কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ করা উচিত by বিল রিচার্ডসন ও মিকি বার্গম্যান
যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সাক্ষাতের
পরিকল্পনা করছেন- এ খবর প্রথমে একটি কূটনৈতিক ভূমিকম্প মনে হয়েছে। কিন্তু
ঘোষণাটির একদিনেরও কম সময়ের পরই সাক্ষাৎটি ঘটার জন্য কী কী বাধা দূর করতে
হতে পারে, তার পরস্পরবিরোধী বিবৃতি পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর
কোরিয়ার মাঝে সম্ভাব্য প্রথম বৈঠক হওয়ার মূল পয়েন্ট- ওয়াশিংটনের দাবি
পিয়ংইয়ংকে পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে এবং পিয়ংইংয়ের দাবি ওয়াশিংটনকে
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সেনা সরিয়ে নিতে হবে, কয়েক বছরের মধ্যে দু’পক্ষের
পারস্পরিক এসব দাবিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কোনো পক্ষই নিজেদের দাবি থেকে
সরে এসে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক, কিমের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করতে হবে ট্রাম্পকে। একটি মূল্যবান চুক্তি হতে পারে- এমন ভাবনা দুই
নেতাকেই উৎসাহিত করতে পারে। পিয়ংচাং অলিম্পিকের আগে ও পরে দক্ষিণ কোরিয়ার
প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন প্রতিপক্ষ কিমকে নিজেদের মিত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর যে
ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা মূল্যবান বিষয় হিসেবেই বিবেচ্য। উত্তর কোরিয়ার হাতে
বন্দি তিন মার্কিন নাগরিককে মুক্তির জন্য চাপ দিতে এটি একটি ভালো সুযোগ।
একইসঙ্গে শিরোনাম থেকে ধূসর হয়ে যাওয়া ইস্যু- কোরিয়া যুদ্ধে নিহত আমাদের
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার জন্য কয়েক দশকের প্রচেষ্টাকে
আবারও আলোচনায় আনার বড় সুযোগ হতে পারে এটি। অবশ্য, প্রেসিডেন্ট যদি সেভাবে
অগ্রসর হন, তবে কঠিন একটি কূটনৈতিক প্রকল্পের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে
বিষয়টিকে তার মূল্যায়ন করতে হবে; নিজের অতিরঞ্জিত ফটোসেশন হিসেবে নয়। এক
বছরের মাত্র কিছু বেশি সময়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প এবং আমাদের দক্ষিণ
কোরীয় মিত্র কূটনৈতিক রোলার কোস্টারের ওপর আমাদের চড়িয়েছেন- আগস্ট মাসে
ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে অক্টোবর মাসে কিমকে ‘ক্ষুদ্র রকেট মানব’
বলে টুইট, ফেব্রুয়ারিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতের
উত্তর কোরীয় প্রস্তাব (দক্ষিণ কোরিয়ার মাধ্যমে) এবং ট্রাম্পের তা গ্রহণ।
তিনি আমাদের বিশ্বাস করাচ্ছেন যে, তিনি বরাবর এমন থ্রিডি দাবা খেলছেন, যা
চাল চেলেও কেউ কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার নেতারা সবসময়
এমন একটি প্রার্থনা করে আসছেন- তাদের নেতা এবং একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট
মুখোমুখি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন। কিমকে এখন নিশ্চিতভাবে সাহসী বলুন এবং
ট্রাম্পকে দিন শক্তি ও সাহসের ক্রেডিট; কিন্তু এটি উত্তর কোরিয়ার মূল
দরকষাকষিকে পাল্টে ফেলবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানে তিনি যে পথে
আছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচিত হবে না জ্বালাময়ী বিবৃতি দিয়ে এবং
অপরিপক্ব বুক চাপড়ে প্রক্রিয়াটিকে লাইনচ্যুৎ করা। তার প্রয়োজন একটি অভিজ্ঞ ও
আন্তরিক আলোচক দল, যাতে থাকবে তার একান্ত বৃত্তের বাইরের বিশেষজ্ঞরাও।
ট্রাম্প নিজেকে অতুলনীয় একজন আলোচক ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কল্পনা করেন।
কিন্তু হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা থেকে আমরা তাকে বলতে পারি, উত্তর কোরিয়ার আলোচক ও
মধ্যস্থতাকারীরা খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও উচ্চমাত্রার খোঁজখবর নিয়ে
আসবেন। কথার মাঝে আপনি যদি একটি বাজে
শব্দও ব্যবহার করেন, আলোচনায় বড় ধরনের
মোড় ঘুরে যেতে পারে। প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতা খুবই প্রয়োজন। ১৯৯০-এর দশকে
আমাদেরই একজন (তখনকার কংগ্রেস সদস্য রিচার্ডসন) ছিলেন বেসরকারি দূত, তার
প্রতিনিধি দল উত্তর কোরিয়ার প্রতিপক্ষকে আলোচনায় ফেরাতে উৎসাহী করার জন্য
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনার সময় শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে খাদ্য
সহায়তার একটি অতিরিক্ত প্রস্তাব দেয়। উত্তর কোরিয়ানরা জনসমক্ষে তা
প্রত্যাখ্যান করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, তাদের খাদ্য সহায়তার দরকার নেই।
যদিও পরে নীরবে তা গ্রহণ করে তারা। দেখানোর জন্য তারা তৎক্ষণাৎ আলোচনা শুরু
করেন; কিন্তু তাতে আন্তরিকতা ছিল না। শেষ পর্যন্ত তখন কোনোকিছুই হয়নি এবং
অচলাবস্থার জন্য তারা আমাদেরই দায়ী করেছিল। এটি উত্তর কোরিয়ার ছলনার একটি
