কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

বন্ধু, কী খবর বল। কত দিন দেখা হয়নি। জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গানের এই কলি মনে এল মহিলা সমিতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে। দিন চার-পাঁচ আগে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নষ্টনীড়' গল্পটি নিয়ে নাটক মঞ্চায়নের জন্য সেখানে গিয়েছি। 'নষ্টনীড়' গল্পের মঞ্চভ্রমণ শুরু হলো মহিলা সমিতির সেই পুরনো মঞ্চ থেকে।


৩৮ বছরের পুরনো সংগঠন ঢাকা থিয়েটারের প্রথম রবীন্দ্রনাথ মঞ্চায়নের সঙ্গে জড়িয়ে গেল মহিলা সমিতির নাম। শতবর্ষ পরে বিষয়টি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ হবে তাঁদের কাছে, যাঁরা বাংলাদেশের নাট্য ইতিহাস বিষয়ে সুলুকসন্ধান করবেন। শুধু কি এই একটি মাত্র বিষয়ে! বাংলাদেশের নবনাট্যচর্চার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে তো একটা বিরাট অংশজুড়েই উঠে আসবে ঢাকার মহিলা সমিতির সক্রিয় সহায়তার কথা। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রায় ৪০ বছরের পথপরিক্রমায় যে কয়টি নাট্য প্রযোজনাকে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার বেশির ভাগই তো মহিলা সমিতির শীর্ণকায়, ক্ষীণতনুর মঞ্চ এবং মিলনায়তনে প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছে। সামান্য একটি সেমিনার হল, ছোট্ট একটা মঞ্চ, আধুনিক থিয়েটার চর্চার বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা নেই। তবু সেখানে নাটক হয়েছে। ফুটেছে নাট্যবৃক্ষের ফুল। নানা বর্ণের, নানা আঙ্গিকের, নানা সৌরভের। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা নাটকের গৌরবময় অর্জনের কথা যে কলমেই লেখা হোক না কেন, সেখানে মহিলা সমিতির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। আমার মতো নাট্যকর্মীদের কাছে মহিলা সমিতি তো পুরনো বন্ধুর মতোই। তাকে ভুলব কী করে! হারানো প্রেমের মতোই তার সঙ্গস্মৃতি আমাকে আনন্দ দেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। শিল্পকলার আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবহে অভ্যস্ত নতুন নাট্যকর্মীরা বোধ হয় এটা ঠিকমতো বুঝবেন না। মহিলা সমিতির অনুপযুক্ত মঞ্চে, শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাহীন মিলনায়তনে, ভাপসা গরমে ঘেমেনেয়ে অভিনয় করে কত ক্ষমতাধর গুণবান নট দেহপটের ক্ষতি করেছেন। কত কৃতী অভিনেত্রীর কণ্ঠস্বরের বিকৃতি ঘটেছে উচ্চগ্রামে সংলাপ উচ্চারণ করার ফলে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর স্বাস্থ্যবান্ধবহীন মিলনায়তনে সংলাপ উচ্চারণে স্বরভঙ্গ হবেই তো। বাংলা নাট্যমঞ্চের নমস্য অভিনেতা প্রয়াত মোহাম্মদ জাকারিয়া বলতেন_এভাবে এখানে অভিনয় করলে গলা দিয়ে ভবিষ্যতে আর স্বরই বেরোবে না। আরেক নমস্য অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুনও প্রায় একই কথা বলতেন। একবার রেডিও নাটকের রেকর্ডিংয়ের সময় বলেই ফেললেন, মহিলা সমিতিতে অভিনয় করতে গিয়ে কণ্ঠস্বরের ভীষণ ক্ষতি করে ফেলেছি। সবই সত্য, তবুও কেউ মহিলা সমিতি ছাড়িনি। একমাত্র নাট্যমঞ্চকে বুকে আগলে রেখে বলেছি, তবুও তোমাকে চাই।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর বাংলা নাটক নিয়মিত শুরু হয়েছিল ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। তার আগে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনেও নাটক হয়েছে। আমরা অর্থাৎ ঢাকা থিয়েটার আবিষ্কার করলাম তখন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিত্যক্ত এক বড়সড়, লম্বাটে এক টিনের চালার মিলনায়তন। চারদিক ভাঙাচোরা, অপরিচ্ছন্ন সেই মিলনায়তনকে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গড়ে তুললাম নাটক করার উপযোগী করে। নাটকও হলো সেখানে। তারপর বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তন। এটাকেও