বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাজার ও টিসিবি by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
দীর্ঘদিন ধরে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। বাজারের এই অস্থিতিশীলতা সাধারণ মানুষের জন্য বিড়ম্বনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ। বিশেষ করে এই ৪০ শতাংশের জীবনযাত্রার মান খুবই নাজুক এবং মূল্যস্ফীতির করালগ্রাস তাদের পিষে মারছে।
অনস্বীকার্য যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার এ পর্যন্ত দৃশ্যত নানা কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর ফল ইতিবাচক নয়। ৯ জুন ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশের পর বাজারে নতুন করে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রমজান মাস প্রায় সমাগত। গত রমজানের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে রয়েছে। সব মিলিয়ে এ রমজানে বাজার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, এটি সংগত কারণেই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা মহল থেকে বারবার টিসিবিকে (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) কার্যকর করার তাগিদ অব্যাহতভাবে দিয়ে এলেও এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সামগ্রিক চিত্র প্রশ্নবোধক। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, সরকারি সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতার অভাবে টিসিবি একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তিনি আরো বলেছেন, আর্থিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের অভাব, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসায়িক সক্ষমতার অভাব, আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্যের অভাব ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের দৌরা@ে@@@্য টিসিবি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি।
বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের অনেক কিছুর সঙ্গেই দ্বিমত প্রকাশ করার অবকাশ রয়েছে। টিসিবি নামক প্রতিষ্ঠানটির অতীত কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন মানুষ মাত্রই জ্ঞাত আছেন। টিসিবি একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান হিসেবেই তার কার্যক্রম শুরু করেছিল। একাধারে কয়েকটি বছর টিসিবি সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ভূমিকাও রেখেছিল। সেই প্রতিষ্ঠানটি কী করে ক্রমেই পঙ্গুত্ব বরণ করল_এ প্রশ্নের জবাবও সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারের স্বার্থান্বেষী মহল কিংবা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এই টিসিবিকে পঙ্গু বানিয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদেরও নিজেদের স্বার্থেই পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এই মহল। কাজেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিসিবি সম্পর্কে গড়পড়তা কথা বলে পার পেয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা করেছেন, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। বিগত প্রায় আড়াই বছরে তিনি কিংবা তাঁর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত যা করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তা অসার তর্জন-গর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতির জন্য সিন্ডিকেট নামক চক্রকে তাঁরা দায়ী করেছেন বহুবার। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করা কিংবা কারো কেশাগ্র স্পর্শ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি, বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ এক অন্তহীন জিজ্ঞাসা। ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অব্যাহত যে নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে, এর সুরাহা কেন সম্ভব হচ্ছে না_এটিও বড় প্রশ্ন। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের এবং তৎসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এসব প্রশ্ন জিইয়ে রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবেন, তা অনেকেরই বোধগম্য নয়।
নিকট অতীতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবিকে সক্রিয় করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে করপোরেটাইজ করা তথা কম্পানিতে রূপান্তরের সুপারিশ করেছিল মেট্রোপলিটন চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। কম্পানি আইনের আওতায় কম্পানি করে পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে টিসিবি পরিচালনা করার কথা উল্লেখ করে এমসিসিআই নেতারা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে যেভাবে কম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে, সে পদ্ধতি অনুসরণেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন। টিসিবি সম্পর্কে এ রকম বহু প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। চার দশকের পুরনো একসময়ের অধিকতর কার্যকর প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে আবার আপৎকালীন নিত্যপণ্যের বাজারে হস্তক্ষেপের উপযোগী করে গড়ে তোলার সরকারি ঘোষণা কেন অকার্যকর, তা-ও রহস্যে ঘেরা। ১১ জুন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, গত এক বছরে এক হাজার কোটি টাকা চেয়ে যে টিসিবি কোনো পয়সা পায়নি, সেই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় শুনিয়েছেন। আমরা জানি না, এই বৈপরীত্যের অবসান কিভাবে ঘটবে এবং প্রকৃতপক্ষে টিসিবি কেমন করে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ অবস্থায় 'মার্কেট ইন্টারভেনশনে' টিসিবির পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখা কঠিন। তা ছাড়া টিসিবিতে কর্মরত বর্তমানে যে সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, তাঁদের দিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি তাঁদের অনেকেরই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। এখানেও রয়েছে অশুভ সিন্ডিকেটের প্রভাব। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশবলে জনকল্যাণকর টিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম দেওয়া হয়েছিল, দীর্ঘ ৪০ বছরেও এ সংস্থার আইন ও বিধিমালা যুগোপযোগী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; অথচ এ সংস্থাটিকে দিয়েই সরকার বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কাজ করার কথা বলছে। এই স্ববিরোধিতা কারো জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে না। ১৭ জুন একটি দৈনিকে প্রকাশ, খুলনা মহানগরীসহ ১৪টি জেলায় ২০ জুন থেকে টিসিবির কার্যক্রম নতুন করে শুরু হচ্ছে। টিসিবিকে যে অবস্থায় রেখে এই কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়ছে, এর ফল কতটা আশাব্যঞ্জক হবে_তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
টিসিবিকে সরকার কিভাবে কার্যকর করবে কিংবা সরকার আসলে কী করতে চায়, তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। যে টিসিবিকে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, বহু বছর অনাদর ও অবহেলায় তা পঙ্গুপ্রায়। তাই সেই অবকাঠামো কিভাবে অল্প সময়ে পুনর্গঠন করা হবে, আগে তা ঠিক করাই শ্রেয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম অসতর্কতা না থাকে। বাজারে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সমান্তরালে টিসিবি কিভাবে নিশ্চয়তার কাজ করবে, তাও দেখতে হবে। বাজার কিংবা সরকারের একচেটিয়াপনার দুই বিপরীত পথের মধ্যে মধ্যপন্থা হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে এর আগে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করা হলেও এর যথেষ্ট সুফল পরিলক্ষিত হয়নি। যদিও ব্যবস্থাটি ছিল সরকারি হস্তক্ষেপহীন মুক্তবাজার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সামান্য হলেও একটি নতুন চিন্তা। বাজার তার নিজস্ব নিয়মে চলবে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার মুখে মানুষ যাতে অসহায় হয়ে না পড়ে তার জন্য সরকারের হাতেও কিছু রক্ষাকবচ থাকা দরকার। একে বলা যায় বাজারের খামখেয়ালি কিংবা গোষ্ঠীবিশেষের অতিমুনাফার ক্ষতিকারকতার বিরুদ্ধে সরকারি বাঁধ। মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারভুক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে এক নম্বর হলো সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং টিসিবিকে শক্তিশালী করা। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। আর টিসিবির ব্যাপারে একের পর এক শুধু সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে কোনো অগ্রগতি নেই।
টিসিবির দুরবস্থা অগ্রহণযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যখন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ওঠে, তখন সেই সংস্থার থাকা না থাকা মানুষের কাছে সমান হয়ে পড়ে। টিসিবির অবস্থা হয়েছে সে রকম। না আছে লোকবল, না আছে কাজ করার ক্ষমতা। টিসিবির নিকট-অতীতের কিছু কর্মকাণ্ড হাস্যকর ঠেকেছিল। যেমন বাজারে যখন ডালের দাম কম ছিল তখন বেশি দাম দিয়ে ডাল কিনেছিল টিসিবি। আর ওই কাজে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছিল এবং সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল। এ রকম আরো অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অপচয় বাড়ছে। বর্তমান বাজারব্যবস্থার যে লাগামহীন অবস্থা, তাতে টিসিবিকে কার্যকর করে পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া সম্ভব_এ কথা বাজার বিশ্লেষকদের তরফে বারবার উচ্চারিত হলেও তা ফলদায়ক হয়নি। মূল কথা হলো, টিসিবির অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ভাঙাচোরা ঘরের মতো। অথচ এই টিসিবিই একসময় দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ওষুধ, টেঙ্টাইলসহ ৬৩টি পণ্য আমদানি করা হয়েছিল টিসিবির মাধ্যমে। সেই অর্থবছরে মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ টিসিবির মাধ্যমে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে চারদলীয় জোট সরকার টিসিবির আকার আরো ছোট করে ফেলে। এর পেছনেও অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেছিল।
