তাঁর জ্যোতির্ময় জীবন by ড. মুহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ
২০ জুন ১৯১১ থেকে ২০ জুন ২০১১ পরিপূর্ণ ১০০ বছর। আজ প্রগতিবাদী বাঙালিরা গভীর শ্রদ্ধায় উদ্যাপন করছেন গরীয়সী নারী, বাঙালি নারী সমাজের আলোকবর্তিকা, আমাদের বাতিঘর বেগম সুফিয়া কামালের জন্মশতবর্ষ। সংগ্রামী অথচ সৃষ্টিশীল সফল জীবনের আধিকারিণী বেগম সুফিয়া কামালের জীবনটাই তো ছিল সংগ্রামের।
বাড়িতে বাংলার চর্চা ছিল না তেমন, তবুও তিনি বাংলা শিখেছেন। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার নিয়ম ছিল না পরিবারে, তবুও তিনি ভাইদের সঙ্গে ছেলে সেজে স্কুলে গেছেন। স্বামীর প্রশ্রয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু এ জন্য তিরস্কৃত হয়েছেন ব্যাপক। তবুও তিনি দমে যাননি। এখানেই তিনি সার্থক। এখানেই তিনি জয়ী। তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়, অনেকেই তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আরো বহু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তিনি এগিয়েছেন এবং তাঁর এই এগিয়ে যাওয়া বাঙালি নারী সমাজে জুগিয়েছে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই, তিনি আমাদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেছেন অত্যন্ত কুণ্ঠাহীনভাবে, সাহসের সঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তাঁর অবস্থান ছিল আপসহীন। একাত্তরে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যে পশুশক্তি হত্যা করেছে, তাদের বিচার চেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন, বিচারের দাবিতে সবার সামনে দাঁড়িয়েছেন। কর্তব্যবোধ থেকে জীর্ণশীর্ণ স্বাস্থ্য নিয়েও সাধ্যের অতীত কাজ করে গেছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রেও আমরা তাঁর উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর পাই। তাঁর কবিতা কেবল বক্তব্যধর্মী নয়, জীবনবোধের প্রাণবন্ত সংস্পর্শে উজ্জীবিত। আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ করি তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাই, তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন অনবরত কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। তাঁর অনন্যতা এখানেই দৃষ্টান্তযোগ্য।
শ্রদ্ধাস্পদ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের কাছে তাঁর সম্পর্কে যা জেনেছিলাম, তা পবিত্র সঞ্চয়। তিনি (সুফিয়া কামাল) বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে কর্মসংশ্লিষ্ট মানুষ ছাড়া খুব কম মানুষই জানতেন, তিনি কত বড় ছিলেন। হয়তো তাঁদেরও অনেকে তা জানতেন না। ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের কাছেই জেনেছিলাম, বিচিত্র ধরনের মানুষকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন, সময় দিতেন, ভালোবাসা দিতেন। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সংগ্রামী স্পৃহা আমাদের একজন উজ্জ্বল, পরিণত বহুপ্রজ কবি থেকে বঞ্চিত করেছে। তিনি যদি শুধু সাহিত্যকর্মে নিজেকে যুক্ত রাখতেন তাহলে আমরা তাঁর আরো অনেক সৃষ্টির স্পর্শ পেতাম। কিন্তু তিনি সামাজিক ক্ষেত্রেও ছিলেন সরব এবং সে জন্য তাঁর অনেক সময় ব্যয় হয় ওই দিকে। সর্বাগ্রে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বলেই হয়তো তিনি প্রতিষ্ঠানও হতে পেরেছিলেন, যে প্রতিষ্ঠান থেকে পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ঊননব্বই বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ ঘটে এবং অবশ্যই পরিণত বয়স। কিন্তু সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের প্রয়োজন কখনো ফুরোয় না; বরং উত্তরোত্তর বাড়ে এবং যত পরিণত বয়সেই তাঁদের প্রয়াণ ঘটুক না কেন, তাঁদের প্রয়াণ এ কারণেই অকালপ্রয়াণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বেগম রোকেয়াই কি জীবনের চলার পথে তাঁর আদর্শ ছিলেন? প্রশ্নটি মহীয়সী সুফিয়া কামালের জীবদ্দশায়ও উঠেছে। আমরা জেনেছি, বেগম রোকেয়াই তাঁর আদর্শ ছিলেন। সুফিয়া কামাল ও শামসুন্নাহার মিলে বেগম রোকেয়ার আদর্শ পিছিয়েপড়া বাঙালি মুসলমান নারী সমাজে প্রচার করতে শুরু করেন। বাঙালি নারী সমাজে ঢাকায় গড়ে উঠেছিল একটি বিকল্প নারী সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র। ওই কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন শামসুন্নাহার, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহেরা বানু প্রমুখ। তাঁদেরই প্রস্তাব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হলের নাম রোকেয়া হল রাখার। আপত্তি উঠেছিল জোর, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেগম সুফিয়া কামালের প্রবল চেষ্টার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হলের নাম রাখা হয় বেগম রোকেয়া হল। কিন্তু এই কঠিন কাজটি সম্পাদন করার পুরো কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে। ইতিহাসে এসব উজ্জ্বলভাবে স্থান দখল করে আছে। এখানেই তাঁর মহত্ত্বের সন্ধান আমরা পাই। একজন কত বড় মাপের মানুষ নিজের কৃতিত্বের মালা অন্যের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারেন, এর দৃষ্টান্ত প্রয়াত সুফিয়া কামাল।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে তিনি গভীরভাবে জানতেন ও চিনতেন। আর এ জন্যই উদ্যোক্তাদের তিনি বলেছিলেন, তাঁকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান না করে জাহানারা ইমামকে প্রধান করতে। তাঁর নির্দেশ মেনেই জাহানারা ইমামকে আন্দোলনের পুরোধা করে নিয়ে আসা হয়। এর পরের সব কিছুই ইতিহাস। ইতিহাসের বন্ধ দরজা খুলে গিয়েছিল বেগম সুফিয়া কামালের হাত দিয়ে। আকার-আঙ্গিকে ছোটখাটো একজন মানুষ কত বড় মানুষ হয়ে আমাদের পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তা ভাবতেই গর্বে বুক ভরে যায়। বুক ভরে যায় এ কারণে যে আমরা তো তাঁরই উত্তরসূরি, তাঁরই সন্তান, তিনি আমাদের জননী। স্বেচ্ছাচারী, দুর্নীতিবাজ, অবৈধ ক্ষমতাবান আর হীনস্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বরাবরই ছিল দ্বিধাহীন ও শঙ্কাহীন। যদি তা-ই না হতো, তাহলে মুখের ওপর জালিম শাহী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে তিনি কী করে বলেছিলেন, আপনি তো জানোয়ারের রাজা! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদে কয়জন বাঙালির বুকের পাটা আমরা এমন চওড়া পেয়েছি? আমরা কীর্তি ও ইতিহাসের জন্য তাঁর নাম নির্ধারণ করে রাখলাম। তিনি বাংলাদেশের জননী। জননীর তো কখনো মৃত্যু হয় না। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষের এই দিনে আমাদের ইতিহাসের চিরকালের মানুষ বেগম সুফিয়া কামালকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলতে চাই, আজকের এই বিপন্ন সময়ে তাঁর আদর্শ ও সাহস ধারণ করে অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রগতিবাদী সবার সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি তো আমাদের প্রেরণা হয়ে আছেনই।
এ দেশের যেকোনো দুর্যোগে জাতির বিপদের মুহূর্তে অভয়দাত্রীরূপে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচার, দুঃশাসন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অশুভ আস্ফালন_সর্বক্ষেত্রেই তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সর্বাগ্রে সোচ্চার। এ জন্যই তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি আমাদের কাছে আজও বিরাট শূন্যতা। তিনি সব বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, ডাক দিয়েছেন, শুভশক্তিকে একত্রিত ও সংগঠিত করেছেন। এই কাজ করেন তিনি আমৃত্যু। বেগম সুফিয়া কামালের ত্যাগ, সাধনা ও মানবিক গুণাবলি এমনই বিশাল যে কোনো কিছু দিয়েই তাঁর যোগ্য পরিমাপ সম্ভব নয়। তাঁর উদ্দেশে আমরা কেবল বলতে পারি_আমাদের মা প্রেরণা হয়ে আমাদের মাঝেই আছেন ও থাকবেন। তিনি অবশ্যই মৃত্যুহীন মানুষ। আমরা যেন তাঁর স্বপ্নপূরণ ব্যর্থ করে দিয়ে অকৃতজ্ঞ সন্তান না হই। তিনি এ জাতির বিবেক। তিনি আমাদের নৈতিকভাবে শক্ত থাকার আদেশ দিয়ে গেছেন। আমরা ধন্য, তিনি এ মাটিরই সন্তান। মাতৃস্বরূপ এই মহীয়সী চিরদিন আমাদের অগ্রযাত্রার দিশারি হয়ে থাকবেন। কারণ তিনি তো স্বয়ং আলো। আলোর উৎস আলো। কোথাও তাঁর অন্ধকার নেই। তাঁর জীবন আলোময় সূর্যের মতো পুণ্যময়ী, পরার্থে নিবেদিত জ্যোতিষ্ক। তাঁর উপস্থিতি আমরা সব সময় টের পাই। তাঁর আলোময় জীবনের দ্যুতি এ সমাজে আলো ছড়াচ্ছে।
