স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ by এ এম এম শওকত আলী
মন্ত্রিপরিষদ সম্প্রতি স্বাস্থ্যনীতি অনুমোদন করেছে। এরপর থেকেই মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়াও প্রকাশিত হয়েছে। এখনো প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যনীতির প্রারম্ভিক ভূমিকা নাতিদীর্ঘ। এ অংশে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি সত্ত্বেও অনেক প্রতিবন্ধকতা এখনো বিরাজমান।
এ বিষয়টির দুর্বলতা দুই ভাগে দেখানো হয়েছে-এক. সেবা সরবরাহ, দুই. সেবা গ্রহীতা তথা চাহিদার ক্ষেত্র। প্রথমোক্ত বিষয়ে সার্বিকভাবে তিনটি দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে-এক. দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুই. সম্পদের সীমাবদ্ধতা, তিন. সেবার দুর্বল গুণগত মান।
প্রারম্ভিক অংশে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের পরিমাণ মাথাপিছু পাঁচ ডলার মাত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু ব্যয় ৩৪ মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে সুপারিশকৃত পরিমাণ ২৪ মার্কিন ডলার। এ বিষয়ে উল্লেখ করতে হয়, মাথাপিছু ব্যয় সম্পর্কিত তথ্যটি নির্ভুল নয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মাথাপিছু ব্যয় ১৯৯৭ সালে ছিল ৯ মার্কিন ডলার। আর ২০০৭ সালে ছিল ১৬ মার্কিন ডলার। তবে সরকারি খাতের মাথাপিছু ব্যয় কত ছিল, এ তথ্য ওই সংস্থার প্রতিবেদনে ছিল না। বিষয়টি স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে।
ইতিমধ্যে বাজেট-সংক্রান্ত প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হবে মোট বাজেটের ৭ শতাংশ। বলা হয়েছে, এই বর্ধিত বরাদ্দের উদ্দেশ্য হলো প্রজনন হার এবং অপুষ্টির মাত্রা হ্রাসসহ মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা। বরাদ্দকৃত অর্থ মোট জিডিপির ১ শতাংশ হবে। একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এই হার ৪ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর সঙ্গে আরো দুটি প্রস্তাব একই বিশেষজ্ঞ দিয়েছেন-এক. সরকারি সেবার বিকেন্দ্রীকায়ন, দুই. বৃহৎ সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত বিষয়টি স্বাস্থ্যনীতিতে স্বীকৃত। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের রূপরেখা কী, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। এ কথা অবশ্যই বলা যায়, ভৌগোলিক বিস্তৃতির বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাত যথেষ্ট বিকেন্দ্রীভূত। তবে এ কথা সত্য, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা এখনো কেন্দ্রীভূত হয়নি। এ বিষয়টি সরকার বিবেচনা করলে ভালো হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা নগ্নভাবে দৃশ্যমান। কারণ, রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল।
এ বিষয়ে বলতে হয়, যথেষ্ট বরাদ্দ দিলেও যে অবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করা যাবে, এমন কোনো কথা নেই। প্রয়োজন সুশাসন। সার্বিকভাবে এর অভাব সব খাতেই রয়েছে। হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা অতি দুর্বল। সম্প্রতি একটি বড় হাসপাতালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ ও বিক্রির কথা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো চিকিৎসা-সংক্রান্ত সমিতির রাজনৈতিক দলভিত্তিক বিভক্তি, যার ফলে এ খাতের রাজনীতিকায়নের শিকড় অত্যন্ত গভীরে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে এ কারণে যথেষ্ট প্রশাসনিক জটিলতাও বৃদ্ধি পায়। সার্বিকভাবে প্রশাসনিক দুর্বলতা নির্মূল করতে না পারলে একমাত্র বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে পরিবার কল্যাণ খাতও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। প্রজনন হার হ্রাসের জন্য এই উপ-খাতেও বরাদ্দ যথেষ্ট হতে হবে। এই দুই ক্ষেত্র প্রশাসনিকভাবে একীভূত করার চেষ্টা অতীতে করা হলেও তা বিভিন্ন কারণে সফল হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। এ খাতের বরাদ্দ নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। একজন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ পরিবার কল্যাণের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। মূলকথা হলো, বাজেট প্রণয়নের সময় সব খাত থেকেই অধিকতর বরাদ্দের দাবি উত্থাপিত হয়। প্রতিবছরই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন মহল পেশ করে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারের পক্ষে সব দাবি মেটানো সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কৃষি খাতের কথা। এ ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানীদের দাবি হলো, কৃষি গবেষণার জন্য জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে, কৃষি সম্প্রসারণকর্মীরা দাবি করেন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডও জোরদার করতে হবে। অন্যথায় প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের জন্যও গবেষকরা দাবি উত্থাপন করেন। কারণ, দ্রুত নগরায়ণের মাত্রা ও পরিধি। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং নগরায়ণের মাত্রা অত্যন্ত অধিক। গবেষকদের ধারণা, ২০৪০ সালে নগরভিত্তিক জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ হবে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক (খসড়া) পরিকল্পনায় নগরভিত্তিক জনসংখ্যার চিত্র আরো ভয়াবহ। অতএব নগরের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশ্ন উঠতে পারে, নগরে কি স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই নেই? এ কথা সত্য নয়। ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যেসব সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে, তার অধিকাংশই গ্রামে। এর যথেষ্ট কারণও ছিল। মোট জনসংখ্যার আধিক্য গ্রামে। তবে এ দৃশ্য বদলাবে। এখন নয়, অদূর ভবিষ্যতে। নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়টি স্বাস্থ্যনীতিতে স্বীকৃত হলেও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত। বলা হয়েছে, শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপর্যাপ্ততার এবং বেসরকারি খাতের উচ্চ মূল্যের দরুন শহরের গরিব মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসী পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দ্রুত বর্ধনশীল স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণ করাটা সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্যনীতিতে এ বাক্যগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য-বিষয়ক অংশেও বলা হয়েছে-জনসাধারণ, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে এ অংশে বলা হয়েছে, মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যথাসম্ভব প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে নগরবাসীর জন্য কিছুই বলা হয়নি। অথচ নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বস্তিবাসীর জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্যনীতির কৌশল-সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, গ্রাম্য ও শহুরে এলাকার মানুষের কাছে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হবে। উদ্দেশ্য-মাতৃমৃত্যু ও প্রজনন হার হ্রাস করা।
সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, নগরের অধিবাসী, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উপেক্ষিত না হলেও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের নগরভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টার রূপরেখা। এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে ১৯৯৯ সালের এক সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে নগরের স্বাস্থ্যসেবা স্থানীয় সরকার বিভাগের ওপর বর্তায়। মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বয়ের রূপরেখার বিষয়ে স্বাস্থ্যনীতিতে কিছুই বলা হয়নি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments