গ্যাস উত্তোলন ও বণ্টন চুক্তি-দেশের স্বার্থ দেখতে হবে সবার আগে
তেল-গ্যাস, খনিজ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বিরোধিতা করেছিল। দেশের বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও এ চুক্তির বিপক্ষে ছিলেন। অনেকটা চোখে আঙুল দিয়েই সরকারকে দেখানো হয়েছিল চুক্তির ক্ষতিকর দিকগুলো; দেখানো হয়েছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতার দিকটিও।
কিন্তু তার পরও বঙ্গোপসাগরের দুটি ব্লক থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি করেছে সরকার। এ চুক্তি অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের ১১ ও ১২ নম্বর ব্লকে পাঁচ হাজার ১৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সুযোগ পাবে কনোকো-ফিলিপস। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে এ দুটি ব্লকে সমুদ্রের গভীরতা এক থেকে দেড় কিলোমিটার। এমন একসময়ে এই চুক্তি হয়েছে, যখন দেশে জ্বালানি সংকট প্রবল। গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না বহু শিল্প-কারখানা। প্রতিদিন ২৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাসের সরবরাহ এখন ২০০ কোটি ঘনফুট।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রণীত মডেল পিএসসি-২০০৮ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কনোকো ফিলিপস নির্বাচিত হয়। কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে এ চুক্তির বিষয়ে তেল-গ্যাস, খনিজ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে, 'কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি হলে মডেল পিএসসি অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০ শতাংশ গ্যাস পাবে। বাকি ৮০ শতাংশ গ্যাস নির্দিষ্ট দরে কিনে নিতে হবে। বাংলাদেশ ওই গ্যাস কিনতে না পারলে কনোকো-ফিলিপস তা রপ্তানি করতে পারবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রপ্তানিমুখী মডেল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট বা পিএসসি) আওতায় এ চুক্তি দেশের জন্য আত্মঘাতী।' তাঁরা বলেছেন, এ গ্যাস আমাদের দেওয়া হবে ১৫০ মাইল দূরে সমুদ্রের কূপে। আবার বাংলাদেশের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্যের দিক থেকে এ গ্যাস পরিবহন অলাভজনক। ফলে তা রপ্তানির সুযোগই করে দেওয়া হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, 'সেই সঙ্গে এ গ্যাস সরকার ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে সরাসরি বিক্রির সুযোগও এ বিনিয়োগকারী পাচ্ছে।...এই গ্যাস বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের কাছে বিক্রি করার বিধান থাকলেই সরকার এ গ্যাস কিনবে এবং উৎপাদিত গ্যাসে জনগণের শতভাগ মালিকানা সংবিধানের আলোকে নিশ্চিত হবে।'
নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে পেতে হলে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য। পেট্রোবাংলা পুরো বাংলাদেশের সীমানাকে মোট ৫২টি ব্লকে ভাগ করেছে, যার মধ্যে ২৮টিই সমুদ্রে। পাশাপাশি এই বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে, আমাদের সেই মানের উন্নত প্রযুক্তি বা আর্থিক সংগতি নেই। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের বহুজাতিক কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। কিন্তু বহুজাতিক কম্পানির সঙ্গে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। মাগুরছড়া এখনো আমাদের সামনে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাফকোর তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমাদের সামনে রয়েছে। আমরা জানি, ভারত ও মিয়ানমার ইতিমধ্যে সাগরে খনিজ অনুসন্ধান শুরু করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকেও এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্পদ ফেলে রাখা যাবে না। ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমার কেমন করে অনুসন্ধান করছে, সে বিষয়টিও আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার এবং সেভাবেই দেশের স্বার্থ শতভাগ নিশ্চিত করে আমাদের গ্যাস উত্তোলন চুক্তি করা প্রয়োজন।
No comments