কালের আয়নায়-বাংলা নববর্ষ এবং আমাদের বাঙালিয়ানা সেক্যুলার বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ রক্ষাপ্রাচীর by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
এখন আর রমনা উদ্যান, বলধা গার্ডেন বা শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে এই উৎসব সীমাবদ্ধ নয়, মহানগরজুড়ে চলে এই উৎসব। ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর থেকে শুরু করে নতুন ও পুরান ঢাকায় অসংখ্য স্পটে চলে এই উৎসব।
এখন আর বাংলা একাডেমী বা ছায়ানটের মতো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিপত্য নেই এই উৎসবে। সম্পূর্ণ গণউৎসবের চেহারা ধারণ করেছে বাংলা নববর্ষ উৎসবগত শতকের চলি্লশের দশকে ওয়েন্ডেল উইলকি নামটা ছিল বিশ্ববিশ্রুত। তিনি ছিলেন আমেরিকায় একজন বিখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি চলি্লশের দশকের মধ্যভাগে অবিভক্ত ভারতে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে স্টালিনের একটি সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছিলেন। ওয়েন্ডেল উইলকি সবচেয়ে পরিচিত হয়েছিলেন 'ওয়ান ওয়ার্ল্ড' নামে একটি বই লিখে। এই বইয়ে তিনি এক বিশ্ব সরকার, এক ভাষা, খণ্ড জাতীয়তার বদলে সামগ্রিক এক জাতীয়তার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
গত শতকেরই আশির দশকের দিকে যখন গ্গ্নোবালাইজেশনের বা বিশ্বায়নের দাপটে জাতিরাষ্ট্রগুলোর সীমানা ভাঙতে শুরু করে, জাতীয় রাজনীতি এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাতেও বিশ্বায়ন আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, তখন মনে হয়েছিল ওয়েন্ডেল উইলকির প্রোফেসি অনুযায়ী হয়তো যে কোনো ধরনেরই হোক একটি বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এই নবপ্রযুক্তির প্রবল বিস্তারের যুগে ইংরেজিই হয়তো হয়ে দাঁড়াবে বিশ্ব ভাষা। ১ জানুয়ারি শুধু ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে নয়, সারাবিশ্বের সব জাতির নববর্ষ হিসেবে প্রাধান্য পাবে। অন্য ছোটবড় জাতিগুলোর নববর্ষ পালন ধীরে ধীরে সীমিত অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বিশ শতকের পর একুশ শতকেরও এক দশক কেটে গেছে। এই এক দশকে ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাসে বিশ্বের সব জাতির জীবনে বিশ্বায়ন ভালোমন্দ একটা ছাপ মেলেছে; কিন্তু জাতিরাষ্ট্র বা জাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট উৎসবগুলোর সীমানা ভাঙতে গিয়েও তাতে সফল হয়নি এ বিশ্বায়ন। বরং সেই সীমানাগুলো আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে আরও বড় করে জোড়া লাগেনি। বরং ছোটবড় আরও স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। সাবেক চেকোস্লোভাকিয়াতে ঘটেছে তাই। সম্প্রতি সুদান ভেঙে দক্ষিণ সুদানে একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন জাতিরাষ্ট্রের উত্থান ঘটতে চলেছে।
বর্তমানে বিশ্ব অনেক ছোট হয়ে গেছে। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশের মানুষ আচার-আচরণে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক কিন্তু এই আন্তর্জাতিকীকরণের বা ওয়েস্টার্নাইজেশনের ফলে যে জাতীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঐতিহ্য ও উৎসবগুলো বিভিন্ন জাতি, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের জাতিগুলোর জীবনে বিস্তৃত ও বিলুপ্ত হতে চলেছিল, সেগুলো তা হয়নি। বরং অনেক জাতি, বাঙালিসহ নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিকে দ্রুত মুখ ফেরাচ্ছে। বিশ্বায়ন, ধর্মান্ধতা, সারসন, ফতোয়াবাজি কোনো কিছুই অনেক দেশেই ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জাতীয় পুনর্জাগরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। এর একটি প্রমাণ বাংলা নববর্ষ পালনে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে বাঙালিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উৎসাহ-উদ্দীপনার ঢেউ।