তিনি এক এবং অখণ্ড by করুণাময় গোস্বামী

আজ সুফিয়া কামালের জন্মশতবর্ষ। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেই শুরু করছি তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু রচনায় মহাজীবন ও মহামরণ কথা দুটি ব্যবহার করেছেন। কথা দুটিকে নানা ব্যঞ্জনায় তিনি নানা স্থানে ব্যবহার করেছেন। যেমন_শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালায় বা তদ্জাতীয় প্রবন্ধে ও ভাষণে কথা দুটির যেমন ব্যঞ্জনা,


অন্যত্র, বিশেষ করে বয়স বাড়ার সঙ্গে জগৎ-জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণার যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং পারিবারিক ব্রাহ্মপ্রাপ্ত ধর্মের আবহ থেকে, চেতনাগত দিক থেকে যতই তিনি বেরিয়ে আসতে থাকেন এবং যতই তিনি নিজেকে মন্দিরের বাইরের মানুষ হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করেন, ততই এসব শব্দের মর্মার্থ তাঁর কাছে বদলাতে থাকে। আলোকবাচক শব্দ আশ্চর্যভাবে তাঁর কাছে লৌকিক হয়ে উঠতে থাকে এবং আকাশচারী পাখি কেবলই মাটির দিকে আসতে থাকে। মহাজীবনের প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা হয়, যে জীবন ব্যক্তিজীবনকে অতিক্রম করে যায়, মহামরণের অর্থ হয় যে মৃত্যু গার্হস্থ্য অর্থে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু নয়, যার প্রয়াণের সঙ্গে তাঁর গৃহের বেদনামাত্র সংযুক্ত নয়।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, সুফিয়া কামাল যে জীবন যাপন করে গেলেন তা মহাজীবন এবং যে মৃত্যুতে তাঁর জীবনের বিস্ময়কর দীপটি নিভে গেল তা মহামরণ। এর সংজ্ঞার্থটিও আসলে রবীন্দ্রনাথ থেকেই, যে জীবন ব্যক্তিজীবনকে অতিক্রম করে যায়। সুফিয়া কামাল নানা সংগ্রাম, নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যে জীবন যাপন করে গেলেন তা একান্তই কোনো ব্যক্তির জীবন নয়, তাঁর দেশের, তাঁর স্বল্পকালীন পৃথিবীর সব নিগৃহীত মানুষের জীবনের স্পন্দনকে তিনি ধারণ করলেন তাঁর জীবনে। ব্যক্তি অব্যক্তি হয়ে উঠলেন, বস্তু ভাব হয়ে উঠল। যে মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেল, তাঁর বেদনা কোনো গার্হস্থ্য সীমাবদ্ধ শোক নয়, এ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত এক পুণ্য অশ্রুপাত। এসবই লৌকিক, কিন্তু কোনো ক্ষুদ্রলোকে তা সীমাবদ্ধ নয়, লোকই এখানে এসে আলোক হয়ে উঠল, এভাবেই লোক আলোক হয়ে হয়ে ওঠে, সীমার ভেতর দিয়ে সীমাহীনদের তাৎপর্য ফুটে বেরোয়, আকাশ আর মাটি কোলাকুলি করে জীবনের রূপান্তর হয়, মহাজীবনে মরণের রূপান্তর হয় মহামরণে। এ আমাদের সৌভাগ্য, সৌভাগ্যই বলব আমি, যে দীর্ঘকাল ধরে আমাদের চোখের সামনে একটি মহাজীবন যাপিত হতে দেখলাম, এ-ও আমাদের শোকাপ্লুত সৌভাগ্য যে একটি মহামরণকে আমরা অনুভব করলাম।
কবি হিসেবে সুফিয়া কামালের সুকৃতি বৃহৎ, কর্মী হিসেবে তাঁর সুকৃতি বৃহত্তর। সে আলোচনা এখন আর নয়। সে পরে হবে, দীর্ঘকাল ধরে যা চলতে থাকবে এবং সে হয়ে উঠবে এক বিস্ময়কর কাহিনী, কিভাবে কোন শক্তিতে ও সামর্থ্যে তিনি_কবির আবেগ ও কল্পনা এবং কর্মীর সংগ্রামকে প্রাণের পাত্রে ধারণ করে নীরবে ধারাবাহিকভাবে এমন এক স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, যা আমাদের চোখের সামনে অথচ আমাদের ধরাছোঁয়ার ঊধর্ে্ব।
