সদরে অন্দরে-'শত্রু সম্পত্তি আইন' একাত্তরের শহীদকেও শত্রু বানায়য় by মোস্তফা হোসেইন

বাড়িটার কাছে গেলেই দুর্গন্ধে দম আটকে আসে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাড়িটিতে থাকা মুরগির খামার। তার পরও ইতিহাস সচেতন প্রতিটি মানুষ সেখানে থমকে দাঁড়াবেন। কারণ বাড়িটি একটি ইতিহাস। এটি আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। কুমিল্লা শহরের চর্থার এই বাড়িটিতেই থাকতেন বাংলা সংগীতের প্রবাদপুরুষ শচীন দেব বর্মণ।


পাকিস্তান আমলে বাড়িটি চিহ্নিত হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি হিসেবে। এখন 'শত্রু'র বদলে 'অর্পিত' হয়ে আছে। দখলে আছে বাংলাদেশ সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান। এই কুমিল্লা শহরেই তেমনি আছে শহীদ ধীরেন দত্তের বাড়ি। ধর্মসাগরের পাড়ে থাকা বিখ্যাত এই বাড়িটির ভবনগুলো এখন বট-পাকুড়ের দখলে। ধীরেন দত্তের নামে একটি রাস্তা রয়েছে। রাস্তার নামফলকটি দেখে বাড়ির সামনে এগিয়ে গেলে মনে হবে, এ যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাস। কোনো দায় নেই যেন আমাদের। পরিত্যক্ত বাড়িটি আমাদের সেই ব্যর্থতাকেই বারবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় এমপি আ কা ম বাহাউদ্দিন বাহার, কবি বেলাল চৌধুরী ও মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হাসান পাখির মতো কিছু সচেতন মানুষ চাচ্ছেন শচীন দেব বর্মণের বাড়িকে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক চত্বর তৈরি হোক। বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় যাতে এগিয়ে আসে তেমনি কামনা কুমিল্লার সংস্কৃতি সচেতন অন্যদেরও।
শচীন দেবের বাড়ির মতো আরো অনেক গুণীজন ও দেশপ্রেমিক মানুষের বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইলের ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পারিবারিক সম্পত্তি, মাস্টারদা সূর্য সেন, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, বিপ্লবী রবি নিয়োগী, কবি নবীন চন্দ্র সেন, দার্শনিক শহীদ ড. জি সি দেব, শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মতো আরো বিশিষ্টজনের সম্পত্তি 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠে।
সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়াই শুধু নয়, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মূলত আইনগত কারণে। আর জাতিকে অকৃতজ্ঞ বানানোর জন্য যে আইনটির ব্যবহার হয়েছে তার নাম 'শত্রু সম্পত্তি আইন', যা পরবর্তীকালে নাম বদলে হয়েছে 'অর্পিত সম্পত্তি আইন'। আইনটির জন্ম গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ওই সময় এ দেশে টিকতে না পেরে বহু অমুসলমান দেশত্যাগ করেছিল। তাদেরই আখ্যায়িত করা হয়েছিল এ দেশের শত্রু হিসেবে। কী দুর্বিষহ সিদ্ধান্ত। যে মানুষটি নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনদেশে চলে গেছে একান্তই নিজের জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে, সেই মানুষটিকেই বানিয়ে দেওয়া হলো শত্রু হিসেবে। শত্রু ঘোষণার পর কি আর কেউ এ দেশে ফিরে আসতে পারে? তাই তাদের কেউ আর ফিরে আসেনি নিজের ভিটায়। সুতরাং তাদের স্বজন যতই থাকুক না কেন, দেশত্যাগী 'শত্রুদের' সম্পদ-সম্পত্তির ওপর কারো কোনো অধিকার রইল না। কারণ কথিত শত্রুদের দেশত্যাগের পর সরকার সেসব সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে নেয়। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান আমলেই এমন অনেক সম্পত্তি আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বশংবদদের কাছে লিজ দেওয়া হয়ে যায়।
পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের শাসকদের কাছ থেকে এমন আচরণ অস্বাভাবিক ছিল না। তাঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল। শত্রু সম্পত্তি আইনটিও তেমনি একটি মাধ্যম। কারণ ওই সময় কিংবা পরবর্তীকালেও একজন মুসলমান চাকরি সূত্রে কিংবা অন্য কোনো কারণে দেশত্যাগ করলে তার সম্পত্তি কিন্তু কখনো শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। শুধু অমুসলমানদের বেলায়ই এ আইনটি প্রয়োগ করা হয়েছিল। এমনকি মুসলমান অনেকে ইউরোপ-আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসত করার পরও দেশে তার সম্পত্তি কখনো বেদখল হয়নি রাষ্ট্রের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রের দ্বারা নাগরিকের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্য করা হবে না। সেই প্রতিশ্রুতিই পূরণ হয়েছিল স্বাধীনতা লাভের পর। আমরা তার স্পষ্ট বিধান দেখতে পাই আমাদের সংবিধানে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ করা হলো, 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (২৭ ধারা)।' আবার ২৮-এর ১ ধারায় বলা আছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।'