লেখক : গবেষক
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই, তিনি আমাদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেছেন অত্যন্ত কুণ্ঠাহীনভাবে, সাহসের সঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তাঁর অবস্থান ছিল আপসহীন। একাত্তরে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যে পশুশক্তি হত্যা করেছে, তাদের বিচার চেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন, বিচারের দাবিতে সবার সামনে দাঁড়িয়েছেন। কর্তব্যবোধ থেকে জীর্ণশীর্ণ স্বাস্থ্য নিয়েও সাধ্যের অতীত কাজ করে গেছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রেও আমরা তাঁর উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর পাই। তাঁর কবিতা কেবল বক্তব্যধর্মী নয়, জীবনবোধের প্রাণবন্ত সংস্পর্শে উজ্জীবিত। আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ করি তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাই, তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন অনবরত কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। তাঁর অনন্যতা এখানেই দৃষ্টান্তযোগ্য।
শ্রদ্ধাস্পদ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের কাছে তাঁর সম্পর্কে যা জেনেছিলাম, তা পবিত্র সঞ্চয়। তিনি (সুফিয়া কামাল) বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে কর্মসংশ্লিষ্ট মানুষ ছাড়া খুব কম মানুষই জানতেন, তিনি কত বড় ছিলেন। হয়তো তাঁদেরও অনেকে তা জানতেন না। ওয়াহিদুল হক ভাইয়ের কাছেই জেনেছিলাম, বিচিত্র ধরনের মানুষকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন, সময় দিতেন, ভালোবাসা দিতেন। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সংগ্রামী স্পৃহা আমাদের একজন উজ্জ্বল, পরিণত বহুপ্রজ কবি থেকে বঞ্চিত করেছে। তিনি যদি শুধু সাহিত্যকর্মে নিজেকে যুক্ত রাখতেন তাহলে আমরা তাঁর আরো অনেক সৃষ্টির স্পর্শ পেতাম। কিন্তু তিনি সামাজিক ক্ষেত্রেও ছিলেন সরব এবং সে জন্য তাঁর অনেক সময় ব্যয় হয় ওই দিকে। সর্বাগ্রে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বলেই হয়তো তিনি প্রতিষ্ঠানও হতে পেরেছিলেন, যে প্রতিষ্ঠান থেকে পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ঊননব্বই বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ ঘটে এবং অবশ্যই পরিণত বয়স। কিন্তু সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের প্রয়োজন কখনো ফুরোয় না; বরং উত্তরোত্তর বাড়ে এবং যত পরিণত বয়সেই তাঁদের প্রয়াণ ঘটুক না কেন, তাঁদের প্রয়াণ এ কারণেই অকালপ্রয়াণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বেগম রোকেয়াই কি জীবনের চলার পথে তাঁর আদর্শ ছিলেন? প্রশ্নটি মহীয়সী সুফিয়া কামালের জীবদ্দশায়ও উঠেছে। আমরা জেনেছি, বেগম রোকেয়াই তাঁর আদর্শ ছিলেন। সুফিয়া কামাল ও শামসুন্নাহার মিলে বেগম রোকেয়ার আদর্শ পিছিয়েপড়া বাঙালি মুসলমান নারী সমাজে প্রচার করতে শুরু করেন। বাঙালি নারী সমাজে ঢাকায় গড়ে উঠেছিল একটি বিকল্প নারী সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র। ওই কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন শামসুন্নাহার, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহেরা বানু প্রমুখ। তাঁদেরই