নাট্যপ্রযোজনা উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজটি তখনকার নাট্যকর্মীরাই করলেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে নমস্য নীলিমা ইব্রাহিমের সহায়তার কথা পুরনো নাট্যজনরা কি ভুলতে পারবেন! মধ্য ঢাকার বেইলি রোড তখন বিরান এক পথ। যার সঙ্গে এখনকার ঝকমকে বেইলি রোডের কোনো মিল নেই। কোনো শাড়ির দোকান ছিল না, ফাস্টফুড কিংবা অন্যান্য দোকানও ছিল না। ফাঁকা রাস্তার একপাশে একলা মহিলা সমিতি। নাট্যপ্রদর্শনীর দিন কিছু বাড়তি রিকশার ভিড় থাকত। তখন রবিবার সরকারি ছুটির দিনে সকালেও নাট্যপ্রদর্শনী হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরবর্তী সময় এক রবিবারে সকালের প্রদর্শনীতে বলা নেই, কওয়া নেই দেশশাসক জিয়াউর রহমান সদলবলে আমাদের নাটক দেখতে এলেন। সঙ্গে এরশাদ, নুরুল ইসলাম শিশু, মঞ্জুরসহ বাঘা বাঘা সঙ্গী। পুরো বেইলি রোড সেনাসদস্যে ছেয়ে গেল। নিরাপত্তার কারণে নাটকের কিছু শিল্পীকে মিলনায়তনে আসতেও ঝামেলা পোহাতে হলো। সে সময় আমাদের 'মুনতাসীর ফ্যান্টাসি' নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী চলছিল। নাটকের প্রধান চরিত্রের সঙ্গে জিয়া কিভাবে যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মিল খুঁজে পেলেন। নাটক শেষে তিনি আমাদের বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘোষণা করলেন, নাটকটিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। আমরা বঙ্গভবনেও যাইনি এবং যে উদ্দেশ্যে 'মুনতাসীর'কে বিদেশে পাঠাতে চান, তাতে সম্মতও হইনি। বঙ্গভবনে নাট্যপ্রদর্শনী করে পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিল নাট্যদল থিয়েটার। মুনতাসীর প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলি। বঙ্গবন্ধুর জীবিতাবস্থায় আমরা 'মুনতাসীর ফ্যান্টাসি' মঞ্চস্থ করি। তখনো কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়েছিল যে 'মুনতাসীর' চরিত্রটি নাকি বঙ্গবন্ধুকে ব্যঙ্গ করে নির্মাণ করেছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ ছেলে প্রয়াত শেখ কামাল আমাদের দলেরই সদস্য ছিলেন এবং তিনি কুৎসা রটনাকারীদের খুব একটা প্রশ্রয়ও দেননি। এ ক্ষেত্রে বোধ হয় কিছু তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালির সহজাত ঈর্ষা বেশি কাজ করেছিল। যারা কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছিল, তারাই বরং বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সরকারের বিরূপ সমালোচনা করতে গিয়ে হাতের কলম এবং মুখের ভাষাকে খুব একটা ভদ্রজনচিত রাখেনি। আজকাল তাদের মুখেই বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা বাক্যের ফুলঝুরি ছোটে। খারাপ কী! ভালোই তো!
ফিরে আসি পুরনো বন্ধু মহিলা সমিতি প্রসঙ্গে। যে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ৩৮ বছর ধরে অসংখ্য জনপ্রিয় এবং উল্লেখযোগ্য বাংলা নাটক হয়েছে, অনুষ্ঠিত হয়েছে বর্ণাঢ্য উৎসব, মেধাজাগানিয়া সেমিনার, তাকে কিন্তু ঢাকার নাট্যকর্মীরা কখনোই অকৃতজ্ঞচিত্তে অবহেলা করেননি। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমীর আধুনিক সুপরিসর মঞ্চে সরে গিয়েও তারা বারবার ফিরে আসেন মহিলা সমিতির কাছে।
নইলে আমাদের নষ্টনীড় গল্পের মঞ্চভ্রমণ কিভাবে শুরু হলো মহিলা সমিতির অপরিসর পুরনো মঞ্চে! এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি। তবে আর বোধ হয় এই চিরচেনা বন্ধুর মতো মহিলা সমিতিকে আগের চেহারায় পাব না। প্ল্যান পাস হয়ে গেছে। শুরু হবে ভাঙচুর। গড়ে উঠবে বহুতল ভবন। তবে মহিলা সমিতির বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাদের প্ল্যানে যে একটি আধুনিক নাট্য মিলনায়তন ও মঞ্চের ব্যবস্থা রেখেছে, সে জন্য ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব নাট্যকর্মী খুশি হয়েছেন। জয় বাংলা।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.