ডান 'পা' না বাম 'পা' by হেলাল হোসেন ঢালী
বাংলাদেশের কিছু কিছু ডাক্তারের সেবার নমুনা ও ধরন নিয়ে সৃষ্ট কাহিনী এত সমৃদ্ধ যে, এর বিবরণ ঠিক কীভাবে শুরু করা উচিত তা নির্ধারণ করা মুশকিল। আমাদের ডান পা রেখে বাম পা কিংবা বাম পা রেখে ডান পা কাটতে কাটতে দুই পা-ই প্রায় অচল।
পেটের মধ্যে ডাক্তারের ঘড়ি কিংবা অপারেশন থিয়েটারের কাঁচি হজম হতে হতে 'ডাক্তারি সমাচার' আলোচনা করতেই ডরাই। কিংবা রোগী হয়ে টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়েও আত্মসম্মান নামক একটি অবায়বীয় কিংবা বায়বীয় বস্তুটি রক্ষার স্বার্থে ডাক্তারের চোখ রাঙানি ও অবহেলার গল্প প্রকাশ করতে ভয় হয়। কিন্তু জীবন যখন ওষ্ঠাগত, এক পা সারাতে এসে দুই পা যখন হারানোর উপক্রম, তখন ওই অবায়বীয় কিংবা বায়বীয় আত্মসম্মানবোধের তোয়াক্কা না করে দু'একটি কথা বলতেই হয়।সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। পঙ্গু হাসপাতালের বিষয়টিই ধরা যাক। রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত পায়ে অস্ত্রোপচার না করে ভালো পায়ে অস্ত্রোপচার করে পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার যে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন এবং চারদিকে ঢিঢি পড়ে গেছে, তা প্রচারমাধ্যমে ঘটা করে প্রকাশিত হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে। কেননা পঙ্গু হাসপাতালের ঘটনাটি কোনো নতুন এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রোগীদের অসহায়ত্ব ও বিপর্যস্ততার কারণে বেশিরভাগই তাদের দুর্দশার কথা জানাতে পারে না, প্রচারমাধ্যমেও আসে না। জানাতে না পারার আরেকটি কারণ, নালিশ জানানোর জায়গাটা সহজ প্রবেশগম্য নয়। পুলিশ মামলা নিতে চায় না কিংবা ওই ডাক্তারদের সঙ্গে পুলিশের একটা নীরব চুক্তি থাকে, যার কারণে সাধারণ লোকজন যেতে ভয় পায়। আর এই নালিশ জানানোর সুযোগ না থাকায় প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
জনৈক রোগী তার মাথাব্যথার সমস্যা নিয়ে গেছেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলেন মাথাব্যথার কারণ কী? ডাক্তার রেগেমেগে বললেন, আপনার এত কিছু জেনে কী দরকার? ওষুধ যা দিচ্ছি খেয়ে নেবেন। রোগী বেচারা চুপ। যারা একটু নাছোড়বান্দা, সচেতন তারা হয়তো এ বিষয় নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েও যান। যেসব ডাক্তারের ক্লিনিক-বাণিজ্য রয়েছে কিংবা যারা ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত, টাকা-পয়সার ব্যাপারে এদিক-সেদিক করাটা তাদের রীতিমতো নিয়মিত বাণিজ্য। অপারেশনের আগে হয়তো বলেন, অপারেশন বাবদ সর্বসাকল্যে ১০ হাজার টাকা লাগবে, রোগী কোনো রকম টাকাটা জোগাড় করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন; কিন্তু অপারেশন শেষে ক্লিনিক চার্জ, অপারেশন থিয়েটার চার্জ প্রভৃতি বাবদ ৩০ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়, যা দেখে রোগীর ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কিন্তু কিছু বলার নেই, যেহেতু অপারেশন হয়েই গেছে, বাকবিতণ্ডায় গেলে পাছে রোগীর ক্ষতি হয়, সেই ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করা হয়।
যারা অর্থ খরচ করে দেশের ব্র্যান্ড হাসপাতালে কিংবা দেশের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন কিংবা যারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েননি, তাদের জন্য অবস্থাটা বোঝা মুশকিল। কিন্তু এটা একটা বাস্তব এবং প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া চিত্র। দেশের অসংখ্য মানুষ হয় ভুল চিকিৎসা কিংবা টাকা-পয়সা এবং চিকিৎসাজনিত প্রতারণা কিংবা কিছু ডাক্তারের কাছে কোনো না কোনোভাবে অপদস্থ হচ্ছে।
চিকিৎসাসেবা নিয়ে তাই জোরালো ভূমিকা এবং পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষা খাত, নিরাপত্তা বাহিনী প্রভৃতি খাতের দুর্নীতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের দুর্নীতি এবং ডাক্তারদের আচরণবিধি নিয়ে ভাবা জরুরি। তা না হলে আমাদের সুস্থ পাগুলো অসুস্থ হতে থাকবে আর আমরা পুরো জাতি হিসেবে হয়ে যাব এক অচল জাতি।
No comments