কল্পকথার গল্প-ছোট হয়ে আসছে মানুষের পৃথিবী! by আলী হাবিব
ইচ্ছে করলেই তো আর ছোট হওয়া যায় না। ইচ্ছে করে কেউ ছোটবেলা ফিরে পেতে চাইলে তার বিড়ম্বনা অনেক। 'বম মাহাদেব ধুস্তরীস্বামী,/দস্তুর মতো প্রস্তুম আমি' বলে বয়স কমিয়ে ছোট হওয়া যায়। কিন্তু সে হ্যাপা সামলাতে গিয়ে নতুন করে বিপদে পড়তে হয়। তখন আবার 'বম মহাদেব, সকল বস্তু/আগের মতন আবার অস্তু' বলে ফিরতে হয় নিজের বয়সে।
কিন্তু এ ছোট হওয়া সে ছোট হওয়া নয়। এ ছোট হওয়া অন্য ছোট হওয়া। আকারে ও আকৃতিতে ছোট হয়ে যাওয়া।
গ্রিক পুরাণের এক গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। গল্পের নায়ক টিথোনাস। হোমারের ইলিয়াডে পাওয়া যায় গল্পটি। ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনও টিথোনাসকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। অমরত্বপিয়াসী ছিল টিথোনাস নামের এক রূপবান যুবক। দেবী অরোরা প্রেমে পড়েন এই যুবকের। তাকে নিয়ে যান তাঁর আবাসে। দেবরাজ জিউসকে অরোরা অনুরোধ করেন টিথোনাসকে অমরত্ব দিতে। অমরত্ব পায় টিথোনাস। কিন্তু কালক্রমে তার যৌবন চলে যায়। আসে জরা। ধীরে ধীরে অথর্ব, চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে টিথোনাস। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার জীবন। প্রাণপনে সে কামনা করে মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু আসে না। জরাগ্রস্ত টিথোনাস কেবলই মৃত্যু কামনা করে। দেবীর কাছে করুণ স্বরে বর ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করে টিথোনাস। কিন্তু একবার কোনো বর দিলে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। ফিরিয়ে নিতে পারেন না দেবতারা। জরাগ্রস্ত টিথোনাসের শেষ জীবনের পরিণতি আরো করুণ। টিথোনাসের শরীর একসময় ছোট হতে থাকে। দেবী অরোরা একসময় তাকে শীর্ণকায় এক ঘাসফড়িংয়ে রূপান্তর করে দেন।
টিথোনাসের সেই গল্পই কি আবার ফিরে আসছে? পত্রিকায় সে রকম খবরই তো প্রকাশ হয়েছে। কি সাংঘাতিক খবর! মানুষ নাকি দিন দিন ছোট হয়ে আসছে! ভাবা যায়! মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।
পৃথিবী যে আজকের দিনে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা তো মানুষেরই কল্যাণে। মানুষই আজকের পৃথিবী তৈরি করেছে। দিনে দিনে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছে এই মানুষ। এই মানুষই তো জয় করেছে এভারেস্ট শৃঙ্গ। পাড়ি দিয়েছে অজেয় মরুভূমি। আবিষ্কার, সমুদ্রশাসন করে তার ওপর দিয়ে নৌযান চালিয়েছে মানুষ। নতুন দেশ, মহাদেশ আবিষ্কার করেছে মানুষ। সেই মানুষ ছোট হয় কেমন করে? মানুষ কেন ছোট হবে? ছোট হলেও সেই বামন অবতারের গল্পের মতো ছোট হলে আপত্তি থাকত না।
একসময় মানুষের আকৃতি নাকি বিশাল ছিল। পুরাণে মানুষের যেসব গল্প আছে, সেসব গল্প পড়লেই তো মানুষের আকৃতি ও তাদের বিশালত্ব সম্পর্কে জানা যায়। ধরা যাক হারকিউলিসের কথা। হারকিউলিসের যে ছবি আমরা দেখি সেটা তো আছেই। পাশাপাশি তাকে নিয়ে আছে অনেক গল্প। হারকিউলিসের সিংহ শিকারের গল্পটিই আগে বলে নেওয়া যাক। এক ছিল সিংহ। সে নগরীর নারীদের ধরে নিয়ে যেত। এরপর কোনো বীর সেই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে সিংহটি তাকে মেরে ফেলত। সিংহের গুহার কাছে গেলে প্রথমে একটি নারীকে দেখা যেত। তার কাছে যেতেই সে সিংহের রূপ নিত। আক্রমণ করত। হারকিউলিস