গত ১০ জুন রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আসন্ন রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম না বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলেছেন, তাঁরা রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়াবেন না। কিন্তু এর মাত্র চার দিন পর ভোজ্য তেল নিয়ে আবার তেলেসমাতি হলো। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীকে আরো আশ্বাস দিয়েছিলেন, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য তাঁরা সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ রকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি উভয় তরফ থেকে বারবার ব্যক্ত হলেও কার্যত ফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দাঁড় করিয়ে মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ভোক্তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমদানি করা যেসব পণ্যদ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল, অভ্যন্তরীণ বাজারে সেসবেরও দাম ঊর্ধ্বমুখী পরিলক্ষিত হয়েছে। এখানেই মহলবিশেষের কারসাজির ব্যাপারটি প্রকট হয়ে ওঠে। সরবরাহ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, তদারকি_সব কিছু মিলিয়ে জনবিড়ম্বনার অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজার। এই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কতটা সক্ষম-এ প্রশ্ন সংগত কারণেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com
বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের অনেক কিছুর সঙ্গেই দ্বিমত প্রকাশ করার অবকাশ রয়েছে। টিসিবি নামক প্রতিষ্ঠানটির অতীত কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন মানুষ মাত্রই জ্ঞাত আছেন। টিসিবি একটি কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান হিসেবেই তার কার্যক্রম শুরু করেছিল। একাধারে কয়েকটি বছর টিসিবি সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ভূমিকাও রেখেছিল। সেই প্রতিষ্ঠানটি কী করে ক্রমেই পঙ্গুত্ব বরণ করল_এ প্রশ্নের জবাবও সচেতন মানুষ মাত্রেরই জানা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারের স্বার্থান্বেষী মহল কিংবা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এই টিসিবিকে পঙ্গু বানিয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদেরও নিজেদের স্বার্থেই পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এই মহল। কাজেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিসিবি সম্পর্কে গড়পড়তা কথা বলে পার পেয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা করেছেন, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। বিগত প্রায় আড়াই বছরে তিনি কিংবা তাঁর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত যা করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তা অসার তর্জন-গর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতির জন্য সিন্ডিকেট নামক চক্রকে তাঁরা দায়ী করেছেন বহুবার। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করা কিংবা কারো কেশাগ্র স্পর্শ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি, বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ এক অন্তহীন জিজ্ঞাসা। ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অব্যাহত যে নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে, এর সুরাহা কেন সম্ভব হচ্ছে না_এটিও বড় প্রশ্ন। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের এবং তৎসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এসব প্রশ্ন জিইয়ে রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবেন, তা অনেকেরই বোধগম্য নয়।
নিকট অতীতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবিকে সক্রিয় করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে করপোরেটাইজ করা তথা কম্পানিতে রূপান্তরের সুপারিশ করেছিল মেট্রোপলিটন চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। কম্পানি আইনের আওতায় কম্পানি করে পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে টিসিবি পরিচালনা করার কথা উল্লেখ করে এমসিসিআই নেতারা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে যেভাবে কম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে, সে পদ্ধতি অনুসরণেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন। টিসিবি সম্পর্কে এ রকম বহু প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। চার দশকের পুরনো একসময়ের অধিকতর কার্যকর প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে আবার আপৎকালীন নিত্যপণ্যের বাজারে হস্তক্ষেপের উপযোগী করে গড়ে তোলার সরকারি ঘোষণা কেন অকার্যকর, তা-ও রহস্যে ঘেরা। ১১ জুন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, গত এক বছরে এক হাজার কোটি টাকা চেয়ে যে টিসিবি কোনো পয়সা পায়নি, সেই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় শুনিয়েছেন। আমরা জানি না, এই বৈপরীত্যের অবসান কিভাবে ঘটবে এবং প্রকৃতপক্ষে টিসিবি কেমন করে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ অবস্থায় 'মার্কেট ইন্টারভেনশনে' টিসিবির পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখা কঠিন। তা ছাড়া টিসিবিতে কর্মরত বর্তমানে যে সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, তাঁদের দিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি তাঁদের অনেকেরই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। এখানেও রয়েছে অশুভ সিন্ডিকেটের প্রভাব। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশবলে জনকল্যাণকর টিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম দেওয়া হয়েছিল, দীর্ঘ ৪০ বছরেও এ সংস্থার আইন ও বিধিমালা যুগোপযোগী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; অথচ এ সংস্থাটিকে দিয়েই সরকার বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কাজ করার কথা বলছে। এই স্ববিরোধিতা কারো জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে না। ১৭ জুন একটি দৈনিকে প্রকাশ, খুলনা মহানগরীসহ ১৪টি জেলায় ২০ জুন থেকে টিসিবির কার্যক্রম নতুন করে শুরু হচ্ছে। টিসিবিকে যে অবস্থায় রেখে এই কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়ছে, এর ফল কতটা আশাব্যঞ্জক হবে_তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
টিসিবিকে সরকার কিভাবে কার্যকর করবে কিংবা সরকার আসলে কী করতে চায়, তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। যে টিসিবিকে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, বহু বছর অনাদর ও অবহেলায় তা পঙ্গুপ্রায়। তাই সেই অবকাঠামো কিভাবে অল্প সময়ে পুনর্গঠন করা হবে, আগে তা ঠিক করাই শ্রেয়। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম অসতর্কতা না থাকে। বাজারে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সমান্তরালে টিসিবি কিভাবে নিশ্চয়তার কাজ করবে, তাও দেখতে হবে। বাজার কিংবা সরকারের একচেটিয়াপনার দুই বিপরীত পথের মধ্যে মধ্যপন্থা হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে এর আগে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা করা হলেও এর যথেষ্ট সুফল পরিলক্ষিত হয়নি। যদিও ব্যবস্থাটি ছিল সরকারি হস্তক্ষেপহীন মুক্তবাজার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সামান্য হলেও একটি নতুন চিন্তা। বাজার তার নিজস্ব নিয়মে চলবে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার মুখে মানুষ যাতে অসহায় হয়ে না পড়ে তার জন্য সরকারের হাতেও কিছু রক্ষাকবচ থাকা দরকার। একে বলা যায় বাজারের খামখেয়ালি কিংবা গোষ্ঠীবিশেষের অতিমুনাফার ক্ষতিকারকতার বিরুদ্ধে সরকারি বাঁধ। মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারভুক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে এক নম্বর হলো সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং টিসিবিকে শক্তিশালী করা। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। আর টিসিবির ব্যাপারে একের পর এক শুধু সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে কোনো অগ্রগতি নেই।
টিসিবির দুরবস্থা অগ্রহণযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যখন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ওঠে, তখন সেই সংস্থার থাকা না থাকা মানুষের কাছে সমান হয়ে পড়ে। টিসিবির অবস্থা হয়েছে সে রকম। না আছে লোকবল, না আছে কাজ করার ক্ষমতা। টিসিবির নিকট-অতীতের কিছু কর্মকাণ্ড হাস্যকর ঠেকেছিল। যেমন বাজারে যখন ডালের দাম কম ছিল তখন বেশি দাম দিয়ে ডাল কিনেছিল টিসিবি। আর ওই কাজে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছিল এবং সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল। এ রকম আরো অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অপচয় বাড়ছে। বর্তমান বাজারব্যবস্থার যে লাগামহীন অবস্থা, তাতে টিসিবিকে কার্যকর করে পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া সম্ভব_এ কথা বাজার বিশ্লেষকদের তরফে বারবার উচ্চারিত হলেও তা ফলদায়ক হয়নি। মূল কথা হলো, টিসিবির অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ভাঙাচোরা ঘরের মতো। অথচ এই টিসিবিই একসময় দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ওষুধ, টেঙ্টাইলসহ ৬৩টি পণ্য আমদানি করা হয়েছিল টিসিবির মাধ্যমে। সেই অর্থবছরে মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ টিসিবির মাধ্যমে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে চারদলীয় জোট সরকার টিসিবির আকার আরো ছোট করে ফেলে। এর পেছনেও অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেছিল।
গত ১০ জুন রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আসন্ন রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম না বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলেছেন, তাঁরা রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়াবেন না। কিন্তু এর মাত্র চার দিন পর ভোজ্য তেল নিয়ে আবার তেলেসমাতি হলো। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীকে আরো আশ্বাস দিয়েছিলেন, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য তাঁরা সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ রকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি উভয় তরফ থেকে বারবার ব্যক্ত হলেও কার্যত ফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দাঁড় করিয়ে মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ভোক্তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমদানি করা যেসব পণ্যদ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল, অভ্যন্তরীণ বাজারে সেসবেরও দাম ঊর্ধ্বমুখী পরিলক্ষিত হয়েছে। এখানেই মহলবিশেষের কারসাজির ব্যাপারটি প্রকট হয়ে ওঠে। সরবরাহ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, তদারকি_সব কিছু মিলিয়ে জনবিড়ম্বনার অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজার। এই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কতটা সক্ষম-এ প্রশ্ন সংগত কারণেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com
No comments