কাল রঙ্গ-আমাদের �ব্লেক-সার্বভৌমত্ব� by হিলাল ফয়েজী

পাকিস্তান হওয়ার সময় বাগবাগ কবি গোলাম মোস্তফা স্বীয় আজাদ কলমে �পাকিস্তানের অভাব কি� নামে একটি পদ্যকবিতা রচনা করে সদ্যোজাত দেশটির সংখ্যাগুরু অংশকে গুরুতর আনন্দ দানে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জ��ভাগ্য পাকিস্তানের মতো সুপ্রসন্ন ছিল না।


�হাত মে বিড়ি, মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান� বলে একটি ব্যঙ্গ-বাক্য তখন বেশ চালু ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দাবি করতে গিয়ে ব্রিটিশ শাসকের কাছ থেকে এক দিনের জেল, এক বিন্দু রক্ত, এক ইঞ্চি ধাওয়া পর্যন্ত ভোগ করতে হয়নি পাকিস্তানপন্থী কোনো নেতার। এটি ইতিহাসের অকাট্য ও অভ্রান্ত সত্য। মানব-ইতিহাসে এমন মুফতে-মোয়া রাষ্ট্র আর কোনো উপনিবেশের বরাতে জুটেছে বলে শুনিনি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের গভীরে অনেক রক্ত, অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট, অনেক দুর্ভোগ। গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধনের মতো বিশাল ট্র্যাজেডি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল আওয়াজ : ইমান, একতা, শৃঙ্খলা। প্রকৃতপক্ষে ওই দেশের সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য, জাতিগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য ইমান-আমান বলতে গেলে ছিলই না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা কায়েদে আজমকে ওরা কায়দা করে ধীর-বিষক্রিয়ায় (স্লো-পয়জনিং) হত্যা করেছে, দুই নম্বর নেতা উজিরে আজম কায়েদে মিল্লাতকে ওরা দ্রুতগতির বুলেটে রাওয়ালপিন্ডির জনসভায় বধ করেছে পাকিস্তান হওয়ার পর পরই। এমনই ছিল পাকিস্তানের একতার দশা। আর শৃঙ্খলা? পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিজের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বেশ কয়েকবার জয়লাভে সক্ষম হয়েছে-সে দেশের একজন শ্রদ্ধেয়, সাহসী বিচারপতি এ কথা বলেছিলেন। এমনি পাকিস্তানে একত্র থাকতে চায়নি বলে বাঙালিকে অনেক ত্যাগ, অনেক তিতিক্ষার প্রমাণ দিতে হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সক্ষম জনগণের একটি বিশেষ পরীক্ষা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়ে গেছে। সেই বছরটিতে কে কী ভূমিকা পালন করেছিল? পাকিস্তানের জন্মের সময় আহ্লাদে আট সহস্রখানা কবি গোলাম মোস্তফা তখন ধরাধামে উপস্থিত ছিলেন না। �পাকিস্তানের অভাব কি� পদ্যখানা ঘুরিয়ে তাহলে তখন তাঁকে শোনানো যেত : নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা এবং হিংস্রতার অভাব পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কখনোই ছিল না। উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরুর সব বরফ এনে দিলেও পাকিস্তানি ফিল্ড মার্শাল-জেনারেলদের গরম মস্তিষ্ক শীতল করার পার্থিব কোনো উপায় ছিল না। এমনি সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক আক্রমণে যখন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পিত গণহত্যা ও ধর্ষণের অভিযান চলছিল, ঠিক সেই সময়ে এক গাট্টাগোট্টা বাঙালি নবজোয়ান, তাঁর নিজ গ্রামেই শুয়ে-বসে কাল কাটিয়েছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। পরবর্তীকালে ইনিই মানবাধিকারের অগ্রনায়ক, ব্যারিস্টার, মন্ত্রী এবং সার্বভৌমত্বের জন্য জান কোরবান বাংলাদেশি অন্যতম জবরদস্ত নেতায় পরিণত হলেন। এমনই অনেক তারকা এখন বঙ্গ-অঙ্গ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সেই সময় মানব-ইতিহাসের নিকৃষ্ট ও অতিশয় হার্মাদি-বদ প্রতিষ্ঠান আল-বদরের অন্যতম মূল সংগঠকটি একটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা স্বীয় গাড়িতে পত পত উড়িয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিত্য-আহাজারি