গেল সেই সিংহের গুহায়। সিংহকে হত্যা করে তার মরদেহ ঘাড়ে করে ফিরে এল। হারকিউলিসকে এর পর পাঠানো হয়েছিল এক হাইড্রা নিধনে। সেই হাইড্রার দশ মুখ থেকে বের হতো আগুন, বিষাক্ত নিঃশ্বাস। লার্না লেকের ধারে হারকিউলিস সেই হাইড্রা নিধনে যাওয়ার আগে এক টুকরো কাপড়ে ঢেকে নিল নিজের নাক-মুখ, যাতে হাইড্রার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে তার কোনো ক্ষতি না হয়। সেই হাইড্রা নিধন করে ফিরে আসে হারকিউলিস। পর পর দুই অভিযানে সাফল্য আসে হারকিউলিসের। কিন্তু মানুষের এই অর্জনে দেবতারা খুশি হতে পারেননি। এবার হারকিউলিসকে পাঠানো হয় একের পর এক নানা কাজে। সব কাজেই সাফল্য পেয়ে যায় হারকিউলিস। হারকিউলিসের এই সাফল্য হচ্ছে মানুষের সাফল্য। হারকিউলিসের অভিযানগুলো তার বিশালত্বই তুলে ধরে আমাদের কাছে।
এই মানুষ নাকি ছোট হয়ে যাচ্ছে, ছোট হয়ে যাচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক। আবার মানুষের এই ছোট হয়ে যাওয়ার কাহিনীও মানুষেরই আবিষ্কার। গবেষকরা নানা গবেষণা করে দেখিয়েছন, আগের দিনের মানুষের তুলনায় আজকের দিনের মানুষ ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা ছবি বেরিয়েছে। সেটা হচ্ছে এ আমলের বামন মানুষের ছবি। এ সময়ের সবেচেয়ে খাটো মানুষটি দীর্ঘতম মানুষের জুতো নিয়ে দাঁড়িয়ে। জুতোর আকৃতি বামন মানুষের কাঁধের সমান। আজকের দিনের মানুষের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আগের দিনের মানুষ ছিল অনেক লম্বা ও হৃষ্টপুষ্ট। অনেক লম্বা হৃষ্টপুষ্ট মানুষের গল্প তো আমরা সেই লিলিপুটের গল্পেই পাই। জোনাথন সুইফটের গ্যালিভারের সফরনামাতে আছে লিলিপুটদের কাহিনী।
গ্যালিভার পেঁৗছে গিয়েছিলেন লিলিপুটদের দেশে। সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েছিল তাঁর জাহাজ। গ্যালিভার নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক দ্বীপে বন্দি অবস্থায়। সেখানকার সব মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতির। আঙুলের সমান। তারাই গ্যালিভারকে বেঁধে রেখেছিল। গ্যালিভারের সফরনামার লিলিপুটদের গল্প রূপকথার দেড় আঙুলে কৃষকপুত্রের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। আর পুরাণেও তো বামনের কথা আছে।
আবার ছোটর বড় অর্জনের কথাও তো পাওয়া যায় পুরাণে। বামনের গল্পটা বলে নেওয়া যাক। ভারতীয় পুরাণের বামন বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার। কশ্যপ মুনির ঔরসে অদিতির গর্ভে বামনের জন্ম। একবার বলি এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন, এই যজ্ঞে তাঁর কাছে যে যা প্রার্থনা করবে, তিনি তাই পূরণ করবেন। সেই যজ্ঞে গিয়ে হাজির হলেন বামন। বলির কাছে তিনি ত্রিপাদ মাত্র জমি চাইলেন। যজ্ঞকার বলি ভাবলেন, এই ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণের ত্রিপাদ জমি আর কতটুকু। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। শুক্রাচার্য বলিকে এই দান করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু বলি যেহেতু অঙ্গীকার করেছেন, তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। বলি তাঁর এক পা দিয়ে চারদিক আয়ত্ত করলেন। দ্বিতীয় পা বিস্তার করলেন তিনি। স্বর্গ আয়ত্তে এসে গেল। তৃতীয় পা দেওয়ার জন্য আর কোনো ভূমি থাকল না। বলি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।
মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে গেলেও মানুষের কীর্তি তো আর ছোট হতে পারে না। মানুষের কীর্তি তাকে অনেক বড় করে রাখে। হয়তো এটাইর্ িঠক যে মানুষ আগের দিনের তুলনায় আজকের দিনে অনেকটাই খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে। সেটা কি সর্বক্ষেত্রেই? হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ক্ষুদ্রতার পরিচয় দিচ্ছি। ক্ষুদ্রতার পরিচয় দিচ্ছি আমাদের আচার ও আচরণে। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতীয় সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ক্যাডেটদের পাসআউট প্যারেডে সালাম গ্রহণের জন্য। এটা সামরিক বাহিনীর একটা রীতি। আমাদের সাবেক এক সেনাপ্রধানও গিয়েছিলেন ভারতের দেরাদুনে এমন এক পাসআউট প্যারেডে সালাম নিতে। স্বাভাবিক নিয়ম, রীতি ও নীতি মেনেই আসছেন ভারতের সেনাপ্রধান। তিনি শুধু ভারতের মেনাপ্রধান_এটাই আমাদের কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় নয়। সম্ভবত তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শেষ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। তাঁকে সম্মানিত করতে পারা তো আমাদেরই সম্মান।
কিন্তু এটা নিয়েও রাজনীতি হয়ে গেল। জনৈক নেতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেঠো বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি তাঁর মেঠো বক্তৃতায় বলেছেন ভারতের সেনাপ্রধানকে স্যালুট না করতে। তিনি যখন এই আহ্বান জানাচ্ছেন, তখনই কিন্তু তাঁর দলের মহাসচিব জানিয়ে দিচ্ছেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। ক্ষুদ্রতা এখানেই। এখানেই আমরা ছোট হয়ে যাচ্ছি। আকারে ছোট হয়ে গেলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু কীর্তিতে একবার খর্বাকৃতির হয়ে গেলে সে বড় লজ্জার কথা। আমাদের পৃথিবী কি এভাবেই ছোট হয়ে আসছে? আমরা কি ক্ষুদ্রতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
গ্রিক পুরাণের এক গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। গল্পের নায়ক টিথোনাস। হোমারের ইলিয়াডে পাওয়া যায় গল্পটি। ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনও টিথোনাসকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। অমরত্বপিয়াসী ছিল টিথোনাস নামের এক রূপবান যুবক। দেবী অরোরা প্রেমে পড়েন এই যুবকের। তাকে নিয়ে যান তাঁর আবাসে। দেবরাজ জিউসকে অরোরা অনুরোধ করেন টিথোনাসকে অমরত্ব দিতে। অমরত্ব পায় টিথোনাস। কিন্তু কালক্রমে তার যৌবন চলে যায়। আসে জরা। ধীরে ধীরে অথর্ব, চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে টিথোনাস। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার জীবন। প্রাণপনে সে কামনা করে মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু আসে না। জরাগ্রস্ত টিথোনাস কেবলই মৃত্যু কামনা করে। দেবীর কাছে করুণ স্বরে বর ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করে টিথোনাস। কিন্তু একবার কোনো বর দিলে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। ফিরিয়ে নিতে পারেন না দেবতারা। জরাগ্রস্ত টিথোনাসের শেষ জীবনের পরিণতি আরো করুণ। টিথোনাসের শরীর একসময় ছোট হতে থাকে। দেবী অরোরা একসময় তাকে শীর্ণকায় এক ঘাসফড়িংয়ে রূপান্তর করে দেন।
টিথোনাসের সেই গল্পই কি আবার ফিরে আসছে? পত্রিকায় সে রকম খবরই তো প্রকাশ হয়েছে। কি সাংঘাতিক খবর! মানুষ নাকি দিন দিন ছোট হয়ে আসছে! ভাবা যায়! মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।
পৃথিবী যে আজকের দিনে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা তো মানুষেরই কল্যাণে। মানুষই আজকের পৃথিবী তৈরি করেছে। দিনে দিনে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছে এই মানুষ। এই মানুষই তো জয় করেছে এভারেস্ট শৃঙ্গ। পাড়ি দিয়েছে অজেয় মরুভূমি। আবিষ্কার, সমুদ্রশাসন করে তার ওপর দিয়ে নৌযান চালিয়েছে মানুষ। নতুন দেশ, মহাদেশ আবিষ্কার করেছে মানুষ। সেই মানুষ ছোট হয় কেমন করে? মানুষ কেন ছোট হবে? ছোট হলেও সেই বামন অবতারের গল্পের মতো ছোট হলে আপত্তি থাকত না।
একসময় মানুষের আকৃতি নাকি বিশাল ছিল। পুরাণে মানুষের যেসব গল্প আছে, সেসব গল্প পড়লেই তো মানুষের আকৃতি ও তাদের বিশালত্ব সম্পর্কে জানা যায়। ধরা যাক হারকিউলিসের কথা। হারকিউলিসের যে ছবি আমরা দেখি সেটা তো আছেই। পাশাপাশি তাকে নিয়ে আছে অনেক গল্প। হারকিউলিসের সিংহ শিকারের গল্পটিই আগে বলে নেওয়া যাক। এক ছিল সিংহ। সে নগরীর নারীদের ধরে নিয়ে যেত। এরপর কোনো বীর সেই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে সিংহটি তাকে মেরে ফেলত। সিংহের গুহার কাছে গেলে প্রথমে একটি নারীকে দেখা যেত। তার কাছে যেতেই সে সিংহের রূপ নিত। আক্রমণ করত। হারকিউলিস গেল সেই সিংহের গুহায়। সিংহকে হত্যা করে তার মরদেহ ঘাড়ে করে ফিরে এল। হারকিউলিসকে এর পর পাঠানো হয়েছিল এক হাইড্রা নিধনে। সেই হাইড্রার দশ মুখ থেকে বের হতো আগুন, বিষাক্ত নিঃশ্বাস। লার্না লেকের ধারে হারকিউলিস সেই হাইড্রা নিধনে যাওয়ার আগে এক টুকরো কাপড়ে ঢেকে নিল নিজের নাক-মুখ, যাতে হাইড্রার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে তার কোনো ক্ষতি না হয়। সেই হাইড্রা নিধন করে ফিরে আসে হারকিউলিস। পর পর দুই অভিযানে সাফল্য আসে হারকিউলিসের। কিন্তু মানুষের এই অর্জনে দেবতারা খুশি হতে পারেননি। এবার হারকিউলিসকে পাঠানো হয় একের পর এক নানা কাজে। সব কাজেই সাফল্য পেয়ে যায় হারকিউলিস। হারকিউলিসের এই সাফল্য হচ্ছে মানুষের সাফল্য। হারকিউলিসের অভিযানগুলো তার বিশালত্বই তুলে ধরে আমাদের কাছে।
এই মানুষ নাকি ছোট হয়ে যাচ্ছে, ছোট হয়ে যাচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক। আবার মানুষের এই ছোট হয়ে যাওয়ার কাহিনীও মানুষেরই আবিষ্কার। গবেষকরা নানা গবেষণা করে দেখিয়েছন, আগের দিনের মানুষের তুলনায় আজকের দিনের মানুষ ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা ছবি বেরিয়েছে। সেটা হচ্ছে এ আমলের বামন মানুষের ছবি। এ সময়ের সবেচেয়ে খাটো মানুষটি দীর্ঘতম মানুষের জুতো নিয়ে দাঁড়িয়ে। জুতোর আকৃতি বামন মানুষের কাঁধের সমান। আজকের দিনের মানুষের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আগের দিনের মানুষ ছিল অনেক লম্বা ও হৃষ্টপুষ্ট। অনেক লম্বা হৃষ্টপুষ্ট মানুষের গল্প তো আমরা সেই লিলিপুটের গল্পেই পাই। জোনাথন সুইফটের গ্যালিভারের সফরনামাতে আছে লিলিপুটদের কাহিনী।
