সুফিয়া কামালের জন্মশতবর্ষ-তোমার জন্মদিনে, আমাদের চিরঞ্জীব প্রেরণা by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
আজ সুফিয়া কামালের জন্মশতবর্ষ। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করছি। জীবদ্দশায় তাঁর ছিয়াশিতম জন্মদিনে আমাদের অন্তরজাত একমাত্র প্রার্থনা জানিয়ে আমি লিখেছিলাম, মাতা, তুমি শতায়ু হও। অতি স্বাভাবিক যে সন্তান তা অমনি করেই চাইবে। তবে মাতা যখন সুফিয়া কামাল, বিশেষ তাৎপর্যের কথা অঙ্গাঙ্গি তখন আরো এসে পড়ে।
সেই পটভূমিতে বড় হয়ে আসে দেশকালের একান্ত চাওয়া। ঘরের, আঙিনার বেড়া ডিঙিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। প্রার্থনার ভাষায়, চাওয়ার ভাষায় আবেগ এসে যাচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছি। তবু অনুধাবন করতে বলি, যাঁরা তাঁকে সরাসরি জানেন দীর্ঘকালাবধি। তখন জেনে যাব আমরা, তাঁর ছিয়াশিতম জন্মদিনে কেন অমন করে বলা_ দেশকালের পটভূমিতে সুফিয়া কামাল।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে নিই। ১৯২৫ সালে গান্ধীজি এসেছিলেন বরিশালে, মুসলমান ঘরের 'হেরেমের বন্দিনী' (নজরুল বর্ণিত) চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোরী সুফিয়া আপন হাতে চরকায় কাটা সুতো প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে আজ। ইতিমধ্যে সত্তর বছরেরও অধিক গড়িয়ে গেছে।
সুফিয়া কামাল যেন 'পথিক হইয়াই জন্মিয়াছিলেন।' তাঁর চলার সড়কে ক্রমে তিনি বহুজনকে জড়ো করেছেন; কয়েক প্রজন্মের তাঁরা সেই সব বহুজন। যাত্রা শুরুটা অবশ্য একাই ছিল, বরিশালের শায়েস্তাবাদ থেকে। বড় সহজ ছিল না। ওই কালে, পরিবারের, সমাজের কঠোরতম বাঁধন তখন। তারপর কাল পাড়ি দিয়ে এসেছেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায়, পাকিস্তানে; শেষ পর্বে এখন ঠিকানা বাংলাদেশে। খেয়ালে রাখব, এই প্রকারের একটি বাক্য বর্ণনাতেই সারা হয়ে যায় না তাঁকে নিয়ে সব কথা। বিস্তারে জানব যে পটভূমিতে রয়েছে দেশ এবং ইতিহাসের আবর্তন, আর আমাদের জন্য সেই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল কর্মী-নেত্রীর চরিত্র, নাম পরিচিতিতে তিনি বেগম সুফিয়া কামাল। সেই জন্যই আসে দেশকালের পটভূমির কথা। মাতা-সন্তানের যে নিত্য-সম্পর্ক সদাই পাচ্ছি, দেখছি-শুনছি তাঁকে। সহজ-স্বাভাবিকতার হেতুতেই সম্ভবত তেমন করে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত নই আমরা। জন্মদিনের উপলক্ষ অবকাশটা এনে দিল। এখন তবে পুনরায় বলি, ঘরের আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা থাক, বহুজনের স্বার্থে দেশকালের পটভূমিতে মাতা সুফিয়া কামাল-কথা। মনে পড়ছে আমার, ছিয়ানব্বইতে যখন মাতার ছিয়াশিতম জন্মদিনের উদ্যাপন, তখন কী দেখছিলাম চারপাশে, ওই বছরেই তো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের-স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর বছর। এবং জানা যে বাঙালির ওই মহত্তম কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার থেকেই ধাত্রীর ভূমিকায় সুফিয়া কামাল। আমাদের দুর্ভাগ্য, দুর্বলতা এবং ক্ষমাহীন ব্যর্থতা_মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো আমরা ধরে রাখতে পারিনি। অনেক স্বপ্ন ছিল কোটি মানুষের চোখে-অন্তরে। চূর্ণ হয়ে গেছে সমুদয়। বটে রজতজয়ন্তীর বছর, তবে শঙ্কা যে তা কি পরিহাস-প্রহসন তুল্য! এ কোন বাংলাদেশ? বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধের লালনের মাতা ইমেজের প্রতিভূ সুফিয়া কামালের জন্মদিন উদ্যাপনকে সামনে রেখে আমাদের এই অকুণ্ঠ স্বীকারোক্তি। কেননা এ যে ভয়াবহ বাস্তব অভিজ্ঞতা। নিত্যদিন কেবলই প্রহৃত হচ্ছি, লুট হয়ে যাচ্ছে মাতা, তোমার সন্তানের বর্তমান-ভবিষ্যৎ। এমত দুঃসময়ে বড় প্রয়োজন নিশ্চিত ভরসার। বড় প্রয়োজন যেন তাবত দুর্গতিকে জয় করে নিতে পারি। মরিয়া-সন্ধান আমাদের_কোথায় প্রেরণা-শক্তির উৎস। কয়েক প্রজন্মের আমরা তো জানি সেইখানে জননী সুফিয়া কামাল।
