পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন-নকশালবাড়ীতে রাহুল গান্ধী! by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী
'নকশালবাড়ী' এক সময় উগ্র বামপন্থি রাজনীতির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখানে সত্তর দশকে চারু মজুমদার ও কানু স্যানালের নেতৃত্বে সহিংস বামপন্থি রাজনীতি জন্মগ্রহণ করে এবং অন্যত্র দ্রুত সম্প্রসারিত হয়।
সক্রিয় কর্মীরা নিজেদের চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের অনুসারী দাবি করে পুরো ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নির্বাচনী প্রচার জমে উঠেছে এবং প্রধান দুটি পক্ষ আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যে তাদের স্বীয় রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে শাসক বামপন্থিরা তাদের ৩৪ বছরের শাসন ধরে রাখার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, অন্যদিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস মূল কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে এবার রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে বদ্ধপরিকর। গত লোকসভা এবং পরবর্তী সময়ে পৌর নির্বাচনে অভাবিত সাফল্যের পর এ জোটের আস্থা প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা এখন ভাবতে শুরু করেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের শাসনে পরিবর্তন অপরিহার্য এবং বামপন্থিদের ক্ষমতা অবসান অত্যাসন্ন। কিন্তু বামফ্রন্ট মনে করে, রাজ্য নির্বাচনের পটভূমি অন্যান্য নির্বাচন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং সে কারণে তারাই শাসনের ধারা অব্যাহতভাবে অপরিবর্তিত রাখতে সমর্থ হবে। বর্তমান এপ্রিলের শেষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে চলবে এই ভোট আগামী মাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত। ফল জানা যাবে ভোট শেষে এবং তখনই স্পষ্ট হবে কারা আগামীতে শাসকের মসনদে বসবে পশ্চিমবঙ্গে। সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
কংগ্রেস এবং সহযোগী তৃণমূলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধী। তিনি বাংলা নববর্ষের শুরুতে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার নির্বাচনী সভা করলেন অনেক পরিচিত 'নকশালবাড়ীতে' এবং মালদহের মোঠাবাড়ীতে। দুটি এলাকাই বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত। 'নকশালবাড়ী' এক সময় উগ্র বামপন্থি রাজনীতির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখানে সত্তর দশকে চারু মজুমদার ও কানু স্যানালের নেতৃত্বে সহিংস বামপন্থি রাজনীতি জন্মগ্রহণ করে এবং অন্যত্র দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। সক্রিয় কর্মীরা নিজেদের চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের অনুসারী দাবি করে পুরো ভারতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কঠোরভাবে দমন করে সেই 'নকশালবাড়ী' রাজনীতি। তবে অনেক সক্রিয় উগ্র বামপন্থি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন এতে হতাহত হয়। স্তিমিত হয়ে আসে সেই সহিংস আন্দোলন। তবে ব্যাপারটি আদর্শিক ছিল এই কারণে যে, চারু মজুমদার-কানু স্যানালরা মনে করতেন, পুরনো ও জীর্ণ গণবিরোধী মতবাদকে পরস্ত করার জন্য প্রয়োজন ধ্বংসের এবং এ ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হবে নতুন, যা হবে আকাঙ্ক্ষিত। নকশালবাড়ী তাই আজও আলোচিত এবং ধারণা করা হয়, নেপাল এবং ভারতের অনেক স্থানে শক্তিশালী ও সক্রিয় 'মাওবাদীরা' এ আন্দোলন থেকেই তাদের মূল প্রেরণা নিয়েছে। অবশ্য প্রচলিত বামপন্থিরা_ যেমন পশ্চিমবঙ্গের শাসক বামফ্রন্ট এমনই চিন্তা-ধারণার বিপক্ষে। সেই নকশালবাড়ীতে জনসভা করলেন রাহুল গান্ধী এবং বক্তব্যে বামপন্থিদের কঠোর সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন, বাম রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে গেছে। রাহুল গান্ধী দাবি করলেন, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার পশ্চিমবঙ্গকে প্রচুর সাহায্য দিলেও রাজ্য সরকার প্রত্যাশিত উন্নয়ন সাধনে ব্যর্থ হয়।
রাহুল গান্ধী দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক স্থানে নির্ধারিত নির্বাচনী জনসভা বাতিল করলেও মালদহের মোঠাবাড়ীতে ঠিকই সড়কপথে গেছেন। এটি কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের শক্তিশালী ঘাঁটি। প্রয়াত আবুল বরকত গনি খান চৌধুরী পরপর আটবার এখান থেকে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হন। গনি খান চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার পাশের লোকসভা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নির্বাচনী এলাকাটিও কংগ্রেসের দখলে। তখন চৌধুরীর আত্মীয়স্বজনই লোকসভার সদস্য। একজন আছেন মৌসুম বেনজীর নূর, যিনি শুধু লোকসভার সদস্যই নন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের যুব কংগ্রেসের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি গনি খান চৌধুরীর ভাগি্ন। তবে বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে পরিবারে রয়েছে মতবিরোধ এবং বিদ্রোহী প্রার্থীও আছেন। তাই এসব আসন ধরে রাখার জন্যই রাহুল গান্ধী গেছেন মালদহ। সেখানে গনি খান চৌধুরী এক ভাতিজি সাবিনা ইয়াসমিন কংগ্রেসের প্রার্থী হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীও আছেন। এ সুযোগে বামফ্রন্টের প্রার্থীর ভাগ্যটা অনুকূলও হতে পারে। সেটাই হতে দিতে চাচ্ছেন না রাহুল গান্ধী। তার বক্তব্য শোনার জন্য জনগণ উৎসাহ দেখাচ্ছে। ভারতের রাজনীতিতে তিনিই এখন দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, শুধু মা সোনিয়া গান্ধীর পর, যিনি কি-না কংগ্রেস ও ভারত শাসক ইউপি ও জোটপ্রধান। প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় না থাকলেও সোনিয়া-রাহুল যে বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।
পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি আসনের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি বামফ্রন্টের দখলে; কিন্তু এবার তৃণমূলের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে সেটা দারুণভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা। তবে সেই হ্রাস কতদূর মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলকে সরকারে আনতে পারবে তা দেখার বিষয়। আসন নিয়ে মতবিরোধের পর তৃণমূল এবং কংগ্রেস এখন জোট বাঁধতে সমর্থ হয়েছে। ৬৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে কংগ্রেস, বাকি তৃণমূল। মমতা ব্যানার্জি হলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। তিনি রাজ্য নির্বাচন করছেন না। তবে তার দল জয়ী হলে তিনিই হবেন মুখ্যমন্ত্রী, এমনই ধারণা রয়েছে। শাসক বামপন্থিরা ৩৪ বছর শাসনের কারণে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তবে তারা অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে। তথাপি অনেকেই মনে করছেন বাতাস এখন পরিবর্তনের পক্ষে। এদিকে সোনিয়া গান্ধীও নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন এবং জলপাইগুড়ি গেছেন। তবে উদীয়মান কংগ্রেস তারকা রাহুলই দলের নির্বাচনী আকর্ষণ। রয়েছেন বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং অন্যরা।
তৃণমূলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি যেন একাই একশ'। তিনি ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা রাজ্যে। এবার যে তার দলের ক্ষমতায় আসার অপার সম্ভাবনা! বামফ্রন্টের কঠিন চ্যালেঞ্জের পুরোভাগে আছে মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং ফ্রন্টনেতা বিমান বসু ও অন্যরা। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির তেমন কোনো ভিত নেই বললেই চলে। তবু লালকৃষ্ণ আদবানিরা প্রচার চালাচ্ছেন; কিন্তু একটাই প্রশ্ন_ এবার কি মমতার দল কংগ্রেসকে নিয়ে ক্ষমতায় আসছে? সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। তবে ফ্রন্টকে এখনও ফেলে দেওয়া যায় না। ফলাফল জানার জন্য আমাদের ১৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
No comments