সাক্ষাৎকারে স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত-বাংলাদেশে স্টিল মিলসহ নানা খাতেই বিনিয়োগ করা যায় by আবুল কাশেম
বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী ইউরোপের দেশ স্লোভাকিয়া। দেশটির এ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রদূত মারিয়ান তমাসিক বাংলাদেশে এসে সে লক্ষ্যে কাজও এগিয়ে নিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়াতে তিনি বৈঠক করেছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে।
মারিয়ান তমাসিক আজ শনিবার সকালে ঢাকা ছাড়ছেন। এর আগে গতকাল শুক্রবার দুপুরে গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়ে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন।বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের দায়িত্বে থাকা স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত মারিয়ান তমাসিক ভুটানের সঙ্গেও তাঁর নিজের দেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই শতাব্দী এশিয়ার উন্নয়নের। চীন, ভারত, জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে তাঁর দেশ। স্লোভাকিয়ায় ১০ কোটি ইউরোরও বেশি পণ্য রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। তবে এখানে স্লোভাকিয়ার পণ্য তেমন আসছে না।
দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানো প্রসঙ্গে মারিয়ান তমাসিক বলেন, 'আমরা রাজনৈতিক সংলাপের চেয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ ও উন্নয়নের ওপর সর্বাত্মক গুরুত্ব দিচ্ছি। বাংলাদেশ ও স্লোভাকিয়ার উদ্যোক্তারা কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত করতে পারেন তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেছি। যৌথ বাণিজ্যিক কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার চেষ্টা চলছে। স্লোভাকিয়ার বিভিন্ন কম্পানির শাখা অফিস বাংলাদেশে খুলে বিনিয়োগ করবে- এমন আগ্রহ রয়েছে আমাদের। বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যও রয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগিতায় স্টিল মিলসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি পণ্য আমদানি করতে চায় স্লোভাকিয়া। এ জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য আমদানির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।'
মারিয়ান তমাসিক আরো বলেন, 'আগামী অক্টোবরে স্লোভাকিয়া থেকে আরেকটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে এ আলোচনা আরো এগিয়ে নেবে।' তিনি বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। আর বাংলাদেশ আমদানি করছে সামান্য প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ও রাসায়ানিক পণ্য। বাংলাদেশে আমাদের রপ্তানি খুব একটা নেই। এ দেশে রপ্তানি বাড়াতে চেষ্টা করছি আমরা।' বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এই কূটনীতিক। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই বাংলাদেশ পরবর্তী এশিয়ান টাইগার।
বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উল্লেখ করে মারিয়ান তমাসিক বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থাতেই দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে স্লোভাকিয়ার দূতাবাস নেই। মূলত অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই এ দেশে আলাদা কোনো দূতাবাস খোলা হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও এখানে দূতাবাস হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন অনারারি কনস্যুলেট ঢাকায় খুবই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন।
স্লোভাকিয়া স্থলবেষ্টিত একটি দেশ। তবে পোল্যান্ড ও জার্মানির হামবুর্গ বন্দরের মাধ্যমেই তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন হচ্ছে। স্থলবেষ্টিত এ দেশটির ভেতরের সব অঞ্চল দিয়েই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। এটি ইউরোপের নতুন প্রজন্মের বড় সাফল্য। বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন মারিয়ান তমাসিক। তিনি স্লোভাকিয়ার মতো ট্রানজিট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশও সার্ক অঞ্চলের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হতে পারে। তবে কাজটি অত্যন্ত জটিল বলেও তিনি স্বীকার করেন।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে স্লোভাকিয়া একটি উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চায় উল্লেখ করে মারিয়ান তমাসিক বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছা নেই। তবে সরকারের ইতিবাচক বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচিকে সমর্থন করে স্লোভাকিয়া। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি এর সঙ্গে পরিচিত। সম্প্রতি বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে নোবেলজয়ী গ্রামীণ ব্যাংক অত্যন্ত ভালো একটি প্রকল্প।' মন্দার মধ্যেই স্লোভাকিয়ার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশটিতে বেকারত্বও রয়েছে। মন্দার কারণে বেকারত্বের হার প্রায় ৬ শতাংশ। তাই আপাতত বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ইচ্ছা নেই তাঁর দেশের।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার ক্ষেত্রে স্লোভাকিয়ার সমর্থন পাওয়া যাবে কি না এমন এক প্রশ্নের উত্তরে এই কূটনীতিক বলেন, 'আমি বাংলা ভাষার প্রশংসা করি। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তা সত্ত্বেও আমি চাই না জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার সংখ্যা বর্তমান পাঁচটি থেকে আরো বাড়ুক। কারণ এতে বিভিন্ন কারিগরি সমস্যা দেখা দেয়।'
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত সিনেমা তৈরির প্রেক্ষাপটে লিবিয়ায় মার্কিন কূটনীতিক নিহত হওয়ার ঘটনাও উঠে আসে স্লোভাকিয়ার এই রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে। তিনি বলেন, লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা অবশ্যই অপরাধ। উগ্রপন্থী কয়েকজন লোকের খুব ছোট একটা গ্রুপ এ অপরাধ ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে লিবিয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'এ ধরনের বিতর্কিত সিনেমা তৈরি করাটাও জ্ঞানহীন ও বিবেকহীনের মতো কাজ। কিন্তু সে জন্য একজন নির্দোষ রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা যায় না।' 'বিভিন্ন দেশে এসব বিষয় নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ খুবই সহনীয় ভূমিকা পালন করছে। এটাই বাংলাদেশের মহত্ত্বের লক্ষণ' যোগ করেন মারিয়ান তমাসিক।
No comments