দুর্মূল্যের রাজনীতি, হরতাল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার by গাজীউল হাসান খান
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের লাগাতার আন্দোলন ও অপ্রতিরোধ্য চাপের মুখেই ক্ষমতাসীন বিএনপিকে সেদিন একটি 'অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল। এর দেড় দশক পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটকে আবার সে ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘোষণার বিরুদ্ধে হরতাল দিতে হয়েছে।
একদিন যে ব্যবস্থাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর 'ব্রেইনচাইল্ড' বলে গর্ব করেছিলেন, এখন বর্ষপরিক্রমায় তিনিই আবার সে ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি মনে করে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছেন। কিন্তু মাঝখানে দেখা দিয়েছে বর্তমান বিরোধী জোটের নির্বাচন-সংক্রান্ত আস্থার সংকট, যা থেকে একদিন সে পদ্ধতি চালু করার দাবি উঠেছিল। একদিন যা প্রতিষ্ঠার জন্য লাগাতার হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওসহ আন্দোলন করতে হয়েছে, সম্প্রতি আবার তাকে উচ্ছেদ করার জন্য উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। যে মহামান্য আদালত এখন অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন, তাঁরা সেদিন এর বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। সে যা-ই হোক, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা মহামান্য হাইকোর্টের নেই। আছে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের। মহামান্য হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অসাংবিধানিক বললেও আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য তা কাজে লাগানোর সুযোগ রেখেছেন। কিন্তু সংসদ নেত্রী তাও স্পষ্ট করে বলছেন না। সে কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলন ও হরতাল।
ক্ষমতায় গেলে কারোই আর সরকারবিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে লাগাতার হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াও পছন্দ হয় না। তখনই বিরোধী দল বা জোটের প্রতি বারবার সংসদে ফিরে গিয়ে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হয়। বিএনপি বর্তমান সংসদে একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দল। তারা জানে, তাদের একক শক্তিতে সংসদে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে না। বর্তমান সংসদে সংখ্যালঘু হলেও বাইরে জনসমর্থনের দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রক্ষার প্রশ্নে তাদের শক্তি কম নয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উচিত ছিল, বিবেচ্য বিষয়টি নিয়ে প্রথমে সংসদের বাইরে বিরোধী দলের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে একটি সমঝোতায় পেঁৗছানো। তা না করে একদিকে উসকানিমূলক কথাবার্তা, অন্যদিকে সংসদে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানানো তথ্যাভিজ্ঞ মহলের কাছে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ বলে মনে হয়নি। সে কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ডাকা।
এ কথা ঠিক যে হরতাল দিয়ে কোনো নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটও অতীতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। তাহলে কেন এই হরতাল? তাতে তো কোনো নির্দিষ্ট দল কিংবা তাদের নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি সাধিত হচ্ছে না। ক্ষতি হয় দেশ এবং এর জনগণের। একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং এর সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মন্দাক্রান্ত বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের ব্যক্তিগত বিভিন্ন খাত এখনো স্বপ্ন দেখে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু দেশে লাগাতার হরতাল ও বিশৃঙ্খলার মুখে তা কতটুকু সম্ভব? ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০০৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৪৭ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। তাতে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তখনকার হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে ১৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর তখন পর্যন্ত ৩৩ বছরে এ দেশে সর্বমোট হরতাল ডাকা হয়েছে এক হাজার ২৪২ দিন। সেই হিসাবে তখন পর্যন্ত ৩৩ বছরের মধ্যে এ দেশে প্রায় সাড়ে তিন বছর হরতাল পালিত হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করার দায়িত্ব তাঁদের ওপরই ছেড়ে দিলাম, যাঁরা হরতালকে তাঁদের আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