যে কথাটি এই অভিভূত মুহূর্তে আমাদের সবার মনে হবে, সুফিয়া কামাল ছিলেন সংস্কৃতি ও প্রগতি চিন্তার একটি জীবন্ত স্বরূপ। মনের বৈভব দেহের সুষমাকে কী আশ্চর্য প্রভা এনে দেয়, তা তাঁর সানি্নধ্য যে কাউকে বুঝিয়ে দিত। যথার্থ সংস্কৃতিবোধ্য যে মানুষকে কতটা নম্র করে তোলে তিনি ছিলেন তার প্রতিমূর্তি। নম্রতারও যে কতটা শক্তি গেঁথে থাকে তাও আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পেলাম। সংগ্রামের শক্তি যদি উচ্ছ্বসিত হয় সংস্কৃতি থেকে, মানুষের কল্যাণ যদি দুর্গম পথযাত্রার পাথেয় হয়, তাতে সব কিছুকেই যে হাসিমুখে গ্রহণ করা চলে তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেলেন একেবারে আমাদের চোখের সামনে।
সুফিয়া কামালের ব্যক্তিত্বে কোনো বিভাজন নেই। সবে মিলে তিনি এক এবং অখণ্ড। তাঁর কবিতা যেমন মৃদু শব্দাবলি দিয়ে রচিত, মাধুর্যময় ছন্দের গ্রথিত, ভাষার উত্থান-পতনের স্থানগুলোর গানের মিড় দিয়ে মোড়ানো কঠোর ভাবনাকেও যেমন তিনি প্রকাশ করেন মাধুর্যান্বেষী শব্দমালা দিয়ে, তার সংগ্রামেও একটি সুষমাবোধ কাজ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় উচ্চারণ রচিত উচ্চকিত নয় কদাচ। আমার কাছে এ বিষয়টি অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হয়। সংগ্রামীবোধ কতটা ব্যাপক হলে, দুঃখজয়ী চিত্তবৃত্তি কতটা গভীর হলে, মানুষের জন্য ভালোবাসা কতটা প্রগাঢ় হলে এবং সর্বোপরি যে কথাটি আসে, সংগ্রামে ও সৌন্দর্য কী আশ্চর্য রসায়নক্রিয়া ঘটলে এ ঘটনা ঘটে, তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। কোনো জীবনীকারও বিষয়টি তুলে ধরতে পারবেন না। কেননা কোনো বর্ণনায় এই অধৃততব্য বিষয়টি ধরা যাবে না। সুফিয়া কামাল সম্পর্কে এই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার অংশভাগী তাঁরাই হবেন, যাঁরা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর কবিতার ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা হবে, তাঁর সংগ্রামের সাফল্য-বৈফল্য নিয়ে কথাবার্তা হতেই পারে। হবে নিশ্চয়ই কিন্তু মানুষটি তিনি কেমন ছিলেন সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের রসায়নে মতের বাগানে যে অমর্ত্য ফুল ফোটে সে বিষয়টি ভবিষ্যতের কেউ জানবে না। ভাগ্যবান আমরা যে এই প্রস্ফুটিত পুষ্পটি আমরা দেখতে পেয়েছি।
সাধারণভাবে সুফিয়া কামালকে নারীপ্রগতির আন্দোলন নেত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেন তাঁর এক ভাষণে একবার বলেছিলেন, নারীপ্রগতি বলিয়া কোনো পৃথক প্রগতি নেই। ইহা সামগ্রিক অর্থে মানব প্রগতির অংশ, আমারও ধারণা যে নারীপ্রগতি বলে কোনো প্রগতি নেই। তবে কেশব সেন যে বললেন, ইহা মানবপ্রগতির অংশবিশেষ, আমার বিশ্বাস যে এটা মানবপ্রগতির অংশ নয়, সবটা মিলেই মানবপ্রগতি। প্রগতি অর্থ সমগ্র মানবসমাজের সামনে চলা। মেয়েদের নিষেধেরই মাত্রাটা বেশি ছিল এবং এখনো আছে বলে সেটা প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং তার জন্য মেয়েদের কতিপয় অধিকারের জন্য পৃথক দাবি...তাই বলে সেটাকে খণ্ড দেখা যথার্থ নয়। মূল ব্যাপারটা মানুষের প্রগতি, মানবসমাজের চিত্তবিনোদন, যাবতীয় কায়েমী অন্তরায় অতিক্রম করে মানুষকে সামনে নিয়ে আসা। একবার নিয়ে আসতে পারলে তখন আর সমাজকে খণ্ড খণ্ড করে দেখার প্রয়োজন নেই। সুফিয়া কামাল গোটা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামেই নেতৃত্ব দিয়েছেন আজীবন। সে জন্য তিনি যেমন নারী সংস্থায় আছেন, ছায়ানটেও আছেন, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদেও আছেন। যাবতীয় ইতিবাচক উদ্যোগের কাণ্ডারি তিনি।
যে কথাটি আমি আবার উল্লেখ করব, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের তিনি এক অখণ্ড বিনম্র প্রতিমা। ঊনবিংশ শতকের সারগর্ভ বাংলার বাগানে বিংশ শতাব্দীতে ফোটা তিনি এক লাবণ্যময় ফুল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.