ক্রন্দন-আসর জমিয়ে তুলতেন। �মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক� দাবিদারের তারকা জ্যেষ্ঠ সন্তান ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাংলাদেশের প্রধানতম দুশমন গোলাম প্রধানের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে �মহাঐতিহাসিক করমর্দন� সম্পন্ন করে মুক্তিযোদ্ধা-আল-বদর সম্মিলনে বোধ করি বাংলাদেশি �মুক্তি-বদর� নামক এক প্রজাতির জ�� দান করেছিল। বাংলাদেশকে জ�ে�র আঁতুড়ঘরে বধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল যারা, পরবর্তী সময়ে তারাই হয়ে উঠল দিকে দিকে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে চলা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের মহান মুক্তি-বদর জিকির বাহিনী।
মুসলিম লীগ প্রভৃতি+ভাসানী ন্যাপ ইত্যাদি+অধঃপতিত মুক্তিযোদ্ধার মিশেল দিয়ে সেনাদুর্গ থেকে টোপ প্রলোভন+ভীতি প্রকৌশলে একটি রাজনৈতিক কম্পোস্ট সার তৈরি করা হলো ১৯৭৫-এ মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃবর্গকে বধ করার পর। এই কম্পোস্ট সারটির রাজনৈতিক সংক্ষেপিত পরিচয় বিএনপি, যাদের মূল রণধ্বনি হয়ে গেল স্বাধীনতা+সার্বভৌমত্ব। এই ক্যান্টনমেন্ট-টেস্টটিউবে জন্ম নেওয়া দলটি �সার্বভৌমত্ব� শব্দটিকে এমন জায়গায় নিয়ে গেল, যেন মনে হলো, তাদের বিরোধী প্রতিপক্ষ দেশটির সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি বিকিয়েই দিয়ে যাচ্ছে। আর তারা শুধু সেই �সার্বভৌমত্ব� নামক নাজুক বিষয়টিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য পৃথিবীর সব আকুলতা, সব ব্যাকুলতা নিয়ে সদা ব্যতিব্যস্ত-নিবেদিত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও মহাবিপন্ন অবস্থায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, ম্যাডাম, আপনার সৈন্য দল ফিরিয়ে নেবেন কবে? মানব-ইতিহাসে এ রকম পরিস্থিতিতে অনুরূপ আরেকটি বাক্য উচ্চারণের উদাহরণ দেখাবেন কেউ? অথচ এমনি মহানায়ককে বধ করার পর ঘাতক বাহিনী তাঁকে �তাঁবেদার� নামক একটি জঘন্য বিশেষণে অসম্মানিত করেছিল। এই হত্যাকারী এবং পরবর্তী সময়ে এই ক্যান্টনমেন্ট-টেস্টটিউব পার্টির মহাজনরা পৃথিবীর কোন কোন শক্তির, কোন কোন গোয়েন্দা বাহিনীর কতটুকু নিকৃষ্ট তাঁবেদার হিসেবে কাজ করেছে সে বিষয়ে অজস্র মহাকাব্য রচনা কঠিন কিছুই নয়।
তারপর আমাজন-নীল-ভল্গা-গঙ্গা-সিন্ধু দিয়ে অনেক সলিল প্রবাহিত হয়ে গেছে। এককালের মহাশক্তি সোভিয়েত রাষ্ট্র-কাঠামো ভাঙচুর হয়ে গেছে। পৃথিবীতে একক পরাশক্তির মহাদম্ভ নিয়ে জেগে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওদিকে সমাজতন্ত্রী গণচীন একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মদদে �বিস্ময়কর পুঁজিবাদ� গড়ে তুলে ওই একক পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে আছে বিশ্ব অর্থনীতির রণাঙ্গনে। বাংলাদেশে যখন কিঞ্চিৎ তেল-গ্যাস পাওয়া গেল, তখন বাংলাদেশের প্রতি শ্যেন নজর পড়ল মার্কিন-ভারত-ইউরোপসহ নানাবিধ কম্পানির। উড়াল দিয়ে চলে এলেন স্বয়ং রাষ্ট্রস্বামী ক্লিনটন বিল সাহেব। খুদে দেশের �দুর্বল কাণ্ডারি� এমন মহাপরাক্রমশালীর মুখের ওপর বলেই ফেললেন, আগে বাংলাদেশের জন্য ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ রাখব, তারপর ভেবে দেখব গ্যাস রপ্তানি করব কি না! এমন �বেয়াদব�কে ক্ষমতায় ফিরে আসতে দেওয়া যায় কি? অবশ্যই না। অতএব বাংলাদেশের মার্কিন ও ভারতের কম্পানিসংশ্লিষ্ট সব আমলা-গামলা-মুক্তিবদর, �সত্য-শুভ্র-নিরপেক্ষ� মিডিয়া মোড়ল সুশীল-সোহাগ চাঁদ বদনীরা এক হয়ে রাষ্ট্রটিকে তুলে দিল জঙ্গি-সাম্প্রদায়িক চক্রের হাতে। অর্থনৈতিক স্বার্থের বেদিতে ভারত রাষ্ট্রটি বলি দিল তার ঐতিহ্যবাহী নৈতিক আদর্শ। এভাবেই সৃষ্টি হলো ২০০১-এর অমানবিকতা-যজ্ঞের পরিমণ্ডল।
