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সামরিক শাসক এরশাদ- সব আমলেই।
আমার তো মনে হয়, কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদের উচিত হবে না, সচিবের মাধ্যমে পাঠানো খবরের ভিত্তিতে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শপথ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করা। অবশ্য যাঁরা আমলা অথবা ব্যবসায়ী থেকে সদ্য রাজনীতিবিদ হয়েছেন, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। এই আমলে এবং পূর্ববর্তী বিএনপি আমলে এমন সাবেক আমলা ও কোটি কোটি টাকার মালিক ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য বেশি। পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদের প্রাধান্য কমে গেছে। দেশের দুর্ভাগ্যের জন্য এটাও দায়ী।
রাশেদ খান মেনন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রিত্বের অফার এসেছিল বলে তিনি অপমানবোধ করেছেন, তাই তিনি তা গ্রহণ করেননি। রাশেদ খান মেনন বা হাসানুল হক ইনু অন্য দলের নেতা। তাঁরা নিজ নিজ দলের সর্বোচ্চ নেতা। তাঁদের মন্ত্রী বানানোর আগে প্রধানমন্ত্রী কি একবারও তাঁদের সঙ্গে কথা বলে নেবেন না? নাকি ধরেই নেওয়া হয়েছে যে মন্ত্রিত্বের টোপ তো গিলবেই। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে।
মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে এই যে আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, তা-ও এই দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বলে আমার মনে হয়। এই একই আচরণ করে এসেছেন বর্তমানের বা অতীতের প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানরা। এ ধরনের আচরণ এক বিশেষ মানসিকতার পরিচয় বহন করে, যা গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিপন্থী। এসব কারণেই বড় বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, আর একই কারণে দেশেও গণতন্ত্র নেই। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে পরিবারতন্ত্র। এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়তে তাই সঠিকভাবেই বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে.... রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি মানুষকে খুব একটা আকৃষ্ট করছে না।'
সাধারণ মানুষ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। বিকল্পের সন্ধানে রয়েছে তারা। কিন্তু কোথায় বিকল্প? গত দুই দশক জনগণ বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে বড় দুই দলের কোনো একটিকে। বিএনপির বিকল্প আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। এখন উভয়ের বিকল্প খুঁজছেন তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখনো কোনো দৃশ্যমান বিকল্প নেই। এই দুই দলের বিকল্প হিসেবে কখনো আসছে সেনা শাসন, অথবা এক-এগারোর মতো কোনো সরকার। কখনো কখনো সুশীল সমাজের বিকল্পের কথা বাতাসে ভাসে।
কিন্তু এসব তথাকথিত বিকল্প স্বাভাবিক কারণেই কোনো আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে না। অরাজনৈতিক বিকল্প কোনো বিকল্প নয়। অগণতান্ত্রিক কোনো শাসনব্যবস্থাও বিকল্প হতে পারে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিকল্পকে হতে হবে রাজনৈতিক বিকল্প। সেই বিকল্পের মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে বিকল্প নেতৃত্ব ও বিকল্প আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি। এ পর্যন্ত যেসব বিকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো, তারা কেউই ভিন্নতর উন্নয়ন দর্শন এবং বিকল্প আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি তুলে ধরতে পারেনি। তারা সবাই একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃত্ত ভাঙারও কোনো উদ্যোগ নেই। সেই বৃত্তটি হচ্ছে পুঁজিবাদের বৃত্ত। সাম্রাজ্যবাদনির্ভর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলিত বৃত্ত, যা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সৃষ্টি করে, দারিদ্র্যকে অধিকতর গভীর ও প্রসারিত করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, রাজনীতিকে কলুষিত করে। সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ বহুজাতিক করপোরেশনের লুণ্ঠন অব্যাহত রেখে সুশীল সমাজের এনজিও মার্কা উন্নয়ন দর্শন অথবা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে প্রতারণা অথবা তথাকথিত সামাজিক ব্যবসার নামে উদ্ভট অবাস্তব প্রস্তাবনা- সবটাই একই বৃত্তের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা কখনোই প্রকৃত বিকল্প হতে পারে না।
পুঁজিবাদ ও বাজার-অর্থনীতিভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের বাইরে এসে সত্যিকারের বিকল্প হতে পারে বাম গণতান্ত্রিক কর্মসূচিভিত্তিক বিকল্প, যা বিকশিত করে তুলবে নতুন ধারার রাজনীতি। এই কর্মসূচির মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী, গরিব অভিমুখী, সত্যিকারের উন্নয়ন অভিমুখী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপাদান। এর মধ্যে অবশ্যই থাকবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক উপাদান। এই বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পের সম্ভাবনা এখনো দৃশ্যমান নয়। কারণ কমিউনিস্ট ও বাম দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি এখনো যথেষ্ট নয়। কিন্তু তারা ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। বুর্জোয়া জৌলুস, অর্থের দাপট, বিদেশি শক্তির অপতৎপরতা এবং বুর্জোয়া প্রচারের ধাঁধায় দেশবাসী এখনো বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পকে ভালোভাবে দেখতে পারছে না। তবে যত দিন দেখতে না পারবে, তত দিন দুর্ভাগ্যের বোঝা বয়ে বেড়াতেই হবে। এ জন্য কমিউনিস্ট ও বাম নেতৃত্বকে যেমন সাহস ও যোগ্যতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যাখ্যা করতে হবে বিকল্প কর্মসূচি, দৃঢ়তার সঙ্গে শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলে মেহনতি মধ্যবিত্তের শক্তিভিত গড়ে তুলতে হবে, তেমনই দেশের সৎ, দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে, পুরনো পরীক্ষিত ব্যর্থ পথ পরিত্যাগ করে বাম গণতান্ত্রিক বলয়কে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, প্রগতিশীল পতাকার তলে সমবেত হতে হবে। বিকল্প মানে কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তনই নয়, আদর্শের ও কর্মসূচিরও বিকল্প।
লেখক : রাজনীতিবিদ
No comments