কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-যুক্তির জোর বনাম জোরের যুক্তি by রণজিৎ বিশ্বাস
আসুন আজ দেশের সবচেয়ে বড় অপরাধ নিয়ে কথা বলি। : কী অপরাধ? : যুদ্ধাপরাধ। : শুধু অপরাধ নিয়ে বলবেন? অপরাধীদের নিয়ে বলবেন না!
: দুটো নিয়েই বলব, কান টানলে মাথা আসবে। : হঠাৎ যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কেন আপনি মাথা ঘামাতে শুরু করলেন?
: করলাম এক ব্যবহারজীবীর কথা বুঝতে না পেরে। আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই, দেখি আপনি বুঝতে পারেন কি না।: দুটো নিয়েই বলব, কান টানলে মাথা আসবে। : হঠাৎ যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কেন আপনি মাথা ঘামাতে শুরু করলেন?
: কথাটা কী!
: পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের সঙ্গে আপনার কোনো তালুকসম্পর্ক নেই মনে হচ্ছে!
: আছে। আমার মতো করে আছে। আমার স্টাইলে আছে। আপনি ঘটনাটা বলুন। কী বুঝতে পারছেন না, তাই বলুন।
: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এক লোক গ্রেপ্তার হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের উত্তরাঞ্চলে তাণ্ডব চালানো লোক, মানুষমারা লোক, মোটরসাইকেলে ওর বাবার দেশ পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে বীরত্ব দেখানো লোক। এক জায়গায় সহস্রাধিক মানুষ হত্যা করা হয়েছিল- মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ প্রায় বারো শ লোক মেরে ফেলার সময় সে ঝেড়ে কেশেছিল; যে প্রভুদের কাছে আনুগত্য জাহির করার জন্য সে ও তার সহযোগীরা পদলেহন করত, তাদের সহযোগিতা করেছিল এবং জেহাদি জোশে হত্যাপরাধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
তাকে কোর্টে তোলার পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধীদের পক্ষের এক ব্যবহারজীবী বললেন- তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বারো শ মানুষের হত্যাপরাধে হাত লাগিয়েছেন। তাই যদি হবে কোনো জিডি হয়নি কেন?! কোনো এফআইআর নাই কেন?!- এই কথাটিই আমি বুঝতে পাচ্ছি না।
: কেন বুঝতে পাচ্ছেন না!
: মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকার-আলবদর-আলশামসরা যখন মাতৃভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় নেমে তাদের প্রভুদের আদরে-সোহাগে সাপের পাঁচ পা দেখে বসেছিল, যখন তারা বন্ধু হত্যা, ভ্রাতৃ হত্যা, প্রতিবেশী হত্যা, শিক্ষক হত্যাসহ সর্বসম্পর্কের মানব হত্যার উল্লাস করছিল, তখন অবরুদ্ধ ও ক্রন্দনশীল ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কোণে কি ওই কুলাঙ্গারদের বিরুদ্ধে জিডি করার বা এফআইআর পাওয়ার সুযোগ ছিল?!?!
আমি অশিক্ষিত এক শ্রমিক পর্যায়ের মানুষ, কোর্টকাছারিকে ভয় পেয়ে দূরে দূরে থাকা এক লেবার টাইপের লোক; আমি বুঝি না, এই কথার যুক্তিটা কী!
: সব কথা বুঝতে চাইবেন না। মনে রাখবেন কখনো কখনো অজ্ঞানতা আশীর্বাদ। এই মহাযুক্তি প্রদর্শনের দুটি কারণ আছে। সেগুলো আপনাকে বুঝতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে এই যুক্তিটি দেশের সরলসোজা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য খুবই কার্যকর। শোনার পর, বিশেষত যাদের বয়স কম এবং যারা কালপিটদের হাতে তৈরি প্রেসক্রিপশনের ইতিহাস পড়ে পড়ে ও শুনে শুনে বয়স বাড়াচ্ছে, তাদের অনেকেই ভাববে- সত্যিই তো! ভদ্রলোক তো খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলছেন! এত বড় অপরাধই যদি করে থাকবে ওই কালপ্রিটটা, জিডি হয়নি কেন! এফআইআর নাই কেন!!
দেশে তখন কী পরিস্থিতি ছিল, পশুদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাশবেতর প্রাণীরা কী তাণ্ডব চালাচ্ছিল, কেমন উত্তুঙ্গ নৃত্যে মেদিনী কাঁপাচ্ছিল, সে চিন্তা তাদের মাথায় আসবে না। তাদের ভ্রান্তবিভ্রান্ত করা যাবে। তাদের কাউকে কাউকে নিজেদের ফায়দা হাসিল করার জন্য মত্তপ্রমত্তও করে তোলা যাবে।
আর এ প্রসঙ্গে এ ধরনের সব প্রসঙ্গে আমি দ্বিতীয় যে কথাটি বলব, সেটি বড় পুরনো কথা। যুক্তির জোর যেখানে শেষ, জোরের যুক্তি সেখানে শুরু।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক, রম্যলেখক
No comments