সময়ের প্রতিধ্বনি-পদ্মা সেতু : বিশ্বব্যাংকের কাছে এত ধরনা কেন? by মোস্তফা কামাল
বর্তমান সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার একটা বড় মাপকাঠি হবে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যর্থ হলে সরকার ভোটের রাজনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। আর ক্ষমতাসীন দলের এই ব্যর্থতা বিরোধীদের নির্বাচনী প্রচারণায় ইস্যু হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অন্যতম একটি এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেয় সরকার। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের মধ্যেই শেষ করার কথা ছিল।
কিন্তু নানা জটিলতায় আটকে যায় প্রকল্পটি। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প শুরু করাই কঠিন হবে।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক অনেকাংশেই দায়ী। বিশ্বব্যাংক পিছুটান দেওয়ায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীরা অগ্রসর হয়নি। সংগত কারণেই যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এও বলা হয়, আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করা না হলে তারা ওই প্রকল্পে অর্থ জোগান দেবে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক রিপোর্ট বের করা হয়। তুখোড় সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আশা করা হয়েছিল, এরপর নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে।
তা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আরো ছয় মাস সময় চাইছে। বিশ্বব্যাংকের এই ভূমিকা রহস্যজনক। তাহলে কি বিশ্বব্যাংক সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এ নাটক করল? এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, দুর্নীতির প্রমাণ করতে না পারলে বিশ্বব্যাংকের টাকা নেওয়া হবে না। তার পরও অর্থমন্ত্রী কেন বিশ্বব্যাংকের কাছে এত ধরনা দিচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া কি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়?
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেশি হবে। এর চেয়ে অনেক কম খরচে চীন পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিতে আগ্রহী। তা ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে রয়েছে। এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে সরকার আরো একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এসব উদ্যোগ বৃহত্তর স্বার্থেই ফলপ্রসূ হতে পারে। আবার আমাদের দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে সরকার। সরকার যদি ১০টি গ্রুপ কম্পানির চেয়ারম্যানকে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তারা বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগের জন্য পদ্মা নদীর ওপর প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার (ছয় হাজার ১৫০ মিটার) এবং প্রস্থ ২১.১০ মিটার। সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১.৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা-জাইকা ৪১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে, তা মাত্রাতিরিক্ত। চীনও একই মত প্রকাশ করে বলেছে, তারা অনেক কম খরচে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিতে সক্ষম। বিশ্বব্যাংকের অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তাদের বিশেষজ্ঞদের লালন-পালন করতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তির শর্তেও বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তা ছাড়া সরকারের ভেতরেও সিস্টেম লসের ব্যাপার রয়েছে।
সমালোচকরা অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ব্যয় তুলে নেয়। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশের কাছ থেকে অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি কেনাকাটা করে। তবে পদ্মা সেতুর বিষয়টিকে সরকার নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছে না। সরকার বিষয়টিকে আগামী নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়ার ইস্যু হিসেবেই দেখছে বলে সরকারপক্ষ দাবি করছে।
সরকার নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও বড় ধরনের গতি আসবে। উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসবে। সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও প্রকল্পটি ইতিবাচক হবে। এ কারণেই সরকারের উচিত বিলম্ব না করে অন্য বিকল্পগুলো নিয়ে চিন্তা করা। চীনের প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করছি।
অর্থনৈতিক শক্তিতে চীন এখন বিশ্বের মধ্যে এক নম্বরে। চীনের হাতে এ মুহূর্তে তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত আছে। এ অর্থ কেবল বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগতে পারে। তা ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের চেয়ে ভালো প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা এ মুহূর্তে অন্য কোনো দেশের নেই। এ কারণে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। কারণ ভারতের এখন অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার জরুরি হয়ে পড়েছে। সে জন্য যে অর্থ এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা দরকার, তা কেবল চীনই দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে চীন পাশে এসে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের কমপক্ষে ছয়টি বড় সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। মাত্র ১৮ মাসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। এখন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেখানে চীনের সহযোগিতার ঘোষণা বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তির জন্যই অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া চীন অনেক কম খরচে পদ্মা সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে চীন যে সেতুগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে তার কোনোটিরই দুর্নাম নেই।
চীনের সহযোগিতা নেওয়ার আরো একটি ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে চাই। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চীনের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ভারতও চীনের দিকে ঝুঁকছে। এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতির কারণেও চীনকে সঙ্গে রাখা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। দেশের জনগণও ভারতের পাশাপাশি চীনকে পাশে পেতে চায়। এটাকে কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
আর সরকার যদি কোনো দেশের সহযোগিতা নাও নেয়, তাহলেও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বেশ কিছু গ্রুপ কম্পানি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। এই কম্পানিগুলো পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পে সহায়তা করতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী দেশের খ্যাতনামা ১০টি গ্রুপ কম্পানির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। তাঁদের কাছে অর্থসহায়তা চাইতে পারেন। আমার ধারণা, তাঁরা সবাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা আশা করছি, সরকার দেশের স্বার্থে তো বটেই, নিজেদের স্বার্থেও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। আগামী মৌসুমেই যাতে কাজ শুরু করা যায়, সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়টি যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে না থাকে, সেদিকটির প্রতিও সরকারের নজর দিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক অনেকাংশেই দায়ী। বিশ্বব্যাংক পিছুটান দেওয়ায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীরা অগ্রসর হয়নি। সংগত কারণেই যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এও বলা হয়, আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করা না হলে তারা ওই প্রকল্পে অর্থ জোগান দেবে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক রিপোর্ট বের করা হয়। তুখোড় সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আশা করা হয়েছিল, এরপর নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে।
তা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আরো ছয় মাস সময় চাইছে। বিশ্বব্যাংকের এই ভূমিকা রহস্যজনক। তাহলে কি বিশ্বব্যাংক সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এ নাটক করল? এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, দুর্নীতির প্রমাণ করতে না পারলে বিশ্বব্যাংকের টাকা নেওয়া হবে না। তার পরও অর্থমন্ত্রী কেন বিশ্বব্যাংকের কাছে এত ধরনা দিচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া কি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়?
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেশি হবে। এর চেয়ে অনেক কম খরচে চীন পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিতে আগ্রহী। তা ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে রয়েছে। এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে সরকার আরো একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এসব উদ্যোগ বৃহত্তর স্বার্থেই ফলপ্রসূ হতে পারে। আবার আমাদের দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে সরকার। সরকার যদি ১০টি গ্রুপ কম্পানির চেয়ারম্যানকে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তারা বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগের জন্য পদ্মা নদীর ওপর প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার (ছয় হাজার ১৫০ মিটার) এবং প্রস্থ ২১.১০ মিটার। সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১.৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা-জাইকা ৪১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে, তা মাত্রাতিরিক্ত। চীনও একই মত প্রকাশ করে বলেছে, তারা অনেক কম খরচে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিতে সক্ষম। বিশ্বব্যাংকের অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তাদের বিশেষজ্ঞদের লালন-পালন করতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তির শর্তেও বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তা ছাড়া সরকারের ভেতরেও সিস্টেম লসের ব্যাপার রয়েছে।
সমালোচকরা অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ব্যয় তুলে নেয়। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশের কাছ থেকে অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি কেনাকাটা করে। তবে পদ্মা সেতুর বিষয়টিকে সরকার নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছে না। সরকার বিষয়টিকে আগামী নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়ার ইস্যু হিসেবেই দেখছে বলে সরকারপক্ষ দাবি করছে।
সরকার নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও বড় ধরনের গতি আসবে। উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসবে। সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও প্রকল্পটি ইতিবাচক হবে। এ কারণেই সরকারের উচিত বিলম্ব না করে অন্য বিকল্পগুলো নিয়ে চিন্তা করা। চীনের প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করছি।
অর্থনৈতিক শক্তিতে চীন এখন বিশ্বের মধ্যে এক নম্বরে। চীনের হাতে এ মুহূর্তে তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত আছে। এ অর্থ কেবল বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগতে পারে। তা ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের চেয়ে ভালো প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা এ মুহূর্তে অন্য কোনো দেশের নেই। এ কারণে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। কারণ ভারতের এখন অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন দরকার জরুরি হয়ে পড়েছে। সে জন্য যে অর্থ এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা দরকার, তা কেবল চীনই দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে চীন পাশে এসে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের কমপক্ষে ছয়টি বড় সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। মাত্র ১৮ মাসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। এখন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেখানে চীনের সহযোগিতার ঘোষণা বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তির জন্যই অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া চীন অনেক কম খরচে পদ্মা সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে চীন যে সেতুগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে তার কোনোটিরই দুর্নাম নেই।
চীনের সহযোগিতা নেওয়ার আরো একটি ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে চাই। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চীনের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ভারতও চীনের দিকে ঝুঁকছে। এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতির কারণেও চীনকে সঙ্গে রাখা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। দেশের জনগণও ভারতের পাশাপাশি চীনকে পাশে পেতে চায়। এটাকে কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
আর সরকার যদি কোনো দেশের সহযোগিতা নাও নেয়, তাহলেও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বেশ কিছু গ্রুপ কম্পানি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। এই কম্পানিগুলো পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পে সহায়তা করতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী দেশের খ্যাতনামা ১০টি গ্রুপ কম্পানির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। তাঁদের কাছে অর্থসহায়তা চাইতে পারেন। আমার ধারণা, তাঁরা সবাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা আশা করছি, সরকার দেশের স্বার্থে তো বটেই, নিজেদের স্বার্থেও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। আগামী মৌসুমেই যাতে কাজ শুরু করা যায়, সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়টি যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে না থাকে, সেদিকটির প্রতিও সরকারের নজর দিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments