নরসিংদীতে মন্ত্রী রাজু ঠেকাও আন্দোলন-সংঘর্ষ আগুন, রবি-সোম হরতাল
শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর নরসিংদী সফরকে কেন্দ্র করে জনবন্ধু লোকমান সংগ্রাম পরিষদ নামের একটি সংগঠনের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ পুলিশি বাধার মুখে পণ্ড হয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার এ ঘটনার পর শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে লোকমান সমর্থকদের সংঘর্ষে পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল, সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি।
লোকমান সমর্থকরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিআরটিসিসহ বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে সংঘর্ষ থেমে যাওয়ার পর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে। রাত পৌনে ৮টার দিকে ট্রেন চলাচলও শুরু হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশি বাধার প্রতিবাদে আগামীকাল রবিবার ও পরদিন সোমবার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে।নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে আপন ভাইয়ের নাম জড়িয়ে পড়ায় নিজ জেলাতেই সমালোচিত হন শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। লোকমান হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১০ মাস পর মন্ত্রীর আগামীকাল নরসিংদী যাওয়ার কথা রয়েছে। মন্ত্রীর এই সফরকে কেন্দ্র করে লোকমান ও মন্ত্রীর সমর্থকদের কর্মসূচিতে নরসিংদী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। লোকমান সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে লোকমান হত্যার বিচার দাবিতে রবিবার হরতালসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। গতকাল কর্মসূচিতে বাধার প্রতিবাদে সোমবারও হরতালের ডাক দেওয়া হয়।
কর্মসূচির প্রথম দিন গতকাল বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল। কিন্তু নাশকতার আশঙ্কার কথা বলে প্রশাসন সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি শহরজুড়ে পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সকাল ১০টার দিকে শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লোকমানের ছোট ভাই পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল বিক্ষোভ সমাবেশের সমর্থনে গণসংযোগে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়। একাধিক স্থানে বসানো হয় পুলিশের চেকপোস্ট, বন্ধ করে দেওয়া হয় সব যানবাহন চলাচল।
মেয়র কামরুলের নেতৃত্বে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে শহরের বাসাইল মার্কাস মসজিদের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশস্থল জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে রওনা হয়। মিছিলটি কিছুটা এগোতেই পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। এ সময় পৌর মেয়রসহ লোকমান সমর্থকরা পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশ লোকমান সমর্থকদের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। জবাবে লোকমান সমর্থকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে।
পুলিশের লাঠিপেটায় মেয়র কামরুল, নাজিম উদ্দিন, জামান মিয়া, নূর এ আলম, শরীফসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। ওই সময় দায়িত্ব পালনকালে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের স্টাফ রিপোর্টার ও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সঞ্জিত সাহার মাথায় পুলিশ আঘাত করে। ইটপাটকেলের আঘাতে একুশে টিভি ও ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি মাখন দাস আহত হন। ওই সময় মেয়র কামরুলকে র্যাব সদস্যরা ঘিরে রাখেন। বিকেল ৫টার দিকে তাঁকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মেয়র কামরুল আহত হওয়ার খবর পেয়ে প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলীসহ বাসাইল এলাকার লোকমান সমর্থকরা সদর হাসপাতাল এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে। তারা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-আগরতলা মৈত্রী বাসসহ দুটি যাত্রীবাহী বাস ও একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর পুলিশের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে শতাধিক রাবার বুলেট ও ২০০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয় অর্ধশতাধিক লোকমান সমর্থক। লোকমান সমর্থকদের ছোড়া ইটপাটকেলে কনস্টেবল জিয়াউল হক ও সোহেল মিয়া আহত হন।
অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় পাশে প্রায় ৪০ কিলোমিটারজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে অবরোধকারীদের হটিয়ে দেওয়ার পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন স্টেশনে কয়েকটি ট্রেন আটকা পড়ে।
মেয়র কামরুল সাংবাদিকদের বলেন, 'লোকমান হোসেনের খুনিদের বিচারের দাবিতে ডাকা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সমর্থকদের শুধু লাঠিপেটাই করেনি, গুলিও চালিয়েছে। এতে শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। নরসিংদীবাসী এই নৃশংস হামলার প্রতিবাদে গর্জে উঠবে।'
এই ঘটনায় লোকমান সংগ্রাম পরিষদ সোমবারও জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আগে ঘোষিত তিন দিনের কর্মসূচিতে রবিবার হরতালের কর্মসূচি ছিল। তা সম্প্রসারিত করে পরদিনও হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মিজানুর রহমান জানান, বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত হাসপাতালে মেয়র, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যসহ ২২ জন চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে মেয়রসহ ১৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, 'বর্তমানে শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। মেয়রের সমর্থকদের হামলায় ১৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। সন্ধ্যার পর থেকে মেয়রের লোকজন পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে।'
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত ২০ জনকে আটক করা হয়েছে। গাড়ি পোড়ানো, সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও চলছে।
ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার খলিলুর রহমান জানান, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে সব ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিভিন্ন স্টেশনে বেশ কয়েকটি ট্রেন আটকা পড়ে।
নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার নুরুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়। ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জ স্টেশনে ঢাকামুখী চট্টলা এঙ্প্রেস ও একটি কনটেইনারবাহী ট্রেন আটকা পড়ে। পলাশ উপজেলার জিনারদিতে আটকা পড়ে ঈশা খাঁ এঙ্প্রেস। ঘোড়াশালে আটকা পড়ে চট্টগ্রামগামী মহানগর গোধূলি ট্রেনটি।
এদিকে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে বিকেলে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সাংবাদিকরা। নরসিংদী প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে বিকেলে শহরের সুতাপট্টি এলাকা থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সফরকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল বের করে আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। মিছিলে নেতৃত্ব দেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়া। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
No comments