রুমানা মনজুরের ওপর নির্যাতন আমাদের সংগঠিত করুক by ওমর তারেক চৌধুরী
আজ আমরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন আর সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনায় আজ আমরা তীব্র ঘৃণা আর ক্ষোভ প্রকাশের জন্য রাজপথে নেমে এসেছি। আজ এখানে আমরা বিচারের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। নারীর ওপর পারিবারিক নির্যাতনসহ সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ জানাতে এবং সর্বস্তরের মানুষকে এসব বর্বরতা
প্রতিরোধে সাহসী, সংঘবদ্ধ আর সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতে জমায়েত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মনজুরকে গত ৫ জুন তাঁর বর্বর স্বামী যে অবর্ণনীয় নৃংশসভাবে শারীরিক নিপীড়ন করেছে, সে সংবাদ আমাদের সবার জানা। আমরা অনুমান করি, আমাদের মতো পুরো দেশই আজ সে নিপীড়নের ঘটনায় হতবিহ্বল এবং ক্ষুব্ধ। আমাদের মতোই সমগ্র দেশবাসী রুমানা মনজুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসাসহ তাঁর পূর্ণ আরোগ্য কামনার পাশাপাশি এই বর্বরতার বিচার দাবি করছে।
আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে অবশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্বরোচিত এ ঘটনার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর সাধারণ মানুষকে সোচ্চার হওয়া, হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ এবং পরিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের সক্রিয়তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সক্রিয়তা শ্রেণী-পেশা-সামাজিক-অবস্থান-আর্থিক সংগতি-নির্বিশেষে পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার সব নারীর ক্ষেত্রেই সমভাবে অব্যাহত থাকবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। আমরা আশা করি, অবিলম্বে এই অপরাধীর বিচার শুরু হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব ছাড়া এই অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর জন্য এক নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। অধ্যাপক রুমানা মনজুরকে নিয়ে আমাদের আন্তরিক উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবাদ ও দাবি শুধু তাঁকে কেন্দ্র করে নয়। কারণ রুমানা মনজুরের ঘটনাটি বর্বর-নৃশংসতায় অতুলনীয় এবং অবর্ণনীয় হলেও আমাদের সমাজে নারীর ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রম নয়। বরং জানা ও অজানা, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের কাছে আসা ও না আসা, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি একটিমাত্র শীর্ষস্থানীয় ঘটনা। পরিবার, কর্মস্থল, বিদ্যাঙ্গন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন_সর্বত্র নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানির ঘটনা বিরামহীন ঘটে চলেছে। স্বামীর নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তিহীন, ক্ষতবিক্ষত শরীরে অসহায় রুমানা মনজুর যখন হাসপাতালে নিরাপত্তাহীন দিন যাপন করছিলেন, তখনই গত ১৩ মে মতিঝিলে এক স্বামী পিটিয়ে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। একই দিন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা এলাকায় দুর্বৃত্তরা সিঙ্গাপুর প্রত্যাগত এক নারী শ্রমিককে গণধর্ষণের পর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এগুলোও কোনো বিরল বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। নারী নিপীড়নের এমন ঘটনা সারা দেশে প্রতিমুহূর্তেই ঘটছে; যার প্রকৃত কোনো হিসাব হয়তো কারো জানা নেই। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত এবং প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পদক্ষেপ অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর। হঠাৎ হঠাৎ 'বড়' কোনো ঘটনায় আমরা নড়েচড়ে বসি; তারপর দুঃখজনকভাবে বিরামহীনভাবে এমন ঘটনা চলতেই থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন লাগাতার প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের। সামাজিক সচেতনতা, পুরো সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার সামগ্রিক উদ্যোগ, আইন প্রয়োগ, নির্যাতনের শিকারের পাশে দাঁড়ানো; তাদের নৈতিক, আইনি, চিকিৎসা, কাউন্সেলিং এবং পুনর্বাসনের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। সমভাবে প্রয়োজন নির্যাতকদের বিচার করা।
নারী নির্যাতনের সার্বিক অবস্থার আংশিক চিত্র পাওয়া যাবে গত মাসের কিছু খতিয়ান থেকে। মে মাসে ৯ নারী ও ১০ শিশু আত্মহত্যা করেছে। নারীদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ৭৪টি ঘটনা শুধু সংবাদপত্রেই এসেছে। তিন তরুণী আত্মহত্যা করেছেন যৌন হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে। একই সময়ে সারা দেশ থেকে ৩৫ জনের ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে; যার মধ্যে ২৪টি শিশু রয়েছে। গণধর্ষণ ঘটেছে ১২টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনকে। এ সবই নারী ও শিশু নির্যাতনের আংশিক চিত্র, যা কেবল সংবাদমাধ্যম বা পুলিশের হিসাবে এসেছে। আমরা জানি, সামগ্রিক অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। নারী-পুরুষ সবার জন্যই ভয়াবহ এ অমানবিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই আমরা। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, মৌখিক হয়রানি, মানসিক নির্যাতন চূড়ান্ত বিচারে সমাজের সব নারী-পুরুষ-শিশুকে সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অবস্থা কোনো সুস্থ সমাজের জন্য কাম্য নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে এমন অবস্থার অবসান চাই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা নিচের দাবি ও আহ্বান সবার সামনে তুলে ধরছি_
১. অধ্যাপক রুমানা মনজুরের নিপীড়ক বর্বর স্বামীকে অবিলম্বে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া এই অপরাধীকে সহায়তা দানকারীদেরও বিচারের আওতায় এনে 'অপরাধীর সহায়তা দানকারীকেও ছাড় না দেওয়ার' দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে; ২. অধ্যাপক রুমানা মনজুরের মেয়েসহ তাঁর পুরো পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৩. বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, নির্দিষ্টসংখ্যক নারী কর্মীসংবলিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের পারিবারিক নির্যাতনসহ যেকোনো ধরনের হয়রানি, নিপীড়নমূলক প্রকৃত বা সম্ভাব্য ঘটনায় সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারি ব্যবস্থা ও নীতিমালা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে; ৪. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিচারব্যবস্থাকে সত্যিকার অর্থে নারীসংবেদী করে গড়ে তুলতে হবে; ৫. আক্রান্ত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে হয়রানিবিহীন আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সরকারি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে; ৬. নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি উদ্যোগ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়ার জন্য দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনি সহায়তা দানকারী সংস্থা ও নারী সংগঠনগুলোকে সরকারি কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ৭. নিপীড়নের শিকার ও তাঁর পরিবারের জন্য মনস্তাত্তি্বক সহায়তা পরিষেবার ব্যবস্থা চালু করতে হবে; ৮. নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়, এ ধরনের নাটক, গান, বিজ্ঞাপন, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার থেকে গণমাধ্যমকে (রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র) বিরত হতে কঠোর সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; ৯. মালিকানার ধরন নির্বিশেষে সব রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রের জন্য নারী সংগঠনগুলোর নারী নির্যাতনবিরোধী জনসচেতনতামূলক নির্দিষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন নিখরচায় প্রচার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ১০. নারী নির্যাতনের সব ঘটনাকে শহর-গ্রাম-ধনী-গরিব, পেশা-সামাজিক অবস্থা-নির্বিশেষে সমভাবে সমগুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সব শেষে বলা দরকার, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এ ক্ষেত্রে। নারীর ওপর নির্যাতন আসলে চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সবার ওপর নির্যাতন। রুমানা মনজুরের ঘটনা এ সত্যকে আমাদের সামনে স্বচ্ছ করে তুলে ধরেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার সনাতনি তথাকথিত সম্মান, পারিবারিক মর্যাদা, দুর্নাম ইত্যাদি চিন্তার বাইরে গিয়ে নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া, এর প্রতিবাদে মুখ খোলা, সংগঠিত হওয়া এবং অবিলম্বে নির্যাতন প্রতিহত করতে নির্দ্বিধায় পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, পুলিশ, আইনি সহায়তা দানকারী ও নারী সংগঠনগুলোর মতো পেশাদারি সংস্থার সহায়তা চাওয়া। আমাদের নীরবতা নির্যাতক-নিপীড়ককে বেড়ে উঠতে বল্গাহীন করে তোলে। আসুন, আমরা সবাই নীরবতার এই জাল ছিন্ন করি। কেননা সোচ্চার ও প্রতিবাদী হওয়াই আমাদের অন্যতম রক্ষাকবচ।
লেখক : বিএনপিএসের পরিচালক
otc1960@gmail.com
আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে অবশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্বরোচিত এ ঘটনার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর সাধারণ মানুষকে সোচ্চার হওয়া, হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ এবং পরিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের সক্রিয়তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সক্রিয়তা শ্রেণী-পেশা-সামাজিক-অবস্থান-আর্থিক সংগতি-নির্বিশেষে পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার সব নারীর ক্ষেত্রেই সমভাবে অব্যাহত থাকবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। আমরা আশা করি, অবিলম্বে এই অপরাধীর বিচার শুরু হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব ছাড়া এই অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর জন্য এক নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। অধ্যাপক রুমানা মনজুরকে নিয়ে আমাদের আন্তরিক উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবাদ ও দাবি শুধু তাঁকে কেন্দ্র করে নয়। কারণ রুমানা মনজুরের ঘটনাটি বর্বর-নৃশংসতায় অতুলনীয় এবং অবর্ণনীয় হলেও আমাদের সমাজে নারীর ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রম নয়। বরং জানা ও অজানা, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের কাছে আসা ও না আসা, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি একটিমাত্র শীর্ষস্থানীয় ঘটনা। পরিবার, কর্মস্থল, বিদ্যাঙ্গন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন_সর্বত্র নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানির ঘটনা বিরামহীন ঘটে চলেছে। স্বামীর নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তিহীন, ক্ষতবিক্ষত শরীরে অসহায় রুমানা মনজুর যখন হাসপাতালে নিরাপত্তাহীন দিন যাপন করছিলেন, তখনই গত ১৩ মে মতিঝিলে এক স্বামী পিটিয়ে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। একই দিন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা এলাকায় দুর্বৃত্তরা সিঙ্গাপুর প্রত্যাগত এক নারী শ্রমিককে গণধর্ষণের পর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এগুলোও কোনো বিরল বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। নারী নিপীড়নের এমন ঘটনা সারা দেশে প্রতিমুহূর্তেই ঘটছে; যার প্রকৃত কোনো হিসাব হয়তো কারো জানা নেই। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত এবং প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পদক্ষেপ অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর। হঠাৎ হঠাৎ 'বড়' কোনো ঘটনায় আমরা নড়েচড়ে বসি; তারপর দুঃখজনকভাবে বিরামহীনভাবে এমন ঘটনা চলতেই থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন লাগাতার প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের। সামাজিক সচেতনতা, পুরো সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার সামগ্রিক উদ্যোগ, আইন প্রয়োগ, নির্যাতনের শিকারের পাশে দাঁড়ানো; তাদের নৈতিক, আইনি, চিকিৎসা, কাউন্সেলিং এবং পুনর্বাসনের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। সমভাবে প্রয়োজন নির্যাতকদের বিচার করা।