স্পষ্ট করে আপন-জানা থেকে বলি, '৪৬-এ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের দিনগুলো থেকে আশিতে-নব্বইয়ে মৌলবাদ-স্বৈরাচার আগ্রাসনের কাল অবধি তাঁকে পেয়ে এসেছি। কিশোর-তরুণদের তিনি সংগঠিত করেছেন প্রতিরোধের কাতারে। দেখেছি বরাভয়-উত্তোলিত তাঁর দক্ষিণ হাত, নিঃশঙ্ক চোখের ভাষায় স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। মাথায় স্বল্পোচ্চ ক্ষীণকায়া ওই মহিলা, কণ্ঠস্বর ধীর মসৃণ মোলায়েম। না, কোনো প্রকারেরই ক্যারিসমায় অলংকৃত নন তিনি। তবে কত না বৈরী ভুবনেই তাঁর পদচারণা, নেতৃত্ব। তা নারীমুক্তির সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ অবধি প্রসারিত। এইখানে নিবেদন করি যে আমি কিন্তু সুফিয়া কামালের জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে বন্দনা-প্রশস্তি রচনায় উদ্যোগী হইনি। অবকাশ পাওয়া গেছে, অতএব মাতাকে অবলোকন করছি। যথার্থ যে বিশেষ নিকটজনের জন্মদিন পালনের কালে আবেগে পেয়ে বসে। সেইটে হৃদয়জাত। কেন সংবরণ করব সেই আবেগ? তবে তিনি যখন শতাব্দী-কন্যা এই আসনে অধিষ্ঠিতা, তখন ইতিহাসের মাত্রা যোজিত হয়ে যায় সেই সঙ্গে। আমরা যেন সচেতন চিত্তে এবং সমগ্রতায় তা অনুধাবন করি।
এ মোটে সংখ্যা গণনার হিসাবে চাওয়া নয় যে শতায়ুর সোপানে তিনি উত্তরিত হোন। তা ছাড়িয়ে অনেক কিছু। দশক থেকে দশকান্তরে পতন-বন্ধুর-অভ্যুদ্বয়ের ভেতর দিয়ে, নানান সংকট-সংঘাতকে প্রতিরোধ করে, প্রেরণাশক্তির উৎসার ঘটিয়ে, আলোক সূর্যের সন্ধান দিয়ে সুফিয়া কামাল যে ইতিমধ্যে কল্যাণ মূল্যবোধের প্রতীকে পরিণত, আজকের এই বিশেষ দিনে আমাদের বলার কথাটা তাই।
অবশ্যই উপলক্ষের একটা বাইরের দিক থেকে থাকে, তবে যেন বিস্মৃত না হই আসলে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। বারংবার তো বলছি যে এই উপলক্ষকে অবলম্বন করে মাতাকে আমরা যথার্থ করে জানার প্রয়াস পাব। ভালোবাসায়-শ্রদ্ধায় এবং আপন সত্তার অস্তিত্বের স্বার্থে। এই যে প্রার্থনা মাতা সুফিয়া কামাল শতায়ু হোন_তাতে করে আরো সময় পাই আমরা_উৎস থেকে সাহসের প্রাণনা আহরণ করব। আজ বড় প্রয়োজন সাহসের। বর্তমানকে মোকাবিলা করার জন্য, ভবিষ্যৎকে অর্জন করার জন্য। আর অতীত? আপন আইডেনটিটির স্বার্থেই তো শেকড়বন্ধন অতীতের সঙ্গে। শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে দেশবাংলা থেকে উঠে আসা, আজকের ছিয়াশি বছরের সুফিয়া কামাল সেই সেতুবন্ধ। অতএব পাঠ করি, অবলোকন করি তাঁকে, শ্রবণ করি তাঁর আপন কথা। আমরা ধারাবাহিকতার সন্ধান পেয়ে যাই।
এত বলার রয়েছে প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন সুফিয়া কামালকে নিয়ে। কত বিচিত্র অঙ্গনে এবং সর্বত্রই দুরূহ কর্ম সাধনায়। তাবৎ বৈরী পরিবেশে তাঁর পথিকৃতের ভূমিকা। তবে বিশেষ এই তথ্যটি যে সাধারণ্যে 'কবি' অভিধাটি যেন তাঁর পরিচিতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে। সবাই তো জানি, কবি বেগম সুফিয়া কামাল (প্রথম জীবনে সুফিয়া এন হোসেন)। অসূর্যম্পশ্যা 'হেরেমবাসিনী' এক বালিকা আলোকস্নাত বহির্ভুবনের প্রথম সংস্পর্শে আসেন লেখালেখিকে অবলম্বন করে। তখন বয়স বারো। কবি কামিনী রায় বরিশালে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন, সে ১৯২৩ সালের কথা। লেখিকা ওই বালিকাকে তিনি উৎসাহিত করে এসেছিলেন। পরের জীবনে যখন কলকাতায় তখন তিনি রবীন্দ্র-নজরুলের স্নেহাশীর্বাদধন্যা। কেবলই কী কবিতা? শুরুটা কিন্তু ছোটগল্প দিয়ে। বস্তুত তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থই গল্প সংকলন 'কেয়ার কাঁটা' বেরিয়েছিল ১৯৩৭-এ। পরের বছর কবিতাসংকলন 'সাঁঝের মায়া'। অদ্যাবধি বিরামহীনভাবে তাঁর লেখার কর্ম_সাহিত্য সৃজনের নানা অঙ্গনে। উপমিত করি এমন আর কাকে, কত জনাকে পাই? আরো বড় কথা যে ওই বলয়েই সুফিয়া কামালের কৃতির শেষ নয়। সেসব আমাদের অনেকেরই প্রত্যক্ষ জানা। ইতিপূর্বে খানিক উলি্লখিত হয়েছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় কোথায় এত প্রাণের শক্তি, বিশ্বাসের শক্তি যে নিতান্তই গৃহবধূ তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবখানে_সেইখানে 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!'
