ম্যাককালামেই সব শেষ by নোমান মোহাম্মদ
লড়াইটা শুধু ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সঙ্গে হলে এই ম্যাচ জিতে যায় বাংলাদেশ! কিউই ওপেনার একা করেছেন ১২৩, বাংলাদেশের সবাই মিলে যে ১৩২!
পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে বটে ব্যাপারটা। তা ম্যাককালাম কাল বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের নিয়ে এমন পরিহাসেই তো মেতেছিলেন।
২৯ বলে তাই হয়ে যায় হাফ সেঞ্চুরি, ৫১ বলে সেঞ্চুরি। তাঁর ১২৩ রানের ইনিংসটি শেষ হয় ২০তম ওভারের শেষ বলে। ম্যাককালাম ওই বিধ্বংসী ইনিংস খেলার জন্য নিয়েছেন ৫৮ বল। বাকি ৬২ বল কিউই ব্যাটসম্যানরা ঘাস কাটবেন নাকি? তা করেননি, আবার খুব যে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের, তাও না। অন্যদের গড়পড়তা অবদানের পরও কিউইরা ইনিংস শেষে উঠে যায় ১৯১ রানের চূড়ায়। এরপর আর ম্যাচের থাকেটা কী! থাকেওনি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ১৩২ পর্যন্ত যেতে পারে বাংলাদেশ। অনেক প্রত্যাশার টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তাই শুরু হলো ৫৯ রানের হারের হতাশা দিয়ে।পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে বটে ব্যাপারটা। তা ম্যাককালাম কাল বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের নিয়ে এমন পরিহাসেই তো মেতেছিলেন।
অথচ এই ম্যাচটির জন্য কত প্রস্তুতি! মুখে আশার কত ফুলঝুরি! 'অগুনতি' ম্যাচ উইনারে ঠাসা দলে কেউ না কেউ তো খেলাটি বের করে আনবেনই! পারলেন না। পাল্লেকেলের পাহাড়ি উপত্যকার স্টেডিয়ামে খেলার মাঝপথেই কাঁধ ঝুলে পড়ল মুশফিক-সাকিব-তামিমদের। সংশপ্তকের মতো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহসও পাননি। পরাজিত যোদ্ধার মতো নিয়তিকে যেন নতশিরে মেনে নিয়েছেন একটু একটু করে। তিল তিল করে কষ্টদায়ক সেই 'মৃত্যু'!
কে ভেবেছিল, এমন কিছু হবে! ম্যাচ আবহের চিত্রনাট্যে তা লেখা ছিল না নিশ্চিতভাবে। বছর দুয়েক আগে দুই দলের সর্বশেষ দেখায় ওয়ানডে সিরিজে কিউইদের হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। সেই বিবেচনায় কালকের দ্বৈরথে কারো কারো ফেভারিটও ছিল তারা। আর ডেথ গ্রুপে টস জিতে মুশফিকুর রহিম বোলিং বেছে নেওয়ার পরও শুরুতে বোঝা যায়নি ঈশান কোণ থেকে কোন মেঘ ধেয়ে আসছে! পাওয়ার প্লের ৬ ওভার শেষে কিউইরা এক উইকেটে ৩৪, বাংলাদেশের জন্য মন্দ কী!
মন্দটা শুরু হলো এরপর। উইকেটে এসে শুরুতে একটু রয়েসয়ে খেলছিলেন ম্যাককালাম। চতুর্থ ওভারে আবদুর রাজ্জাকের বলে মার্টিন গাপটিল (১১) আউট হওয়ার পর এসেছেন ক্রিজে। ফিরেছেন ইনিংসের শেষ বলে। মাঝে বাংলাদেশের বোলারদের ওপর দিয়ে বইয়ে দিয়েছেন সুনামি। চার-ছক্কা মেরেছেন ইচ্ছের খেয়ালে। যখন যেদিকে চেয়েছেন। গ্যালারি পেরিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরের রাস্তায় বল আছড়ে ফেলেছেন বারদুয়েক। এমন ফর্মের ম্যাককালামের সামনে বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা নিয়েছিলেন অসহায় দর্শকের ভূমিকা। দর্শকই! নইলে অমন ভুল লাইন-লেন্থের বোলিং করবেন কেন, কিংবা হাতের ফাঁক গলে নিয়মিত বল ছুটবে কেন!
পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পর ম্যাককালাম খোলস ছেড়ে বেরিয়েছেন একটু একটু করে। জিয়াউরকে পুল করে মারা বাউন্ডারিতে ফিফটিতে পৌঁছেন ২৯ বলে। তাঁর রুদ্ররূপ দেখে ব্যাটিং লাইনে উপরে ওঠা জেমস ফ্রাংকলিন (৩৬ বলে ৩৫) পর্যন্ত খেলেছেন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের মতো। রয়েসয়ে, ধৈর্য নিয়ে। ১৫তম ওভারের প্রথম বলে মাশরাফি তাঁকে আউট করেন। তাতে ভাঙে ১০.৫ ওভারে ৯৪ রানের জুটি। সঙ্গী হারিয়ে দমে তো যানইনি, বরং আরো তেতে ওঠেন ম্যাককালাম। টেনিসের ফোরহ্যান্ড শটের মতো মারেন এক ছক্কা। ১৬ ওভার শেষে নিউজিল্যান্ড ২ উইকেটে ১২৮ করলেও ম্যাচ থেকে তখনো পুরো ছিটকে যায়নি বাংলাদেশ। শেষ চার ওভারে ১৫, ১৫, ১৭ ও ১৬ রান নিয়ে সেটি নিশ্চিত করেন ম্যাককালাম। ৯২ রানের সময় মাশরাফি ক্যাচ ছেড়ে নিশ্চিত করেন এই কিউই উইকেটরক্ষকের সেঞ্চুরি। সে জন্য ম্যাককালামের লেগেছে ৫১ বল। টোয়েন্টি টোয়েন্টির ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দুই সেঞ্চুরি এখন এই কিউইর। আর কালকের ১২৩ রান এই ফরম্যাটের সর্বোচ্চও।
বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে রাজ্জাক (৪-০-২৮-২) ও মাশরাফির (৪-০-২৮-২) বোলিং ফিগারই কেবল ভদ্রস্থ। শফিউলের ৩ ওভার থেকে এসেছে ৩৪ রান। সাকিবের ৪ ওভারে ৪০ ও ইলিয়াস সানির ৩ ওভারে ৩৬ রান। আর মাহমুদউল্লাহর (০/১৩) ও জিয়াউরকেও (০/১২) এক ওভারের বেশি বোলিং দেওয়ার সাহস পাননি অধিনায়ক।
২০ ওভারে নিউজিল্যান্ড ৩ উইকেটে ১৯১ রান করার পরই আসলে ম্যাচ শেষ। এরপর অপেক্ষা হারের ব্যবধান কতটা কম হয়। ইনিংসের তৃতীয় বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে মারা এক শিশুতোষ শটে কাভারে ক্যাচ দেন তামিম (০)। সাকিব এসে প্রথম বলেই ক্যাচ হতে হতে বেঁচেছেন। একটু পরে তাঁর ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগা বল কোনোমতে মিস করেছে স্ট্যাম্প। এসব সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। ব্যাটিংয়ের বড্ড তাড়াহুড়ার খেসারত দিয়েছেন সাকিব (১১) কাভার পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে। আর অধিনায়ক মুশফিক (৪) যখন মিড উইকেট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেন, ইনিংসের পঞ্চম ওভার চলছে মাত্র। ৩৩ রানে হারিয়ে গেছে ৩ উইকেট। জয় তখন রূপকথা, আশঙ্কা তখন ১০০-র নিচে গুটিয়ে যাওয়ার।
শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। আশরাফুল (২১), মাহমুদউল্লাহরা (১৫) বেশি দূর যেতে না পারলেও নাসির হোসেন লড়েছেন একাই। ৩৯ বলে ছয় বাউন্ডারি এবং এক ছক্কায় করেছেন ৫০ রান। নাসিরের ব্যাটিং জোনাকির আলোর মতো সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়েছে, কিন্তু অন্ধকার দূর করতে পারেননি। সে জন্য যে আলোর মশাল হয়ে জ্বলে ওঠার কথা ছিল সাকিব-তামিম-আশরাফুলদের! ব্যর্থতার চোরাবালিতে নিজেরা ডুবে গিয়ে দলকেও ডুবিয়েছেন।
ভাগ্যিস, নাসির হাফ সেঞ্চুরিটি করেছিলেন। তাতেই না ১০০ পেরনো গেল! এর চেয়েও বড় কথা, পুরো বাংলাদেশ মিলে হারানো গেল ম্যাককালামকে!
No comments