আমি কী ভাবছি-আধা মানুষ, আধা মগজ by শামীম আজাদ

বহুদিন আগের কথা। নারীর নৈপুণ্য ও পুরুষের পেশির জন্য কিছু কিছু পেশা নারীর আর কিছু পুরুষের বলে পরিচিত হয়ে উঠলে একসময় তা বিশ্বাস হয়ে উঠেছিল। পরে প্রয়োজনে, বিপাকে ও ঘটনাক্রমে নারী-পুরুষের জন্য চিহ্নিত কিংবদন্তি কর্তব্য বা কাজগুলো এবং অপর লিঙ্গকে যথেষ্ট পারঙ্গমতার সঙ্গে করতে দেখা গেলেও কিন্তু তা তাদের ব্যক্তিগত অর্জন


বলেই স্বীকৃত হলো। সে অর্জন আর সমষ্টির হলো না। অন্যদিকে ব্যর্থতাগুলো সমষ্টির বলে চিহ্নিত হলো এবং আজও হচ্ছে। ফলে একটি অঙ্কের মুখস্থ সমাধানই প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছে বহুদিন থেকে। তাই কৃতকর্মের জন্য নারী বা পুরুষ ব্যতিক্রম হিসেবেই সমাজ কর্তৃক পুরস্কৃত বা ধিক্কৃত হলো। যে সমাজ ‘মানুষ’ নয়, পুরুষের তৈরি।
আসলে ব্যাপারটা কী? মাটিকাটা, পাথর ভাঙা, উড়োজাহাজ বা গাড়ি চালানো, বাড়ি বানানো, রেস্টুরেন্ট-হোটেলে শেফের কাজ, ফুলসজ্জা, চুলসজ্জা, উল ও তাঁত বোনা—সবই উভয়ে করতে সক্ষম—যদি তা করতে শেখানো হয়। আর পারে না যদি তার কারণ ভিন্ন। ব্যাপারটি একজন শক্তপোক্ত নারীর (মানুষের) চেয়ে একজন রোগাশোকা মেয়ে একটু কম বাইতে বা বইতে পারার মতো। অনুরূপভাবে দুজন মানুষের মধ্যে (ধরা যাক, তার একজন পুরুষ অন্যজন নারী) যার শক্তি বেশি, যার ভালো খাবার ও পুষ্টির ইতিহাস রয়েছে, যে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে বলে বিষয় ও যুক্তিবুদ্ধি বেশি, সে যে এগিয়ে থাকবে, তা কি বলার দরকার পড়ে? পড়ে না।
জীবিকার জন্য সবাই ’ফুলটাইম’ কাজ করেন। কিন্তু ভাবুন তো, কারা সত্যিকার অর্থে ফুলটাইম ওয়ার্কার? মেয়েরা। তাদের ফুলটাইম পেশার নানাবিধ কর্মকাণ্ড আছে—আছে তার ব্যাখ্যা ও বিবরণ, কিন্তু নেই পরিসংখ্যান ও মূল্যায়ন। ‘কাজ’ অর্থে যা বোঝায়, যা দিয়ে দৃষ্টিযোগ্য নিট আয় হয়, তার বাইরে যে কাজ আছে, তার স্বীকৃতি কি আছে? অথচ থাকা উচিত। কারণ, তার গ্রস ইনকাম বা আয় হচ্ছে, এর মধ্যে ব্যয় সংকোচনতাও ধরা উচিত। কিন্তু এ কাজগুলোর বেশির ভাগই নারীরা করেন বলে সাধারণত তা হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দুজন মিলেই এই সোনার পৃথিবী নির্মাণ, কিন্তু নারীরা এ কাজের কতটা করেন, তার কোনো পরিসংখ্যান ও মূল্যায়ন কি হয়?
নারী কতটুকু করেন, তা জানতে কেস স্টাডি হিসেবে একটা কাজ করা যেতে পারে। নাগরিক বা গ্রামীণ কোনো এক ‘কেজো পুরুষ’ এবং কোনো এক ‘অকেজো নারী’র পায়ে একটি পদক্ষেপ মাপার যন্ত্র জুড়ে দিলেই হয়। তারপর প্রাত্যহিক কাজ শেষ হলে ঠিক বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার পরিসংখ্যানটি দেখলেই হয়। বোঝা যাবে, সারা দিন কে কত শারীরিক পরিশ্রম করেছেন! তবে এতে শুধু পাওয়া যাবে তাঁদের হাঁটাহাঁটির পরিমাপ। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ এমনকি মগজের হিসাব ধরা পড়বে না। কিন্তু নারীর এই বাড়তি কর্ম কোনো কালেই কর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। অথচ বাড়ির নারী ছাড়া অন্য কেউ সে সব কাজ করলে তার একেকটা নাম হয়, তাদের বেতন হয়। ড্রাইভার, মালী, ইভেন্ট কো-অর্ডিনেটর, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, সুপারভাইজার, নাপিত, আয়া, বাবুর্চি, কাজের মেয়ে অথবা ব্যক্তিগত সহকারী, কত কী! আর আমাদের কর্মজীবী নারীরা ফুলটাইম কাজ করেন। এর ওপর তাঁরা সবই করেন—তাঁরা গার্মেন্টস, ব্যবসা, দোকান, গাড়ি চালনাসহ সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, লেখালেখি, কোম্পানি পরিচালনা, হিসাবরক্ষণ, প্রধান নির্বাহীর কাজসহ অন্যান্য কাজ শুধু করেন না, তা একনিষ্ঠতার সঙ্গে করেন। অ্যান্ড উই (পুরুষ সমাজ) টেক ইট অ্যাজ গ্রান্টেড।