নারী নির্যাতনের সার্বিক অবস্থার আংশিক চিত্র পাওয়া যাবে গত মাসের কিছু খতিয়ান থেকে। মে মাসে ৯ নারী ও ১০ শিশু আত্মহত্যা করেছে। নারীদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ৭৪টি ঘটনা শুধু সংবাদপত্রেই এসেছে। তিন তরুণী আত্মহত্যা করেছেন যৌন হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে। একই সময়ে সারা দেশ থেকে ৩৫ জনের ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে; যার মধ্যে ২৪টি শিশু রয়েছে। গণধর্ষণ ঘটেছে ১২টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে পাঁচজনকে। এ সবই নারী ও শিশু নির্যাতনের আংশিক চিত্র, যা কেবল সংবাদমাধ্যম বা পুলিশের হিসাবে এসেছে। আমরা জানি, সামগ্রিক অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। নারী-পুরুষ সবার জন্যই ভয়াবহ এ অমানবিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই আমরা। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, মৌখিক হয়রানি, মানসিক নির্যাতন চূড়ান্ত বিচারে সমাজের সব নারী-পুরুষ-শিশুকে সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অবস্থা কোনো সুস্থ সমাজের জন্য কাম্য নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে এমন অবস্থার অবসান চাই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা নিচের দাবি ও আহ্বান সবার সামনে তুলে ধরছি_
১. অধ্যাপক রুমানা মনজুরের নিপীড়ক বর্বর স্বামীকে অবিলম্বে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া এই অপরাধীকে সহায়তা দানকারীদেরও বিচারের আওতায় এনে 'অপরাধীর সহায়তা দানকারীকেও ছাড় না দেওয়ার' দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে; ২. অধ্যাপক রুমানা মনজুরের মেয়েসহ তাঁর পুরো পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৩. বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, নির্দিষ্টসংখ্যক নারী কর্মীসংবলিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের পারিবারিক নির্যাতনসহ যেকোনো ধরনের হয়রানি, নিপীড়নমূলক প্রকৃত বা সম্ভাব্য ঘটনায় সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারি ব্যবস্থা ও নীতিমালা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে; ৪. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিচারব্যবস্থাকে সত্যিকার অর্থে নারীসংবেদী করে গড়ে তুলতে হবে; ৫. আক্রান্ত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে হয়রানিবিহীন আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সরকারি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে; ৬. নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি উদ্যোগ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়ার জন্য দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনি সহায়তা দানকারী সংস্থা ও নারী সংগঠনগুলোকে সরকারি কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ৭. নিপীড়নের শিকার ও তাঁর পরিবারের জন্য মনস্তাত্তি্বক সহায়তা পরিষেবার ব্যবস্থা চালু করতে হবে; ৮. নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়, এ ধরনের নাটক, গান, বিজ্ঞাপন, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার থেকে গণমাধ্যমকে (রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র) বিরত হতে কঠোর সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; ৯. মালিকানার ধরন নির্বিশেষে সব রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রের জন্য নারী সংগঠনগুলোর নারী নির্যাতনবিরোধী জনসচেতনতামূলক নির্দিষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন নিখরচায় প্রচার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ১০. নারী নির্যাতনের সব ঘটনাকে শহর-গ্রাম-ধনী-গরিব, পেশা-সামাজিক অবস্থা-নির্বিশেষে সমভাবে সমগুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সব শেষে বলা দরকার, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এ ক্ষেত্রে। নারীর ওপর নির্যাতন আসলে চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সবার ওপর নির্যাতন। রুমানা মনজুরের ঘটনা এ সত্যকে আমাদের সামনে স্বচ্ছ করে তুলে ধরেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার সনাতনি তথাকথিত সম্মান, পারিবারিক মর্যাদা, দুর্নাম ইত্যাদি চিন্তার বাইরে গিয়ে নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া, এর প্রতিবাদে মুখ খোলা, সংগঠিত হওয়া এবং অবিলম্বে নির্যাতন প্রতিহত করতে নির্দ্বিধায় পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, পুলিশ, আইনি সহায়তা দানকারী ও নারী সংগঠনগুলোর মতো পেশাদারি সংস্থার সহায়তা চাওয়া। আমাদের নীরবতা নির্যাতক-নিপীড়ককে বেড়ে উঠতে বল্গাহীন করে তোলে। আসুন, আমরা সবাই নীরবতার এই জাল ছিন্ন করি। কেননা সোচ্চার ও প্রতিবাদী হওয়াই আমাদের অন্যতম রক্ষাকবচ।
লেখক : বিএনপিএসের পরিচালক
otc1960@gmail.com
No comments