ষষ্ঠবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার by আরিফুজ্জামান তুহিন
গণশুনানি ছাড়াই বর্তমান সরকারের মেয়াদে ষষ্ঠবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্য বৃদ্ধির এই ঘোষণা দিয়েছে। এবার খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিটে গড়ে ৭৫ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে।
পাশাপাশি তিনটি ধাপ (স্লাব) ভেঙে ছয়টি করা হয়েছে। বর্ধিত দাম কার্যকর হবে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসি কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এবার গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। প্রতি ইউনিটের গড় খুচরা মূল্য পাঁচ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াল পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। সে হিসাবে যে পরিবারে আগের মাসে ৫০০ টাকা বিল এসেছে, একই পরিমাণ বিদ্যুতের বিল হিসাবে আগামী মাসে তাদের পরিশোধ করতে হবে বাড়তি ৭৫ টাকা।বর্তমান সরকারের মেয়াদে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ে মার্চ মাসে। সেবার বিদ্যুতের ধাপ নিয়মে গ্রাহকদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে ইউনিট অতিক্রম করলে গোটা ইউনিটের বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হতো বর্ধিত ধাপ অনুযায়ী। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিইআরসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার তিনটি ধাপকে বাড়িয়ে ছয়টি করা হয়েছে। কেউ কোনো ধাপ অতিক্রম করলে তিনি প্রতিটি ধাপের মূল্য সুবিধা পাবেন।
গণশুনানি না করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কতটুকু যৌক্তিক জানতে চাইলে বিইআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেন, 'স্লাব ভেঙে দেওয়া আমাদের কাছে বড় ধরনের একটি ব্যাপার ছিল। আর গণশুনানি করতে গেলে আরো দুই মাস সময় লেগে যেত। তাতে সরকার অনেক বেশি আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ত। তা ছাড়া এই দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে তিন হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।'
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান 'এনার্জি সাপোর্ট ফান্ড' গঠনের ঘোষণা দেন। এই ফান্ড লাভজনক বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানির নিট লাভের একটি অংশ দিয়ে অলাভজনক বিতরণ সংস্থার ঘাটতি মেটাতে কাজ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ইমদাদুল হক, দেলোয়ার হোসেন ও ড. সেলিম মাহমুদ।
এদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণশুনানি না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোটা বেআইনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার তুহিন মালিক বলেন, 'কমিশন যে পদ্ধতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, দেশে কোনো আইন নেই। তারা আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। কমিশন এর আগেও আইনের লঙ্ঘন করেছে। বিষয়টিতে উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত।'
ভোক্তা অধিকার রক্ষা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি স্পষ্টত আইনের পরিপন্থী। এভাবে চলতে থাকলে বিইআরসি দ্রুতই তার কার্যকারিকতা হারাবে।'
এবারও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) গ্রাহকদের বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। নতুন মূল্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কৃষিকাজের জন্য আরইবির গ্রাহকদের কিনতে হবে তিন টাকা ৭৬ পয়সা আর অন্যান্য কম্পানির কৃষকদের দুই টাকা ৫১ পয়সায়। এ ছাড়া প্রথম স্লাবেই আরইবির গ্রাহকরা অন্য গ্রাহকদের থেকে ইউনিটপ্রতি ৩৩ পয়সা বেশি দিয়ে বিদ্যুৎ কিনবেন।
বিদ্যুতের ঘোষিত বর্ধিত মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার সবচেয়ে বেশি বৈষম্য হয়েছে ৪ নম্বর ধাপে। এই ধাপে আরইবির গ্রাহকরা ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ কিনবেন সাত টাকা এক পয়সা হারে। আর অন্যান্য বিতরণ কম্পানির বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম দিতে হবে চার টাকা ৯৩ পয়সা। আর শিল্পে গড়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ, যা ইউনিটপ্রতি সব বিতরণ কম্পানির গ্রাহকদের ক্ষেত্রে পড়বে ৯ টাকা।
খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ার পাশাপাশি পাইকারি বিদ্যুতের দামও বেড়েছে গড়ে ১৬.৯২ শতাংশ। পাইকারি দাম চার টাকা দুই পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়াল চার টাকা ৭০ পয়সা।
ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে প্রথমবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ২০১০ সালের মার্চ মাসে। এরপর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বর, ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এবং গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার।
মূল্য তালিকা : প্রথম ধাপে (০-৭৫ ইউনিট) আরইবি থেকে বিদ্যুৎ নিতে গ্রাহককে ইউনিটপ্রতি তিন টাকা ৬৬ পয়সা এবং অন্য সব সংস্থা থেকে নিলে তিন টাকা ৩৩ পয়সা দিতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে (৭৬-২০০) আরইবিতে দাম পড়বে চার টাকা ৩৭ পয়সা এবং অন্যান্য সংস্থায় চার টাকা ৭৩ পয়সা। তৃতীয় ধাপে (২০১-৩০০) আরইবিতে ইউনিটপ্রতি দাম চার টাকা ৫১ পয়সা এবং অন্য সব সংস্থায় চার টাকা ৮৩ পয়সা। চতুর্থ ধাপে (৩০১-৪০০) আরইবিতে দাম সাত টাকা ১০ পয়সা এবং অন্য সংস্থার জন্য চার টাকা ৯৩ পয়সা। পঞ্চম ধাপে (৪০১-৬০০) আরইবিতে সাত টাকা ৪০ পয়সা এবং অন্যদের জন্য পড়বে সাত টাকা ৯৮ পয়সা। বর্তমানে ষষ্ঠ ধাপে (৬০০ থেকে ওপরে) আরইবিসহ সব সংস্থায় পড়বে ৯ টাকা ৩৮ পয়সা।
No comments