জীবনযাপনের নানা ‘কাজের’ বিশাল একটা অংশ জীবিকা অর্জনের বাইরের সময়েই করতে হয়। তবেই জীবন সচল থাকে এবং সেদিক বিবেচনা করলে সব দেশে সব কালে মেয়েরাই ফুলটাইম ওয়ার্কার আর ছেলেরা পার্টটাইমার। এ ফুলটাইম এমপ্লয়মেন্টের জন্য মেয়েটিকে জন্ম থেকেই ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার সে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষানবিশ কাল কাটে বিবাহের আগে বাবা-মায়ের ঘরে। যার বাবা নেই তার মায়ের বা মামা-চাচার ঘরে। এ প্রশিক্ষণ ও কাজের অভিজ্ঞতা প্রকল্পে কোনো ভাতা নেই, শুধু ভাত। এর শুরু হয় মেয়েটির শিশুত্বের মেয়াদ পেরোনো মাত্র। কিশোরী কন্যাটিকে ভাইদের সঙ্গে সাইকেল চালাতে চালাতে বা দুরন্ত সাঁতার দিতে দিতে হঠাৎ একদিন ‘নারী’ করে দেওয়া হয়, আর তখন থেকেই শুরু হয় ফুলটাইম কাজের প্রশিক্ষণ। পূর্ণাঙ্গ নারী হওয়ার জন্য সে কাজ করে ঘরে-বাইরে, সকাল-দুপুর-বিকেল-রাতে, গ্রীষ্মে-বর্ষায়, শ্রাবণে-ভাদ্রে, জাগরণে এমনকি নিদ্রায়। প্রহরে প্রহরে তার পালক খসাতে হয়। সে শেখে কত কম খেয়ে, বেশি সময় জেগে কম ঘুমিয়ে, অপমানে, অবসাদে চুপ করে টিকে থাকা সম্ভব।
যে কিশোর একদিন ‘পুরুষ’ হবে তারও প্রশিক্ষণ হয়। তবে তার জন্য ভাতা আসে প্রশংসাবাক্যে, পুষ্টিতে, পোশাকে। কারণ, সমাজ মনে করে, সামনে যে তাকে পুরুষের মতো জীবনযুদ্ধে নেমে আয় রোজগার করতে হবে! তার ঘুমের সময় ঘুম আর খাওয়ার সময় খাওয়ার দরকার। কিন্তু মজার কথা হলো, এসব সমতাবিহীন অন্যায় নিয়ম ও সংস্কৃতির কারণে ছেলেটিই জীবনযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু গুণ বঞ্চিত হয়ে অকেজো ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে। ব্যতিক্রমের কথা বলছি না, বলছি সাধারণভাবে যা হয়। একজন পরিণত পুরুষ তার পরিবারের নারী সদস্য বিয়োগে দিশাহারা হয়ে যায়। এক কাপ চা বানাতে দিলে রান্নাঘর লন্ডভন্ড হয়। মাছ কাটতে কাঁচি নিয়ে আসে কিংবা সন্তানের জামা কিনতে গেলে নিয়ে ফেরে ওভার অথবা আন্ডার সাইজ! কিন্তু তাকে দোষ দেবেন কী করে? তাকে তো বড় করে তোলা হয়েছে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় সমস্যা, যেমন—ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন ইস্যু, খালেদা না হাসিনা আসবেন রিসেশন মার্কেট নিয়ে ভাবার জন্য। যেখানে মেয়েদের বড় করা হচ্ছে জীবনের তুচ্ছ ও ছোট ছোট বিষয়, যেমন—সাংসারিক আয়-ব্যয়, বাচ্চার পড়াশোনা ও স্কুল নির্বাচন, দেহে নতুন প্রাণ ধারণ ও বহন, পরিবারের পুষ্টি—এসব সমাধানের জন্য। আর তাতেই মেয়েরা বড় হয়ে ফুলটাইম কাজের জন্য পারঙ্গম হয় আর ছেলেরা একজন পার্টটাইমার! ওরা সব কাজ পারে না। অথচ বায়োলজিক্যালি সন্তান ধারণ ও দুগ্ধদান ছাড়া আর সবই তো পারার কথা।
ছেলেদের প্রশিক্ষণকালে তাদের গায়ে আরেকটি খোসা ছড়িয়ে দেওয়া হয়—‘পুরুষের অহং’। অহংকার পুষতে শিখে একদিন ‘মানুষ’ হিসেবে স্বাভাবিক ব্যর্থতা এলে পুরুষ নিদারুণ অসহায়ত্বের অঙ্গারে একা একা কেবলই পুড়ে। জীবনে চ্যালেঞ্জ এলে বেচারাদের ‘নারীর অধম’ বলে নিন্দা শুনতে হয়। ইগোর জ্বালায় মানুষ হিসেবে তার ব্যর্থ হওয়ারও অধিকার চলে যায়। কাউকে বলতে পারে না, সহ্যও করতে পারে না। চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ঘরের কোনো কাজ নারীর কাজ বলে তা করে না। ফলে তার অজেকো শরীরে দ্রুত অসুখ আসে। ‘ক্ষমতা’ হাতে রাখার জন্য যে কাজগুলো একদিন নারীর বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সময়ের সংগোপন সঞ্চারে এখন তা বুমেরাং হয়েছে। এ প্রকৃতির শোধ।
ছেলে কিংবা মেয়ে বা নারী-পুরুষ নয়, মানুষ করে তুলতে হবে। সবাইকেই হতে হবে ফুলটাইম ওয়ার্কার। কারণ, আধা কাজ করলে আপনি আধা মানুষ ও আধা মগজ হয়েই থাকবেন। এর বেশি নয়।
১৪.০২.১২ লন্ডন, অনাবাসী কবি, লেখক, সাংবাদিক Shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.