২০০৪ সালে ওই �বেয়াদব� মহিলাকে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায়ের নৃশংস পরিকল্পনা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়। ২০০৭ সালে তাঁকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় দেওয়ার সুশীল-কুশীল-নানাবিধ কুশীলবরা �জরুরি দাওয়াই� দিয়েও সফল হলো না। রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এলেন মহানায়ক-কন্যা। রাষ্ট্রক্ষমতার দ্বন্দ্ব-নীতিকৌশল-প্রতিশোধ প্রভৃতির জেরে তিনি যখন মার্কিনি ডার্লিংবয়-নোবেল মহাজনকে আইনের পথ দেখালেন, অমনি খেপে গেলেন হিলারি ক্লিনটন এবং এ দেশের সুশীল মহাজন ও মুক্তি-বদর বাহিনী। পাঠালেন তাঁর উপসহযোগী একজন ব্লেক নামের কর্মচারী; যিনি বাংলাদেশে এসে স্বাধীন সার্বভৌম সরকারকে প্রকাশ্যে মাফিয়া-মস্তানি ভাষায় হুমকি-খিস্তি করে গেলেন।
বাংলাদেশে অনেকেই তখন প্রমাদ গুনলেন। অনেকে খুশি গোপন করতে ব্যর্থ হলেন। মার্কিন প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ভারতের মনমোহন সরকার তাদের জবরদস্ত মন্ত্রী পর্যন্ত বদলাতে বাধ্য হয়েছে একাধিকবার। এবার কী করবেন বঙ্গপ্রধানমন্ত্রী? ওই বঙ্গনোবেলের হাত-পায়ে ধরাধরি করে সব ধরনের �আইন ভঙ্গের� জন্য আরেকটি রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করে ফেলবেন কি? না, তিনি অটল-অনড়-দৃঢ় রইলেন। আমাদের দেশ, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক�আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান। ভুল করি, শুদ্ধ করি, হিলারি-ব্লেকের ধমক-চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করেই পথ চলব। জাতিসত্তার মর্যাদা এভাবেই রক্ষিত হলো নতুনভাবে। ওই নোবেল-তারকার প্রতি আচরণে দেশের �ভাব ও মূর্তি� বিপন্ন হয়েছে বলে দিকে দিকে হাহাকার উঠল। কিন্তু খুদে একটি দেশের প্রধান নির্বাহী পৃথিবীর এখনো এক নম্বর দেশটির প্রকাশ্য হুমকিকে যেভাবে অগ্রাহ্য করার হিম্মত দেখালেন, এই নব ভাবমূর্তিতে গর্বিত না হওয়ার মেরুদণ্ডহীন সুশীল পণ্ডিতের অভাব এ দেশে কখনোই ঘটবে না বোধ করি।
অতঃপর বঙ্গদেশ থেকে দুটি উড়াল সম্পন্ন হলো ওয়াশিংটন পানে। �বদলে দাও, বদলে যাও� বলে মহান-আহ্বান পাখিটি উড়াল দিয়ে সোজা বসল ব্লেকের কার্যালয়-বৃকে। স্বদেশে ইনি চে গুয়েভারার সুমহান চেতনার পুনর্জাগরণের দৃপ্ত উদ্যোগী সত্তা। উড়াল দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের উপকর্তার কাছে ফুটিয়ে তুললেন মেরুদণ্ডহীনতার সারবত্তা। মার্কিন ডার্লিং-আইকন বঙ্গদেশি নোবেল-তারকার ইনি অন্যতম দখিনা করতল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনকারী ব্লেকের দরবারে কী আরজ গোজার নিয়ে তিনি গেলেন, সে গোপন কথা এক দিন উইকিলিক্সের ছিদ্রপথ দিয়ে জগৎবাসী নিশ্চয়ই জানতে সক্ষম হবে আশা করি।
আরেকটি উড়াল দিলেন আমাদের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী �সার্বভৌমত্ব-মহারানী�, অনেক হোমওয়ার্ক, অনেক দেনদরবার, লবি-গিরি করে তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন �মন� ভেজাতে। অবশেষে মার্কিন দেশে গিয়ে তিনি দেখা পেলেন ওই পুঁচকে মাফিয়া ব্লেক মিয়ারই, সেই দরবারে তিনি নোবেল-তারকা দরদে বিগলনের কোন্ তরিকায় কী নিবেদন করলেন, নিশ্চয়ই একদিন তা-ও প্রকাশিত হবে।
তখন রচিত হবে বঙ্গীয় রাজনীতির ইতিহাসের �আমাদের ব্লেক-সার্বভৌমত্ব� গ্রন্থখানি। আগামী দিনের সেই সম্ভাব্য গ্রন্থপ্রণেতাকে অগ্রিম অভিবাদন জানিয়ে আজ ইতি।
লেখক : রম্য লেখক
« পূর্ববর্তী সংবাদ
       
পরবর্তী সংবাদ »
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার মতামত দিতে এখানে ক্লিক করুন
আপনার মতামত দিন
মতামত দিতে চাইলে অনুগ্রহ করে সাইনইন করুন
* আপনার কোন একাউন্ট না থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করুন
মূল পাতা উপ-সম্পাদকীয়

No comments

Powered by Blogger.