ভাষাসৈনিকদের তালিকা-রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও দেওয়া হোক

ভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার যে অনন্য ইতিহাস আমাদের রয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল দেশ বিভাগের পরই। কিন্তু এ দেশের মানুষ তা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ হয়েছিল শুরুতেই। এর পর ১৯৫২ সালে বাঙালির প্রতিবাদের তীব্র প্রকাশ।


ভাষার দাবিতে পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চালিয়েও বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। রক্ত দিয়েছে বাঙালি; কিন্তু ভাষার দাবি থেকে বিচ্যুত হয়নি। ঢাকায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সেই ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। আমাদের শহীদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশ আজ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগের অন্ত নেই। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিও জানানো হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। জাতিসংঘ অনেক ভাষাকেই দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সেটা আমাদের জন্য আরো গৌরব বয়ে আনবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যে বাজেট প্রয়োজন, সে বরাদ্দ ও কারিগরি দক্ষতা কি আমাদের আছে? রাতারাতি সে দক্ষতা যেমন অর্জন করা যাবে না। কিন্তু বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির যে চেষ্টা করা হচ্ছে, তাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। তবে যে ভাষার দাবি নিয়ে আজ আমরা জাতিসংঘে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি, সেই ভাষার অধিকার আদায়ের সৈনিকদের তো আমরা সম্মানিত করতেই পারি।
ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছরে আজ অনেক ভাষাসৈনিককে আমরা পাই না। অনেক নেতৃস্থানীয় ভাষাসৈনিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে বাধ্যর্কজনিত রোগে ভুগছেন। ইতিহাসের অংশ হলেও নির্দিষ্ট একটি সময় ছাড়া তাঁদের তেমন কোনো মূল্যায়ন হয় না। রাজধানীতে বসবাসকারী ভাষাসৈনিকদের তবু ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দেখা যায়। কিন্তু দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাষাসৈনিকদের খোঁজ আমরা কমই রাখি। কোথাও তাঁদের দেখা যায় না। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে তাঁদের সেই দিনের অবদানকে খাটো করে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। অথচ ভাষাসৈনিকদের তালিকা এখনো অসম্পূর্ণ। একটি তালিকা করার জন্য আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই নির্দেশনা মোতাবেক একটি তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ নয়। আশা করা যেতে পারে, এই তালিকা একসময় সম্পূর্ণ হবে। বায়ান্নর ভাষাসৈনিকদের অনেকের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। তালিকা তৈরির পাশাপাশি সবার জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভাষাসৈনিক পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির একটি কোটাও নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাঁদের জন্য মাসিক ভাতা বরাদ্দের বিষয়টিও সরকার সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে পারে। সম্ভাব্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে তাঁদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
বায়ান্নতে যাঁরা ভাষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তাঁদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আজ বিশ্বের দরবারে বাংলার যে অবস্থান, এর পেছনে তাঁদের অবদান আছে। ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করলে তাতে রাষ্ট্রই সম্মানিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.