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উৎসব পালিত হয়েছে। এটা এখন সর্ববাঙালির জাতীয় উৎসব। এই উৎসবের ঢেউ আর সব জাতীয় ও ধর্মীয় উৎসবের ঢেউকে ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকার একজন বড় কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে শুনেছি, কয়েক বছর আগেও রোজার ঈদে সবচেয়ে বেশি কাপড় বিক্রি হতো। এখন হয় বাংলা নববর্ষ উৎসবে। ধনী থেকে গরিব সবাই এদিন নানা ধরনের নতুন পোশাক কেনে। মেলা, মিছিল, মিটিং এবং নানা ধরনের উৎসবে ঢাকা শহর এক নতুন চেহারা ধারণ করে। জেলা-উপজেলা শহরগুলোর জন্যও এ কথা সত্য। গ্রামাঞ্চলে আগে ধর্মীয় (হিন্দু) মেলা হিসেবে বৈশাখী মেলা বিবেচিত হতো। এখন তা সর্বজনীন মেলা। বাংলাদেশের সব ধর্মগোত্রের মানুষের কাছে পহেলা বৈশাখ একটি বড় সামাজিক উৎসব।
কয়েক বছর আগে পহেলা বৈশাখে আমি ঢাকায় ছিলাম। বাংলা নববর্ষ উৎসবের বর্ণাঢ্য চেহারা, সেক্যুলার চরিত্রটি আমি সেবার দেখেছি। মনে হয়েছে এটাই বাঙালির আসল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেহারা। এই চেহারায় ধর্মান্ধ সংকীর্ণতা, পশ্চাৎমুখী মৌলবাদ এবং পাশাপাশি পশ্চিমের অতিরিক্ত নকলনবিশিয়ানা কখনও কখনও বড় ছায়া মেলেছে, কিন্তু সব বাঙালির মনে যে আদি বাঙালিত্ব লুকিয়ে আছে, তাকে ধ্বংস করতে পারেনি। বরং বাঙালি আবার তার আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানা নিয়েই নতুনভাবে জেগে উঠতে চাইছে।
কয়েক বছর আগেই শুনেছিলাম, ঢাকায় বাংলা নববর্ষ উৎসবে দশ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে উৎসবে মেতেছিল। এ বছর নেমেছিল নাকি ২০ থেকে ৩০ লাখ। এখন আর রমনা উদ্যান, বলধা গার্ডেন বা শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে এই উৎসব সীমাবদ্ধ নয়, মহানগরজুড়ে চলে এই উৎসব। ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর থেকে শুরু করে নতুন ও পুরান ঢাকায় অসংখ্য স্পটে চলে এই উৎসব। এখন আর বাংলা একাডেমী বা ছায়ানটের মতো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিপত্য নেই এই উৎসবে। সম্পূর্ণ গণউৎসবের চেহারা ধারণ করেছে বাংলা নববর্ষ উৎসব।
আরব মুসলমানরা অগি্নপূজকদের দেশ প্রাচীন পারস্য দখল করার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ পারসিকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাদের মুসলমান আরব শাসকদের ইচ্ছা ছিল, তাদের মধ্যে আরবি ভাষা ও আরবদের সামাজিক রীতিনীতি ইসলামী ভাষা-সংস্কৃতি নাম দিয়ে প্রচলন করার। পারসিকরা তা গ্রহণ করেনি। তারা নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ধরে রেখেছে, এমনকি সামাজিক রীতিনীতিও। পারসিকদের নিজস্ব নববর্ষ 'নওরোজ' উৎসব পালনে (প্রাচীন রীতিনীতি অনুযায়ী) বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে এক আরব ঐতিহাসিক লিখেছেন, 'পারস্যের মানুষকে মুসলমান বানানো গেছে, কিন্তু তাদের আরব বানানো যায়নি। তারা পারসিক থেকে গেছে। চিরকাল পারসিক থাকবে।' তার এই কথাটি আধুনিক ইরান সম্পর্কেও সত্য। ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়েছে। কিন্তু এখনও ইরানিরা প্রাচীন পারসিক রীতিনীতি অনুযায়ী যেভাবে তাদের নওরোজ উৎসব পালন করে, একমাত্র বর্তমান বাংলাদেশ ছাড়া তার তুলনা বিরল।
বাঙালি মুসলমানকেও ইসলামের নামে বিভ্রান্ত করে, নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি বিমুখ করে 'নকল আরব' বানানোর চেষ্টা চলেছে বহুদিন এবং এখনও চলছে। বাঙালির নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, লোকজঐতিহ্য ও উৎসবকে হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়ে তাদের শিকড়হীন (জড়ড়ঃষবংং) জাতিতে পরিণত করার অপচেষ্টা চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। সৌদি আরব থেকে রফতানি করা এককালের ওয়াহাবি আন্দোলন থেকে বর্তমান জামায়াতি রাজনীতি এই অপচেষ্টারই প্রকট প্রমাণ। বর্তমানের মতো অতীতেও প্রচার চালানো হয়েছে, বাঙালির লোকায়ত সামাজিক উৎসবগুলো যেমন নববর্ষ উৎসব, শারদ উৎসব, নবান্ন উৎসব, পিঠাপুলির উৎসব সবই ইসলামবিরোধী হিন্দুয়ানি উৎসব। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে এই ফতোয়াবাজি ছিল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতায় আবদ্ধ রেখে তার মডার্নাইজেশন ও উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা। এক কথায় তাকে স্বাধীন ও উন্নত আধুনিক জাতিসত্তা অর্জন করতে না দেওয়া।