প্রস্তাব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হলের নাম রোকেয়া হল রাখার। আপত্তি উঠেছিল জোর, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেগম সুফিয়া কামালের প্রবল চেষ্টার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হলের নাম রাখা হয় বেগম রোকেয়া হল। কিন্তু এই কঠিন কাজটি সম্পাদন করার পুরো কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে। ইতিহাসে এসব উজ্জ্বলভাবে স্থান দখল করে আছে। এখানেই তাঁর মহত্ত্বের সন্ধান আমরা পাই। একজন কত বড় মাপের মানুষ নিজের কৃতিত্বের মালা অন্যের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারেন, এর দৃষ্টান্ত প্রয়াত সুফিয়া কামাল।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে তিনি গভীরভাবে জানতেন ও চিনতেন। আর এ জন্যই উদ্যোক্তাদের তিনি বলেছিলেন, তাঁকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান না করে জাহানারা ইমামকে প্রধান করতে। তাঁর নির্দেশ মেনেই জাহানারা ইমামকে আন্দোলনের পুরোধা করে নিয়ে আসা হয়। এর পরের সব কিছুই ইতিহাস। ইতিহাসের বন্ধ দরজা খুলে গিয়েছিল বেগম সুফিয়া কামালের হাত দিয়ে। আকার-আঙ্গিকে ছোটখাটো একজন মানুষ কত বড় মানুষ হয়ে আমাদের পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তা ভাবতেই গর্বে বুক ভরে যায়। বুক ভরে যায় এ কারণে যে আমরা তো তাঁরই উত্তরসূরি, তাঁরই সন্তান, তিনি আমাদের জননী। স্বেচ্ছাচারী, দুর্নীতিবাজ, অবৈধ ক্ষমতাবান আর হীনস্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান বরাবরই ছিল দ্বিধাহীন ও শঙ্কাহীন। যদি তা-ই না হতো, তাহলে মুখের ওপর জালিম শাহী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে তিনি কী করে বলেছিলেন, আপনি তো জানোয়ারের রাজা! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদে কয়জন বাঙালির বুকের পাটা আমরা এমন চওড়া পেয়েছি? আমরা কীর্তি ও ইতিহাসের জন্য তাঁর নাম নির্ধারণ করে রাখলাম। তিনি বাংলাদেশের জননী। জননীর তো কখনো মৃত্যু হয় না। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষের এই দিনে আমাদের ইতিহাসের চিরকালের মানুষ বেগম সুফিয়া কামালকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলতে চাই, আজকের এই বিপন্ন সময়ে তাঁর আদর্শ ও সাহস ধারণ করে অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রগতিবাদী সবার সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি তো আমাদের প্রেরণা হয়ে আছেনই।
এ দেশের যেকোনো দুর্যোগে জাতির বিপদের মুহূর্তে অভয়দাত্রীরূপে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচার, দুঃশাসন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অশুভ আস্ফালন_সর্বক্ষেত্রেই তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সর্বাগ্রে সোচ্চার। এ জন্যই তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি আমাদের কাছে আজও বিরাট শূন্যতা। তিনি সব বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, ডাক দিয়েছেন, শুভশক্তিকে একত্রিত ও সংগঠিত করেছেন। এই কাজ করেন তিনি আমৃত্যু। বেগম সুফিয়া কামালের ত্যাগ, সাধনা ও মানবিক গুণাবলি এমনই বিশাল যে কোনো কিছু দিয়েই তাঁর যোগ্য পরিমাপ সম্ভব নয়। তাঁর উদ্দেশে আমরা কেবল বলতে পারি_আমাদের মা প্রেরণা হয়ে আমাদের মাঝেই আছেন ও থাকবেন। তিনি অবশ্যই মৃত্যুহীন মানুষ। আমরা যেন তাঁর স্বপ্নপূরণ ব্যর্থ করে দিয়ে অকৃতজ্ঞ সন্তান না হই। তিনি এ জাতির বিবেক। তিনি আমাদের নৈতিকভাবে শক্ত থাকার আদেশ দিয়ে গেছেন। আমরা ধন্য, তিনি এ মাটিরই সন্তান। মাতৃস্বরূপ এই মহীয়সী চিরদিন আমাদের অগ্রযাত্রার দিশারি হয়ে থাকবেন। কারণ তিনি তো স্বয়ং আলো। আলোর উৎস আলো। কোথাও তাঁর অন্ধকার নেই। তাঁর জীবন আলোময় সূর্যের মতো পুণ্যময়ী, পরার্থে নিবেদিত জ্যোতিষ্ক। তাঁর উপস্থিতি আমরা সব সময় টের পাই। তাঁর আলোময় জীবনের দ্যুতি এ সমাজে আলো ছড়াচ্ছে।
লেখক : গবেষক
No comments