প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মুসলমান দেশত্যাগ করলে তার সম্পত্তি যখন শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয় না তখন অমুসলমানের ক্ষেত্রে একই রকম হবে না কেন। অর্থাৎ এই আইন দ্বারা স্পষ্টত সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, পাকিস্তান আমলের সেই আইনটি তো পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিলও করে গেছেন। সেখানেও কিন্তু কথা থেকে যায়। তবে পরবর্তীকালে পরিবর্তন হলো, যেসব সম্পত্তি জনস্বার্থে লিজ প্রদান করা হয়েছে, সেই সম্পত্তি ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বলে একটি ধারা। ফলে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যে সম্পত্তি পাকিস্তান আমলে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, সেই সম্পত্তি আর ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ রইল না। ফলে অর্পিত সম্পত্তি আইনকে ক্ষেত্রবিশেষে খোলস পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়। অর্পিত সম্পত্তি আইন এর প্রকাশ্য রূপ ছিল অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া সম্পদ ও সম্পত্তির বিষয়ে। কিন্তু সেই আইনটিও পরিবর্তন হয়ে যায় ১৯৭৬ সালে। সামরিক শাসক সেই আইন পরিবর্তন করে অবাঙালিদের অনেক সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে থাকে, যা ছিল রাষ্ট্রীয় স্বার্থেরও পরিপন্থী। কিন্তু পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিশ্রুতিতে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের শর্ত হিসেবে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরও তারা সেই আইনটি কার্যকর করতে পারেনি। শুধু সংসদের শেষ অধিবেশনে আইনটি উত্থাপন করা হয়, কিন্তু আইনে পরিণত হয়নি। ওই সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কিছু করতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালেও আওয়ামী লীগ সেই পুরনো প্রতিশ্রুতি নতুন করে প্রদান করে। তাতে বলা হয়, অর্পিত সম্পত্তি আইনসংক্রান্ত সমস্যাটির তাঁরা সমাধান করবেন। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম, আওয়ামী লীগ খুব একটা উৎসাহী নয়। অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এখনো প্রত্যাশা করে, আওয়ামী লীগ হয়তো বিষয়টি সুরাহা করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগেরই সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুখ থেকে শোনা যায়, কিছু সুবিধাবাদী মানুষ চায় না এই কালো অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটুক। অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আওয়ামী লীগ যদি কথা না রাখতে পারে, তাহলে আমাদের বলুক যে আমরা নির্বাচনে জেতার জন্য এসব বলি, পরে ভুলে যাই।'
এই আইনের কতটা অপপ্রয়োগ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ থেকে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনায় বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন এবং তৎকালীন গণপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে পুত্রসহ তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক জি সি দেবকেও জীবন দিতে হয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে। আবার সূর্য সেনের কথা যদি ধরি, তিনি তো ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁদের কি আমরা শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করতে থাকব? তাঁদের সম্পত্তি কোন কারণে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে? এই চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াটি আমাদের অকৃতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাই শত্রু সম্পত্তি তথা অর্পিত সম্পত্তি আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে যে অনাচার করা হয়েছে, তা অতি দ্রুত সমাধান করা হোক। আর খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সম্পত্তি ও বাড়িঘর রক্ষার জন্য সরকার অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.