গ্যালিভার পেঁৗছে গিয়েছিলেন লিলিপুটদের দেশে। সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েছিল তাঁর জাহাজ। গ্যালিভার নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক দ্বীপে বন্দি অবস্থায়। সেখানকার সব মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতির। আঙুলের সমান। তারাই গ্যালিভারকে বেঁধে রেখেছিল। গ্যালিভারের সফরনামার লিলিপুটদের গল্প রূপকথার দেড় আঙুলে কৃষকপুত্রের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। আর পুরাণেও তো বামনের কথা আছে।
আবার ছোটর বড় অর্জনের কথাও তো পাওয়া যায় পুরাণে। বামনের গল্পটা বলে নেওয়া যাক। ভারতীয় পুরাণের বামন বিষ্ণুর পঞ্চম অবতার। কশ্যপ মুনির ঔরসে অদিতির গর্ভে বামনের জন্ম। একবার বলি এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন, এই যজ্ঞে তাঁর কাছে যে যা প্রার্থনা করবে, তিনি তাই পূরণ করবেন। সেই যজ্ঞে গিয়ে হাজির হলেন বামন। বলির কাছে তিনি ত্রিপাদ মাত্র জমি চাইলেন। যজ্ঞকার বলি ভাবলেন, এই ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণের ত্রিপাদ জমি আর কতটুকু। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। শুক্রাচার্য বলিকে এই দান করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু বলি যেহেতু অঙ্গীকার করেছেন, তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। বলি তাঁর এক পা দিয়ে চারদিক আয়ত্ত করলেন। দ্বিতীয় পা বিস্তার করলেন তিনি। স্বর্গ আয়ত্তে এসে গেল। তৃতীয় পা দেওয়ার জন্য আর কোনো ভূমি থাকল না। বলি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।
মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে গেলেও মানুষের কীর্তি তো আর ছোট হতে পারে না। মানুষের কীর্তি তাকে অনেক বড় করে রাখে। হয়তো এটাইর্ িঠক যে মানুষ আগের দিনের তুলনায় আজকের দিনে অনেকটাই খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে। সেটা কি সর্বক্ষেত্রেই? হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ক্ষুদ্রতার পরিচয় দিচ্ছি। ক্ষুদ্রতার পরিচয় দিচ্ছি আমাদের আচার ও আচরণে। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতীয় সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ক্যাডেটদের পাসআউট প্যারেডে সালাম গ্রহণের জন্য। এটা সামরিক বাহিনীর একটা রীতি। আমাদের সাবেক এক সেনাপ্রধানও গিয়েছিলেন ভারতের দেরাদুনে এমন এক পাসআউট প্যারেডে সালাম নিতে। স্বাভাবিক নিয়ম, রীতি ও নীতি মেনেই আসছেন ভারতের সেনাপ্রধান। তিনি শুধু ভারতের মেনাপ্রধান_এটাই আমাদের কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় নয়। সম্ভবত তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শেষ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা। তাঁকে সম্মানিত করতে পারা তো আমাদেরই সম্মান।
কিন্তু এটা নিয়েও রাজনীতি হয়ে গেল। জনৈক নেতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেঠো বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি তাঁর মেঠো বক্তৃতায় বলেছেন ভারতের সেনাপ্রধানকে স্যালুট না করতে। তিনি যখন এই আহ্বান জানাচ্ছেন, তখনই কিন্তু তাঁর দলের মহাসচিব জানিয়ে দিচ্ছেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। ক্ষুদ্রতা এখানেই। এখানেই আমরা ছোট হয়ে যাচ্ছি। আকারে ছোট হয়ে গেলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু কীর্তিতে একবার খর্বাকৃতির হয়ে গেলে সে বড় লজ্জার কথা। আমাদের পৃথিবী কি এভাবেই ছোট হয়ে আসছে? আমরা কি ক্ষুদ্রতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments