অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নারী-গাড়ির ডাক্তার! by নাঈমা আমিন

লেখাপড়া করেছি বিজ্ঞান বিভাগে। ইচ্ছা ছিল কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে উদ্ভিদবিদ্যা বা প্রাণিবিদ্যায় পড়ার। কিন্তু এইচএসসিতে প্রত্যাশার চেয়ে খারাপ ফলের কারণে বড় ভাই কামরুজ্জামান খান ভর্তি করিয়ে দেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানকার ইনস্ট্রাক্টর আমাকে অটোমোবাইল প্রকৌশলী বিষয়ে পড়ালেখা করতে উৎসাহ জোগান।


যেহেতু এ পেশায় মেয়ের সংখ্যা কম। আমাদের সময় একজন নারী শিক্ষকসহ মোট দুজন মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন ক্লাসে। পরিবার, ইনস্ট্রাক্টর—সবার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও এ বিষয়ে পড়ার জন্য পুরুষ সহপাঠী, আত্মীয়স্বজন আমাকে বাঁকা চোখে দেখত। প্রায়ই সহপাঠী ছেলেদের কাছে নানা কথা শুনতে হতো।
তার পরও থেমে থাকিনি আমি। নানা রকম ভর্ৎসনা মুখ বুজে সহ্য করতাম আর মনে মনে দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হতাম—কবে সেদিন আসবে, যেদিন সবাই আমাকে এ পেশায় আসার জন্য অভিবাদন জানাবে।’ নিজের আজকের এই অবস্থানে আসার পথের নানা প্রতিবন্ধকতার কথা এভাবেই বলছিলেন ইয়ামাহা মোটরস কোম্পানির অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার (সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার) মনিকা সুলতানা খান।

কর্মজীবনে প্রবেশ: ২০০৬ সালে ডিপ্লোমা ইন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন মনিকা সুলতানা খান। এর আগে মনিকার বাবা মেয়ের চাকরির বিষয়ে তাঁর এক ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। বাবার বন্ধুই মনিকাকে বিএমডব্লিউর এক্সিকিউটিভ মোটরসে কাজ করতে পাঠান। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউ কেউ তাঁকে মেনে নিতে পারেননি। তবে সেখানেই হাতে-কলমে মেকানিকের কাজ শিখেছেন। তাঁর ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম (সেখানকার মেকানিক ছিলেন) তাঁকে সব সময় কাজ শেখা থেকে শুরু করে সুন্দরভাবে পরিচালনা ও পরিবেশন করা—এসব বিষয় শিখতে সহায়তা করেছেন। এরপর ২০০৮ সালে টিভিএস কোম্পানির অ্যাসেম্বলি সেকশনে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ৪০ জন মেকানিক ছিলেন, কী প্রোডাকশন হবে, কোন রঙের হবে, কতগুলো তৈরি করতে হবে মোটরসাইকেল—এসব বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন তিনি। সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর তিনি সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। কর্ণফুলী ওয়ার্কস লিমিটেডের ইয়ামাহা মোটরস কোম্পানির মনিটরিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেলে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন ২০১১ সালে। বর্তমানে এখানে কর্মরত তিনি। সারা দেশের ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা, মোটরসাইকেলের কোনো ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত তার সমাধান করা, ওয়ারেন্টি তদারক করা, এমনকি নিয়মিত মোটরসাইকেলের সব যন্ত্রাংশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরীক্ষা করেন তিনি।

সংসার সামলানো: তাঁর স্বামী কাজী জাকের হোসেন কাজ করেন সিরামিক কোম্পানিতে। দুই বছর বয়সী মেয়ে জাকিয়া সুলতানাকে বোনের বাসায় রেখে অফিসে যান। অনেক সময় কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়, কিন্তু দায়িত্বে অবহেলা করেন না। চাকরির পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়ে পড়ছেন ঢাকার সরকারি বাঙ্লা কলেজে।

ভবিষ্যতে যা হতে চান: ‘অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় একদিন সর্বোচ্চ পদে কাজ করতে চাই। তেমনটিই স্বপ্ন দেখি।’ বলেন মনিকা সুলতানা খান। যদিও হাসতে হাসতে জানালেন, ‘জানেন, মাঝে মাঝে ভাবি, যদি উড়োজাহাজের প্রকৌশলী হতে পারতাম!’

No comments

Powered by Blogger.