শিডিউল নড়বড়ে, নাসে নাজেহাল হজযাত্রীরা by মোশতাক আহমদ
ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ার কারণে প্রতিদিন বিমানবন্দরে আটকা পড়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন শত শত হজযাত্রী। এ অবস্থা বাড়তে থাকলে হজ পরিবহন ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গতকাল মঙ্গলবারও সৌদি আরবের বিমান সংস্থা নাস এয়ারের একাধিক হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শত শত হজযাত্রী আটকা পড়েন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৪৯৯ জন হজযাত্রী নিয়ে নাস এয়ারের একটি হজ ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্তও তা বিমানবন্দর ত্যাগ করেনি।আশকোনা হজ ক্যাম্পের কর্মকর্তা বজলুল হক বিশ্বাস বলেন, নাস এয়ারের আজকের (মঙ্গলবার) ফ্লাইটটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। আজ ভোরে তা ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। আজ বুধবার ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে নাস এয়ারের আরেকটি হজ ফ্লাইট ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে এ ফ্লাইটটিও যথাসময়ে ছাড়বে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা বাংলাদেশ বিমান ও বিমান মন্ত্রণালয়কে নাস এয়ারের ব্যাপারে আগেই সতর্ক করেছিলাম। বিমান মন্ত্রণালয় আমাদের কথা রাখেনি।' এভাবে হজ ফ্লাইট দেরি হতে থাকলে হজযাত্রী পরিবহনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আশকোনা হজ ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, সৌদি বিমান সংস্থা নাস এয়ারের মাধ্যমে হজ ফ্লাইট পরিচালনা গত রবিবার থেকে শুরু হয়। শুরুর দিনেই শিডিউলে থাকা হজ ফ্লাইটটি নির্দিষ্ট সময়ের ১১ ঘণ্টা পরে ঢাকা ত্যাগ করে। সেদিনও দুর্ভোগে পড়েন শত শত হজযাত্রী।
বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, নাস এয়ারওয়েজের পাঁচটি ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে গতকাল পর্যন্ত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৮০ জন হজযাত্রী আটকা পড়েছেন। বিমানবন্দরের বহির্গমন লাউঞ্জের মেঝেতে এসব যাত্রী চাদর ও মাদুর বিছিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করে ফ্লাইটের অপেক্ষা করছেন। তাঁদের মধ্যে মহিলা যাত্রীও রয়েছেন।
এ বছর মোট এক লাখ সাড়ে ১২ হাজার হজযাত্রী সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া তিনটি বিমান সংস্থার হজ ফ্লাইটে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ১৬ হাজার হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন।
বিমানের ফ্লাইটও ঢিলে হচ্ছে : নাস এয়ারের পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের হজ ফ্লাইটও দেরিতে ঢাকা ত্যাগ করছে। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে হজ ফ্লাইট শুরুর পর বেশ কয়েকটি ফ্লাইট দেরিতে ঢাকা ত্যাগ করেছে। ফলে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের।
জানা গেছে, শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ গত ২২ সেপ্টেম্বর দুটি শিডিউল ফ্লাইটে পরিবর্তন আনে। গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে (বিজি-৩০২৩) হজ ফ্লাইটটি সকাল ৮টায় ছাড়ার কথা ছিল; কিন্তু শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ওই ফ্লাইটটি ২৭ ঘণ্টা পরে ঢাকা ছাড়ে। একইভাবে ২২ সেপ্টেম্বরের অন্য একটি হজ ফ্লাইট (বিজি-৩০২৫) নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি। ওই ফ্লাইটটি ঢাকা ছাড়ে ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৪টায়।
বিমানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এমনিতেই আমাদের উড়োজাহাজের সংকট রয়েছে। সেই সঙ্গে বিমান নিজস্ব এয়ারক্র্যাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।' তিনি বলেন, একটি হজ ফ্লাইটে দেরি হলে তা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। এটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে না।
দুই হাজার হজযাত্রী সন্দেহভাজন : চলতি হজ মৌসুমে প্রায় দুই হাজার হজযাত্রীকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে হজ ফ্লাইট শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৫০০ সন্দেহভাজন ব্যক্তির হজযাত্রা বাতিল করা হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষের সন্দেহভাজন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স না থাকায় প্রায় ২২ হাজার হজযাত্রীর ভিসা ইস্যু করা যাচ্ছে না বলে আশকোনা হজ ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ এক লাখ ১২ হাজার হজযাত্রীর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৯০ হাজার ভিসা ইস্যু করেছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন।
হাজি ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত, হজ পালনের জন্য পর্যাপ্ত বয়স না হওয়া, ব্যাংক তালিকার সঙ্গে এজেন্সির হজযাত্রীর তালিকায় গরমিল থাকা এবং রোহিঙ্গা হিসেবে তাঁদের সন্দেহভাজনরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কালোবাজারে টিকিট : এদিকে হজের টিকিট নিয়ে বিভিন্ন এজেন্সির দৌরাত্ম্যের খবর পাওয়া গেছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না অসাধু এজেন্টদের দৌরাত্ম্য। সরকার নির্ধারিত দামে হজের টিকিট পাচ্ছেন না অনেকে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে হজের বেশির ভাগ টিকিট। এ অবস্থায় ওই সিন্ডিকেট টিকিটপ্রতি গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার ১০ হাজার টাকা দিয়েও টিকিট কিনেছেন। যাত্রীরা মনোপলি ব্যবসার শিকার হচ্ছেন সাউদিয়া ও নাস এয়ারলাইনসের টিকিট কিনতে গিয়ে। একইভাবে বাংলাদেশ বিমানের টিকিট কিনতে গিয়েও নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হজযাত্রীদের। সরকার হজের ব্যাপারে যেকোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পেলে 'জিরো টলারেন্স' দেখানোর ঘোষণা দিলেও প্রকাশ্যে চলছে টিকিট কালোবাজারি। ধর্মমন্ত্রী, বিমানমন্ত্রী ও হজ অফিসারদের কেউই দায়িত্ব নিতে রাজি নন। বিমানমন্ত্রী ফারুক খান বলেছেন, 'সাউদিয়া ও নাস হলো বিদেশি এয়ারলাইনস। তাদের বিজনেস পলিসির ওপর আমরা হস্তক্ষেপ করতে চাই না।' ধর্মমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া বলেছেন, 'এয়ারলাইনস দেখার দায়িত্ব আমার নয়।' আর হজ টাস্কফোর্সের প্রধান জয়নাল আবেদীন তাঁর নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, লিখিত অভিযোগ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
জানা যায়, এবার সাউদিয়া এয়ারলাইনস ও নাস এয়ার কর্তৃপক্ষ তাদের সব টিকিট তুলে দিয়েছে মাত্র ৯টি ট্রাভেল এজেন্টের হাতে। তাদের নিজেদের কাছেও কোনো টিকিট নেই। সাউদিয়া এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রি করছে পাঁচটি ট্রাভেল এজেন্ট আর নাসের টিকিট বিক্রি করছে চারটি এজেন্ট। সাউদিয়া এয়ারলাইনসের মনোনীত ট্রাভেল এজেন্টরা হলো- সুরেশ্বর ট্রভেল, সানজেরি ট্রাভেল, আল গাজী ট্রাভেল, মনা ট্রাভেল ও ডাইনেস্টি ট্রাভেল। অন্যদিকে নাস এয়ারের টিকেট বিক্রির দ্বায়িত্ব পেয়েছে এয়ারট্রিপ, কাজী এয়ার, সানজেরি ও মেগা টব।
No comments