হরতাল নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি হাতিয়ার, বলা যায় শেষ বৈধ অস্ত্র। তবে গণতন্ত্র কোনো দেশেই জাতীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব নয়। এইচ এফ এমিয়েল আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র ছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, 'আমি গণতন্ত্রের অধিকার অস্বীকার করি না, কিন্তু যত দিন জাতীয় স্বার্থের জ্ঞান থাকবে দুর্লভ আর ক্ষমতার স্বার্থ থাকবে প্রবল, তত দিন পর্যন্ত ওই অধিকারগুলো কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, সে সম্পর্কে আমি খুব আশাবাদী নই।' গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হরতালকে সাধারণ মানুষের একটি অধিকার বলে গণ্য করা হলেও কোথায় কিভাবে তা প্রয়োগ করা উচিত, সেটা নিয়ে দীর্ঘদিনের একটি বিতর্কমূলক ইতিহাস রয়েছে। পরাধীন একটি জাতি কিংবা জনগোষ্ঠীর কাছে হরতালের কার্যকারিতা আর একটি স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল জাতির কাছে তার উপযোগিতা এক নয়। এ কথা ঠিক যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশগুলোর মধ্যে হরতালের কার্যকারিতা ক্রমেই কমে এসেছে। হরতাল আজকাল আর দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। হরতাল এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের নয়, বরং সীমিতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা টিকে আছে। তাই আজকের বিশ্বে হরতালসহ যেকোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের হাতিয়ারকে ততটুকুই প্রসারিত করা হয়েছে, যা থেকে অন্যের নাক থাকে নিরাপদ, বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ থাকে অক্ষত।
ওপরে উলি্লখিত বিভিন্ন অবস্থা বা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সামনে হরতালের বিকল্প আর কী উপায় আছে, যার মাধ্যমে তারা এ দেশে জনগণের বিভিন্ন অধিকারসহ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে? তাদের ধারণা, একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে তাদের নির্বাচনে পাস করতে দেওয়া হবে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মহামান্য হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছেন। সুতরাং বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অভিমত, এ ব্যাপারে সংসদে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তা পুনর্বহাল করার নিশ্চয়তা কোথায়? সরকারি দল মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের কপি হাতে পাওয়ার আগেই সেসব বিষয় সংবিধানের পুনর্মুদ্রিত কপিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দল সমর্থিত কোনো কোনো আইনজীবী। তাই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বক্তব্য নিয়ে বিএনপি সমর্থিত বিরোধী জোটের মধ্যে এক চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া তারা আরো অভিযোগ তুলেছে যে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করেছে। তাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং হুলিয়া জারি করা হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো বিরোধিতা নেই। তা ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অনেক দিন ধরে মিথ্যা কিংবা সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার জন্য একটি রাজনীতিবান্ধব পরিবেশ আবশ্যক, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা ধ্বংস করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে বলে তাঁরা বারবার অভিযোগ করেছেন।
সংবিধান পরিবর্তন এবং তা থেকে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বাদ দেওয়ার চক্রান্ত চলছে বলেও বিএনপি ও জামায়াত নেতারা অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সে দেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে অভিহিত করা অগণতান্ত্রিক নয়। বরং সেটিই হবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন। এটি কোনো সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ এবং এমনকি পাশ্চাত্য জগতের নেতৃস্থানীয় কয়েকটি দেশের সংবিধানেও এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তাতে তারা অগণতান্ত্রিক কিংবা সাম্প্রদায়িক বলে অভিযুক্ত হয়নি। সেসব কারণেই নাকি দেশব্যাপী তাদের সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেওয়া এবং সে লক্ষ্যেই নাকি বাধ্য হয়ে হরতালের পথ বেছে নেওয়া। এ অবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় সংকট নিরসনে সরকারের এগিয়ে যাওয়া একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে রাজনৈতিক তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন এবং তাদের সংসদে ফিরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব অনেকটাই ক্ষমতাসীন দলের ওপর বর্তায়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে নির্বাচনকালে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি কিন্তু আওয়ামী লীগই ১৯৯৪-৯৫ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় উত্থাপন করে আন্দোলন করেছিল, যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে পাস করে বিরোধী দলহীন সংসদে প্রণয়ন করে।
তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন সেসব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আপাতত বহাল রাখতে সাহায্য করছে না? মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে অতীতে শুধু আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং তাঁর সহকর্মীরাই নিগৃহীত হননি, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও অন্তরিন হয়েছিলেন। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁর অনেক সহকর্মী। তাঁদের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক আস্থার সংকট কেটে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ব্যাপারে ভবিষ্যতে একটি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যদের পক্ষে হয়তো কঠিন হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্দেশ্য হতে হবে সৎ ও মহৎ। সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ একটি বড় দল হিসেবে জাতীয় রাজনীতির আঙিনা থেকে জামায়াত ও বিএনপিকে চিরতরে উচ্ছেদ করবে কিংবা অন্য পক্ষ এ দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে_তেমন রাজনৈতিক মানসিকতা কিংবা মনোভাব সুস্থ, গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। এর বিরুদ্ধে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর অন্যথা হলে দেশ আবার 'ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বাবস্থায়' ফিরে যাবে বলে জনগণের বিভিন্ন অংশের আশঙ্কা। এ দেশের মাটি থেকে তাই দুর্মূল্যের রাজনীতি, গণবিরোধী হরতাল এবং অপশাসনের অবসান চায় মানুষ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও কায়েমি স্বার্থের রাজনীতি বাদ দিয়ে প্রকৃত মেধাভিত্তিক শাসন এবং উন্নয়ন, উৎপাদন, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থা, যা নির্ভেজাল গণতন্ত্রের চর্চা এবং পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া সম্ভব নয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে বিএনপি সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। তাদের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে অনেক দিনের। সে অবস্থায় বিএনপির উচিত সংসদে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের স্বার্থে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বাদ দিয়ে (তাদের দাবি অনুযায়ী) কিভাবে আগের 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি' টিকিয়ে রাখা যায়, সে জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করা। এ ব্যাপারে সংসদে একটি 'বেসরকারি বিল'ও উত্থাপন করতে পারে বিএনপি। তার মাধ্যমে সংসদ থেকে যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসিদ্ধভাবে সারা জাতির কাছে বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারবে বিএনপি। সংসদে আইনবিষয়ক স্থায়ী কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের পক্ষ থেকে আরো অনেকে ইতিমধ্যে বিএনপির প্রতি সংসদে ফিরে গিয়ে বিষয়টি উত্থাপন এবং তা নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের ফর্মুলা যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসিদ্ধ হলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের তাতে জনসমর্থন হারানোর কোনো ভয় নেই। বরং এটা না করে রাজপথে আন্দোলনের চূড়ান্ত পথ বেছে নিলে বিএনপি কিংবা বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কিংবা চক্রান্তের অভিযোগ উঠতে পারে। বিএনপি একটি জনভিত্তিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একে এখন ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্যদিকে দেশের স্বার্থ, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিবাদ,-বিসংবাদ ও সংঘর্ষ নয়, বরং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও স্থিতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ক্ষমতায় গেলে কারোই আর সরকারবিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে লাগাতার হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াও পছন্দ হয় না। তখনই বিরোধী দল বা জোটের প্রতি বারবার সংসদে ফিরে গিয়ে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হয়। বিএনপি বর্তমান সংসদে একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দল। তারা জানে, তাদের একক শক্তিতে সংসদে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে না। বর্তমান সংসদে সংখ্যালঘু হলেও বাইরে জনসমর্থনের দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রক্ষার প্রশ্নে তাদের শক্তি কম নয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উচিত ছিল, বিবেচ্য বিষয়টি নিয়ে প্রথমে সংসদের বাইরে বিরোধী দলের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে একটি সমঝোতায় পেঁৗছানো। তা না করে একদিকে উসকানিমূলক কথাবার্তা, অন্যদিকে সংসদে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানানো তথ্যাভিজ্ঞ মহলের কাছে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ বলে মনে হয়নি। সে কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ডাকা।