আসলে যা চাইছি_তাঁর জন্মদিনটিকে অবলম্বন করে, মাতাকে যতটা পারি চিনে নেওয়া, আপন করে নেওয়া। সুদীর্ঘকালজুড়ে তাঁর কর্মসাধনার কর্ম-কৃতির বর্ণনা করি, কিংবা পরিমাপ করি, সে সাধ্য নেই। বস্তির আঙিনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সীমান্ত অবধি সম্প্রসারিত ব্যাপক তাঁর সেই সব কর্মকাণ্ড। এখন সন্তান আমরা তাঁকে জানব, বংশধর প্রজন্মকে জানিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাব। এইটে উত্তরাধিকারের দায়।
এখন জিজ্ঞাসা যদি সহজ হিসেবে এবং এক কথায় ওই মহৎ প্রতীকটির অবয়ব, ইমেজ কেমনতর? ত্বরিত আমরা জবাব জেনে যাব : ক. নারী স্বাধীনতা, খ. বিবেকের আপসহীনতা আর গ. বাঙালিত্ব_এই তিনের সহজবোধ্য একটি সরল সমন্বয়-যোগ। আমাদের চোখে-চিত্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন তিনি। সবটা মিলিয়ে তখন বেগম সুফিয়া কামাল। না, নিশ্চয়ই নন তিনি অলোক ভুবনের অধিবাসিনী, অবশ্য তিনি দেহধারিণী এক মানবী এবং সেই দেহে অনিবার্যভাবেই শারীর-নিয়ম শাসিত। বিস্ময়ের কী যে আজ ছিয়াশি বছরের বয়সে নানা রোগ-প্রতিবন্ধকতায় তিনি কাবু। তবে এইখানে ভালো লাগছে জানাতে যে আমরা যারা দীর্ঘকাল বন্ধুর সড়কে তাঁর পাশে-পেছনে হেঁটে এসেছি, স্পষ্ট করে দেখছি তাঁকে_চলি্লশের দশকের কলকাতায়, পরের কালে পঞ্চাশের-ষাটের দশকে ঢাকায় নানা কর্মকাণ্ডে তিনি অতি ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে, সামরিক একনায়কত্ববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে এবং অবশ্য প্রথমাবধিই নারীমুক্তির অভিযানে_দৃঢ় মেরুদণ্ডের ওই দুঃসাহসী মহিলা সংগঠন নির্মাণ করছেন, প্রেরণা জোগাচ্ছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখন বয়স তাঁকে গ্রাস করেছে, তবে সন্তানের অহংকার যে শতাব্দীর এই শেষ প্রহরের কালেও জননীর যে সদা অংশগ্রহণ, নিরন্তর প্রাণনার সঞ্চার স্বৈরশাসন প্রতিহতকরণের অভ্যুত্থানে, মৌলবাদী ফতোয়াবাজের বিরোধিতায় এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মহৎ কর্মযজ্ঞে। সহজ ধারণায় কুলোয় না, অমন মৃদুকণ্ঠ নম্রভাষিণী সর্বংসহা বাংলার বধূপ্রতিম নারী প্রয়োজনের ক্ষণে কেমন করে কলুষ পাপ-অন্যায়ের প্রতিরোধে মশাল-প্রতীকে পরিণত হন। ইতিহাস শিখিয়েছে, তৎসহ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাতেও শিখেছি কী জরুরি আবশ্যিকতা প্রেরণা-উৎসাহী মহৎ প্রতীকের। প্রসঙ্গত কিছু অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ, যেমন কি না 'সোনার বাংলা'র রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী তারুণ্যের নজরুল, 'বাঙালিত্বের মুক্তিযুদ্ধে'র শেখ মুজিব, তেমনি আমাদের শতাব্দীর ইতিহাসে আরেকজন বেগম সুফিয়া কামাল।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments