কে বলে নেই তিনি by কামাল লোহানী
ফয়েজ আহ্মদ, আমাদের ফয়েজ ভাই শারীরিকভাবে আর নেই। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় তিনি ভুগছিলেন। এই প্রবীণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সংগঠক ৮৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভোরে। ফয়েজ আহ্মদ ছিলেন জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ একজন মানুষ। তাঁর কাজ ও খ্যাতির সীমানা বিস্তৃত।
তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণেই ঠাঁই করে নিয়েছিলেন মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে। আর এ কারণেই তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন। ফয়েজ আহ্মদের মতো মানুষদের তো মৃত্যু হয় না। বামধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পরই। কিন্তু রাজনীতি তাঁর পেশাকে স্পর্শ করেনি। পেশাকে সমুন্নত রাখার প্রয়াস ছিল তাঁর অনুসরণযোগ্য। স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁকে আমরা দেখেছি প্রথম কাতারে। শিল্পানুরাগী ফয়েজ আহ্মদের পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া ভার। একুশে পদক, বাংলা একাডেমী ও শিশু একাডেমী পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার তিনি লাভ করে গেছেন, কিন্তু কোনো কিছুর প্রতিই তাঁর কোনো মোহ ছিল না। ত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত ফয়েজ আহ্মদরা যুগে যুগে জন্মান না। মৃত্যুর আগেই তাঁর চোখ সন্ধানীতে এবং দেহ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজকে দান করে গেছেন। আজ যেটি বেইজিং রেডিও (অতীত নাম পিকিং রেডিও) সেখানে তিনি বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার চালু করেছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক। ইত্তেফাক, আজাদ পত্রিকায় তিনি গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি সিপিবিতে যোগ দিয়েছিলেন। জনকল্যাণের রাজনীতির ফল্গুধারা তাঁকে সব সময় তাড়িত করত। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে সাপ্তাহিক স্বরাজ নামে তিনি একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। অত্যন্ত সাহসী ও প্রতিবাদী ভাষায় স্বরাজের পাতাগুলোতে যেসব প্রতিবেদন, নিবন্ধ তখন ছাপা হতো, তা মুক্তিকামী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। স্বরাজ খুব বেশি দিন প্রকাশিত হয়নি। শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯ মার্চ ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর সেনানিবাসে বিদ্রোহের পর আমি সেই বিদ্রোহের রিপোর্ট লিখেছিলাম। ফয়েজ ভাই এর শিরোনাম করেছিলেন, 'বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত'। তখনকার সময় এমন সাহসী উচ্চারণ খুব শক্তি জুগিয়েছিল। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যাই একসঙ্গে। তিনি 'পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে' একটি ভাষ্য লিখতেন। কিন্তু তাঁর ভোকাল ভালো না থাকায় আমাকে তা নিয়মিত পাঠ করতে হতো। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সেই দিনগুলোতে, অর্থাৎ উত্তাল সময়ে ফয়েজ ভাই কী অসম্ভব সাহস, অনুপ্রেরণা জোগাতেন এবং স্বপ্ন দেখাতেন, তা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর আমরা দেশে ফিরেছিলামও একসঙ্গে। এম আর আখতার মুকুল, এ বি এম মূসাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে। তখন ফয়েজ ভাই উচ্চারণ করতেন, আমাদের সোনার বাংলা বিপুল রক্ত খরচে কেনা। স্বপ্ন দেখার সাহসটাও ছিল তাঁর প্রচণ্ড। পাকিস্তান আমলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু আমাদের দিকে নিবদ্ধ ছিল, তখনও ফয়েজ ভাই ছিলেন সোচ্চার। মনে পড়ে, 'পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' নামে তখন একটি প্রগতিশীল সংগঠনের জন্ম তিনি দিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে সেটিকে দাঁড়ও করিয়েছিলেন। এককথায় সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল তাঁর অতুলনীয়।
একুশে উপলক্ষে 'সংযুক্ত একুশে উদ্যাপন কমিটি' নামেও একটি সংগঠন ফয়েজ ভাইয়ের হাতে জন্ম নিয়েছিল। এই সংগঠনটিই পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হিসেবে পরিচিত হয়। এ সবই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়া প্রতিষ্ঠান। তাঁর শতাধিক বইয়ের মাঝে 'সত্য বাবু মারা গেছেন', 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' তাঁকে অন্যভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। ছড়ায় তো তাঁর তুলনাই মেলা ভার। ছড়া দিয়েই তো তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল, যা পরে নানা শাখায় বিস্তৃত হয়েছে। এ জন্যই বলতে হয় তিনি আছেন, থাকবেন আমাদের নানা ক্ষেত্রে অত্যন্ত দাপটে। তিনি নেই এ কথা বলা যাবে কী করে? এত কিছু যিনি করে গেছেন, তিনি আমাদের মাঝে না থাকবেন কী করে? তাঁর কাছে তাঁর জন্যই আমরা হয়ে থাকব চিরঋণী।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি সিপিবিতে যোগ দিয়েছিলেন। জনকল্যাণের রাজনীতির ফল্গুধারা তাঁকে সব সময় তাড়িত করত। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে সাপ্তাহিক স্বরাজ নামে তিনি একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। অত্যন্ত সাহসী ও প্রতিবাদী ভাষায় স্বরাজের পাতাগুলোতে যেসব প্রতিবেদন, নিবন্ধ তখন ছাপা হতো, তা মুক্তিকামী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। স্বরাজ খুব বেশি দিন প্রকাশিত হয়নি। শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯ মার্চ ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর সেনানিবাসে বিদ্রোহের পর আমি সেই বিদ্রোহের রিপোর্ট লিখেছিলাম। ফয়েজ ভাই এর শিরোনাম করেছিলেন, 'বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত'। তখনকার সময় এমন সাহসী উচ্চারণ খুব শক্তি জুগিয়েছিল। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যাই একসঙ্গে। তিনি 'পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে' একটি ভাষ্য লিখতেন। কিন্তু তাঁর ভোকাল ভালো না থাকায় আমাকে তা নিয়মিত পাঠ করতে হতো। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সেই দিনগুলোতে, অর্থাৎ উত্তাল সময়ে ফয়েজ ভাই কী অসম্ভব সাহস, অনুপ্রেরণা জোগাতেন এবং স্বপ্ন দেখাতেন, তা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর আমরা দেশে ফিরেছিলামও একসঙ্গে। এম আর আখতার মুকুল, এ বি এম মূসাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে। তখন ফয়েজ ভাই উচ্চারণ করতেন, আমাদের সোনার বাংলা বিপুল রক্ত খরচে কেনা। স্বপ্ন দেখার সাহসটাও ছিল তাঁর প্রচণ্ড। পাকিস্তান আমলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু আমাদের দিকে নিবদ্ধ ছিল, তখনও ফয়েজ ভাই ছিলেন সোচ্চার। মনে পড়ে, 'পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' নামে তখন একটি প্রগতিশীল সংগঠনের জন্ম তিনি দিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে সেটিকে দাঁড়ও করিয়েছিলেন। এককথায় সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল তাঁর অতুলনীয়।
একুশে উপলক্ষে 'সংযুক্ত একুশে উদ্যাপন কমিটি' নামেও একটি সংগঠন ফয়েজ ভাইয়ের হাতে জন্ম নিয়েছিল। এই সংগঠনটিই পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হিসেবে পরিচিত হয়। এ সবই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়া প্রতিষ্ঠান। তাঁর শতাধিক বইয়ের মাঝে 'সত্য বাবু মারা গেছেন', 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' তাঁকে অন্যভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। ছড়ায় তো তাঁর তুলনাই মেলা ভার। ছড়া দিয়েই তো তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল, যা পরে নানা শাখায় বিস্তৃত হয়েছে। এ জন্যই বলতে হয় তিনি আছেন, থাকবেন আমাদের নানা ক্ষেত্রে অত্যন্ত দাপটে। তিনি নেই এ কথা বলা যাবে কী করে? এত কিছু যিনি করে গেছেন, তিনি আমাদের মাঝে না থাকবেন কী করে? তাঁর কাছে তাঁর জন্যই আমরা হয়ে থাকব চিরঋণী।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক
No comments