এ কথা ঠিক যে হরতাল দিয়ে কোনো নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটও অতীতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। তাহলে কেন এই হরতাল? তাতে তো কোনো নির্দিষ্ট দল কিংবা তাদের নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি সাধিত হচ্ছে না। ক্ষতি হয় দেশ এবং এর জনগণের। একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং এর সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মন্দাক্রান্ত বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশের ব্যক্তিগত বিভিন্ন খাত এখনো স্বপ্ন দেখে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু দেশে লাগাতার হরতাল ও বিশৃঙ্খলার মুখে তা কতটুকু সম্ভব? ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০০৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৪৭ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। তাতে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তখনকার হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে ১৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর তখন পর্যন্ত ৩৩ বছরে এ দেশে সর্বমোট হরতাল ডাকা হয়েছে এক হাজার ২৪২ দিন। সেই হিসাবে তখন পর্যন্ত ৩৩ বছরের মধ্যে এ দেশে প্রায় সাড়ে তিন বছর হরতাল পালিত হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করার দায়িত্ব তাঁদের ওপরই ছেড়ে দিলাম, যাঁরা হরতালকে তাঁদের আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
হরতাল নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি হাতিয়ার, বলা যায় শেষ বৈধ অস্ত্র। তবে গণতন্ত্র কোনো দেশেই জাতীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব নয়। এইচ এফ এমিয়েল আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র ছিলেন। তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন। তাঁর মতে, 'আমি গণতন্ত্রের অধিকার অস্বীকার করি না, কিন্তু যত দিন জাতীয় স্বার্থের জ্ঞান থাকবে দুর্লভ আর ক্ষমতার স্বার্থ থাকবে প্রবল, তত দিন পর্যন্ত ওই অধিকারগুলো কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, সে সম্পর্কে আমি খুব আশাবাদী নই।' গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হরতালকে সাধারণ মানুষের একটি অধিকার বলে গণ্য করা হলেও কোথায় কিভাবে তা প্রয়োগ করা উচিত, সেটা নিয়ে দীর্ঘদিনের একটি বিতর্কমূলক ইতিহাস রয়েছে। পরাধীন একটি জাতি কিংবা জনগোষ্ঠীর কাছে হরতালের কার্যকারিতা আর একটি স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল জাতির কাছে তার উপযোগিতা এক নয়। এ কথা ঠিক যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশগুলোর মধ্যে হরতালের কার্যকারিতা ক্রমেই কমে এসেছে। হরতাল আজকাল আর দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। হরতাল এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের নয়, বরং সীমিতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা টিকে আছে। তাই আজকের বিশ্বে হরতালসহ যেকোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের হাতিয়ারকে ততটুকুই প্রসারিত করা হয়েছে, যা থেকে অন্যের নাক থাকে নিরাপদ, বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ থাকে অক্ষত।
ওপরে উলি্লখিত বিভিন্ন অবস্থা বা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সামনে হরতালের বিকল্প আর কী উপায় আছে, যার মাধ্যমে তারা এ দেশে জনগণের বিভিন্ন অধিকারসহ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে? তাদের ধারণা, একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে তাদের নির্বাচনে পাস করতে দেওয়া হবে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মহামান্য হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছেন। সুতরাং বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অভিমত, এ ব্যাপারে সংসদে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তা পুনর্বহাল করার নিশ্চয়তা কোথায়? সরকারি দল মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের কপি হাতে পাওয়ার আগেই সেসব বিষয় সংবিধানের পুনর্মুদ্রিত কপিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দল সমর্থিত কোনো কোনো আইনজীবী। তাই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বক্তব্য নিয়ে বিএনপি সমর্থিত বিরোধী জোটের মধ্যে এক চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া তারা আরো অভিযোগ তুলেছে যে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করেছে। তাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং হুলিয়া জারি করা হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো বিরোধিতা নেই। তা ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অনেক দিন ধরে মিথ্যা কিংবা সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার জন্য একটি রাজনীতিবান্ধব পরিবেশ আবশ্যক, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা ধ্বংস করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে বলে তাঁরা বারবার অভিযোগ করেছেন।
সংবিধান পরিবর্তন এবং তা থেকে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বাদ দেওয়ার চক্রান্ত চলছে বলেও বিএনপি ও জামায়াত নেতারা অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সে দেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে অভিহিত করা অগণতান্ত্রিক নয়। বরং সেটিই হবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন। এটি কোনো সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ এবং এমনকি পাশ্চাত্য জগতের নেতৃস্থানীয় কয়েকটি দেশের সংবিধানেও এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তাতে তারা অগণতান্ত্রিক কিংবা সাম্প্রদায়িক বলে অভিযুক্ত হয়নি। সেসব কারণেই নাকি দেশব্যাপী তাদের সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেওয়া এবং সে লক্ষ্যেই নাকি বাধ্য হয়ে হরতালের পথ বেছে নেওয়া। এ অবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় সংকট নিরসনে সরকারের এগিয়ে যাওয়া একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে রাজনৈতিক তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। বিরোধী দলের ন্যায্য দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন এবং তাদের সংসদে ফিরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব অনেকটাই ক্ষমতাসীন দলের ওপর বর্তায়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে নির্বাচনকালে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি কিন্তু আওয়ামী লীগই ১৯৯৪-৯৫ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় উত্থাপন করে আন্দোলন করেছিল, যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে পাস করে বিরোধী দলহীন সংসদে প্রণয়ন করে।
তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন সেসব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আপাতত বহাল রাখতে সাহায্য করছে না? মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে অতীতে শুধু আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং তাঁর সহকর্মীরাই নিগৃহীত হননি, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও অন্তরিন হয়েছিলেন। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁর অনেক সহকর্মী। তাঁদের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক আস্থার সংকট কেটে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ব্যাপারে ভবিষ্যতে একটি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যদের পক্ষে হয়তো কঠিন হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্দেশ্য হতে হবে সৎ ও মহৎ। সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ একটি বড় দল হিসেবে জাতীয় রাজনীতির আঙিনা থেকে জামায়াত ও বিএনপিকে চিরতরে উচ্ছেদ করবে কিংবা অন্য পক্ষ এ দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে_তেমন রাজনৈতিক মানসিকতা কিংবা মনোভাব সুস্থ, গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। এর বিরুদ্ধে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর অন্যথা হলে দেশ আবার 'ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বাবস্থায়' ফিরে যাবে বলে জনগণের বিভিন্ন অংশের আশঙ্কা। এ দেশের মাটি থেকে তাই দুর্মূল্যের রাজনীতি, গণবিরোধী হরতাল এবং অপশাসনের অবসান চায় মানুষ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও কায়েমি স্বার্থের রাজনীতি বাদ দিয়ে প্রকৃত মেধাভিত্তিক শাসন এবং উন্নয়ন, উৎপাদন, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থা, যা নির্ভেজাল গণতন্ত্রের চর্চা এবং পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া সম্ভব নয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে বিএনপি সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। তাদের ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে অনেক দিনের। সে অবস্থায় বিএনপির উচিত সংসদে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের স্বার্থে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বাদ দিয়ে (তাদের দাবি অনুযায়ী) কিভাবে আগের 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি' টিকিয়ে রাখা যায়, সে জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করা। এ ব্যাপারে সংসদে একটি 'বেসরকারি বিল'ও উত্থাপন করতে পারে বিএনপি। তার মাধ্যমে সংসদ থেকে যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসিদ্ধভাবে সারা জাতির কাছে বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারবে বিএনপি। সংসদে আইনবিষয়ক স্থায়ী কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের পক্ষ থেকে আরো অনেকে ইতিমধ্যে বিএনপির প্রতি সংসদে ফিরে গিয়ে বিষয়টি উত্থাপন এবং তা নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের ফর্মুলা যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসিদ্ধ হলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের তাতে জনসমর্থন হারানোর কোনো ভয় নেই। বরং এটা না করে রাজপথে আন্দোলনের চূড়ান্ত পথ বেছে নিলে বিএনপি কিংবা বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কিংবা চক্রান্তের অভিযোগ উঠতে পারে। বিএনপি একটি জনভিত্তিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একে এখন ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট বিবেচনায় রাখতে হবে। অন্যদিকে দেশের স্বার্থ, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিবাদ,-বিসংবাদ ও সংঘর্ষ নয়, বরং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও স্থিতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
No comments