গত শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় এবং ছাত্রসমাজ এই মোল্লাবাদী প্রচারণা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সব ধরনের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের সচেতন প্রতিরোধকে শক্তিশালী করে তোলে।
পাকিস্তান আন্দোলন কিছুকাল এই প্রতিরোধকে বাধাগ্রস্ত করে রাখলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই বাঙালি মুসলমান বুঝতে পারে তারা মধ্যযুগীয় ধর্মরাষ্ট্রের এমন এক বেড়াজালে বন্দি হয়েছে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-সভ্যতাকে ধ্বংস করবে। ফলে প্রথমে শুরু হয় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন, তারপর তা ক্রমান্বয়ে স্বাধিকার আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার যুদ্ধে পর্যবসিত হয়। এই যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন নয়; বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
বাংলা নববর্ষের কথায় ফিরে যাই। ১৯৪৮ সালে অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর পরেই ভাষা আন্দোলনের শুরু। যে বৈশাখী উৎসবকে কেবল হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করে বাঙালি মুসলমানকে তা থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছিল, সেই উৎসব ক্রমশ বাঙালি মুসলমানকে কাছে টানতে শুরু করে এবং ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের একটা অংশ পারিবারিক উৎসব হিসেবে তা পালন করতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই দেখা যায়, বাংলা নববর্ষ উৎসব ক্রমশ বাঙালি মুসলমানেরও সামাজিক উৎসবে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিল একটা বড় সহায়ক শক্তি। এ উৎসবের সঙ্গে হিন্দু সমাজের যে কিছু ধর্মীয় আচার-আচরণ যুক্ত ছিল, তা ওই সমাজেরই একাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে; উৎসবটি তার আদি লোকায়ত উৎসবের চেহারা ফিরে পাচ্ছে।
১৯৫৪ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক পহেলা বৈশাখকে বাঙালির নববর্ষের উৎসবের দিন চিহ্নিত করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। তখন থেকেই বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয় এবং তা সাধারণ উৎসবে পরিণত হয়।
প্রথম দিকে (পাকিস্তান জমানায়) বাংলা নববর্ষ উৎসব ছিল শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ উৎসব। বাংলা একাডেমী ও ছায়ানটের মতো সংস্থাগুলো কর্তৃক আয়োজিত নববর্ষ উৎসব এখনও উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের উৎসব। ছায়ানট অবশ্য গোড়াতে রমনা পার্ক এবং বলধা গার্ডেনের মতো উন্মুক্ত স্থানে নববর্ষ, শারদ ও বসন্ত উৎসবগুলোর আয়োজন করে তাদের অনুষ্ঠানগুলোর গণসম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাংলা নববর্ষ উৎসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণউৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে তার লোকজ ও গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে।
গ্রামবাংলার উৎসবের নাচ-গান, সাজসজ্জা, আচার-আচরণ ও উদ্দামতা এখন উঠে এসেছে শহর এবং রাজধানীর উৎসবেও। গত বৃহস্পতিবারের নববর্ষ উৎসবেও দেখা গেছে, ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একদল তরুণ জেলে সেজে রাস্তায় নেমেছেন। তাদের পরনে জেলেদের পোশাক, হাতে মাছ ধরার পলো, এমনকি তাতে জীবন্ত মাছ। ফতোয়াবাজি করে যে মানুষের মানবিক অনুভূতি ও প্রবৃত্তিগুলোকে চিরকাল বন্দি রাখা যায় না, এটাও তার একটি প্রমাণ। শিক্ষিত মেয়েরা বাংলার গ্রাম্য নারীর সাজে সেজে রমনার বিশাল মেলায় গ্রাম্য নাচে উদ্দাম হয়ে উঠেছে, এটা কি আমাদের বাঙালিয়ানার স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ নয়?
ভুয়া ফতোয়া দিয়ে ব্রিটেনের বাঙালি মুসলমানদের নববর্ষ উৎসব পালন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল মৌলবাদীরা। তারা লন্ডনের ইস্ট এন্ডে এবং মসজিদগুলোতে বছর বছর ইশতেহার ছড়িয়ে প্রচার চালাত, বাংলা নববর্ষ পালন বেদাত এবং ধর্মবিরোধী। তারা পূর্ব লন্ডনে শক্তি প্রয়োগেও এ উৎসব পণ্ড করার চেষ্টা করেছে। পরিণতি হয়েছে, মারমুখো জনতার প্রতিরোধে তাদের পালাতে হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা টাউন নামে পরিচিত পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন থেকে শুরু করে গোটা হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় বাংলা নববর্ষ পালিত হয় এবং বৈশাখী মেলায় ২৯ থেকে ৪০ হাজার নরনারী জমায়েত হয়। উৎসবের দিক থেকে বাঙালির নববর্ষ উৎসব আফ্রিকানদের বার্ষিক নটিংহাম কার্নিভালের সমকক্ষতা অর্জন করতে চলেছে।
আমি কয়েকবার কানাডার টরেন্টো, অটোয়া শহরে এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক, লসঅ্যাঞ্জেলেস শহরেও বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এ উৎসবগুলোতে শুধু দুই বাংলার বাঙালি নয়, সাদা-কালো অন্যান্য সম্প্রদায়ের নরনারীরাও যোগ দেন। শীতের দেশেও পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালির সমাবেশ এবং পান্তাভাত, ভাজা ইলিশ ও আলুভর্তা, ডাল সহযোগে গণভোজ উৎসবের গোটা চেহারাটাকেই একেবারে বাঙালিয়ানায় ঢেকে দেয়।
ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলেছেন, ঢাকায় বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দিনব্যাপী যে বিশাল-বিরাট উৎসব চলে, তাতে এখনও একটা সূক্ষ্ম শ্রেণীভেদ আছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাংলা একাডেমী, ছায়ানট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো আসলে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অনুষ্ঠান। কিন্তু অপরাহ্ন শুরু হওয়ার আগেই রমনা পার্ক থেকে শুরু করে সারা শহরে যে জনতার ঢল নামে, তা নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের উৎসব। এক কথায় বাঙালির চিরন্তন গণউৎসব।
দেশে-বিদেশে আমার মতো অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশকে যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো তালেবান দেশ বানানো যাবে না কিংবা দেশটিকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না, তার একটা বড় কারণ, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার লোকভিত্তি এবং তাতে গণশক্তির যোগ। বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির অপরাজেয় আত্মশক্তিরই একটা অংশ। এই আত্মশক্তি তথা অসাম্প্রদায়িক বাঙালিয়ানাই বাঙালি ও বাংলাদেশের অভেদ্য রক্ষাপ্রাচীর।
লন্ডন, ১৫ এপ্রিল, শুক্রবার, ২০১১
No comments