সাধারণ রূপ। ২০১৬ সালে পিয়ংইয়ংয়ে অটো ওয়ার্মবিয়ারের পরিবারের পক্ষ থেকে
মধ্যস্থতাকালে আমাদের অন্য একজন- বার্গম্যান অটোকে বাসায় নেয়ার একটি
প্রস্তাবে কোরীয় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে একেবারে মুখের ওপর ‘না’ শুনেছেন।
কিছুক্ষণ পরই অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনের সময় তার প্রতিপক্ষের একজন বলেন,
‘কোরিয়ায় একটি প্রবাদ আছে, একটি গাছ কাটার জন্য ১০০ কোপ দিতে হয়’। উত্তর
কোরিয়ানরা ধৈর্য ও ধীরস্থিরতার সঙ্গে দরকষাকষি করে। বিষয়টি ট্রাম্পকে মাথায়
রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া চুক্তির পরিকল্পনা অপরিবর্তনীয় ও
সম্পূর্ণ জটিল রয়ে গেছে। কিম জং উন তার সঙ্গে চোরের ওপর বাটপারি করেছেন-
ট্রাম্প যদি এমনটি দেখতে না চান তবে তাকে বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে
ধীরস্থিরভাবে ও যত্নসহকারে হাতুড়ি মারতে হবে। যাতে করে ভালোভাবে যাচাই করে
একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে পৌঁছা যায়। তিনি এটি করার আগে যে বিষয়গুলো
আমাদের বিবেচনা করতে হবে সেগুলো হল- প্রথমত, ট্রাম্পকে নতুন ‘গাজর ও লাঠি’
তৈরি করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তিনি লাঠি দিয়েছেন এবং দুই রাষ্ট্রপ্রধানের
মুখোমুখি বৈঠকের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ভালো গাজরও দেখিয়েছেন। হোয়াইট
হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ হুকাবি স্যান্ডার্স শুক্রবার বলেছেন,
ট্রাম্প একেবারে ‘জিরো ছাড়’ দিয়েছেন; কিন্তু সাক্ষাতের জন্য একমত হওয়া একটি
ছাড়। যতক্ষণ কিমকে এই বসন্তে গলফ খেলার জন্য আমন্ত্রণ করা না হচ্ছে,
ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রাম্পকে ছাড়ের গাজর ঝুলিয়ে রাখতে হবে উত্তর কোরিয়ার নেতার
সামনে। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পকে এটা বুঝতে হবে যে, উত্তর কোরিয়ানরা নিজেদের
পরমাণু অস্ত্রহীন করার প্রস্তাব দিচ্ছে না। তাদের এবং তাদের প্রশাসন
পরিবর্তনের মাঝে একমাত্র জিনিস হিসেবে নিজেদের অস্ত্রের সক্ষমতাকেই বিবেচনা
করে তারা। তারা নিজেদের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প স্থগিত রাখার
প্রস্তাব দিচ্ছে; কিন্তু নিজেদের অস্ত্রাগারকে অস্ত্রশূন্য করার বিষয় ভাবছে
না কোরিয়ানরা। এটিই কয়েকদিন থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান এবং
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি পর্যালোচনার ট্রাম্পের লক্ষ্য উত্তর কোরিয়ার
অবস্থানকে কেবল দৃঢ়ই করেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল যদি আমেরিকানরা একটি
চুক্তি স্বাক্ষর করেও ফেলে, আমরা তাতে আশ্বস্ত হতে পারি না। ফলে আমাদের সব
পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করা বিচক্ষণতার কাজ হবে না। তৃতীয়ত, ট্রাম্পকে
অবশ্যই স্পষ্ট হতে হবে যে, উত্তর কোরিয়ানরা এখন পর্যন্ত যা চায় তা হল, যে
কোনো চুক্তির অংশ হিসেবে কোরীয় উপদ্বীপ থেকে আমাদের ৩৮ হাজার সেনা সরিয়ে
নেয়া। বৈরিতা ১৯৫৩ সালেই কোরিয়া যুদ্ধের বিরতির মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারত;
কিন্তু টেকনিক্যালি যুদ্ধই তো শেষ হয়নি এবং উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভুলে যায়নি
ওই যুদ্ধে ৪০ লাখের বেশি কোরিয়ান নিহত হয়েছেন। আমাদের জন্য উত্তর কোরিয়া
হল বিশ্বের অনেকগুলো ফোকাল পয়েন্টের একটি। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার বেলায়
আমরাই একমাত্র তাদের লক্ষ্যবস্তু এবং তাদের নিরাপত্তা কৌশলে মূল বিষয়
হিসেবে থেকে গেছি আমরা। যে চুক্তিটি এখন আলোচনার টেবিলে আছে এবং অনেক সময়
ধরে পড়ে আছে তা হল- উত্তর কোরিয়া তাদের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প
স্থগিত করবে এবং স্বীকৃত প্রশাসনের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে তা প্রত্যায়িত হবে।
বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র কিছু সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেবে, অর্থনৈতিক
বিধিনিষেধ শিথিল করবে এবং স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে একটি
চুক্তি স্বাক্ষর করবে। যে কোনো চুক্তিতে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানের
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে উত্তর কোরিয়া ওই তিন দেশ থেকে পিয়ংইয়ংয়ে খাবার,
জ্বালানি ও প্রযুক্তি সরবরাহের বিনিময়ে। ট্রাম্প যা চাচ্ছেন তার সবকিছু এটি
নয়; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তা তুলনামূলক ভালো।
নিশ্চিতভাবে এটি সম্ভাব্য একটি সরাসরি যুদ্ধ থেকে আমাদের পেছনে সরিয়ে নিতে
পারে। সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বৃহস্পতিবার উত্তর কোরিয়ার নেতাদের সতর্ক করে
দিয়ে বলেছেন, যদি তারা ট্রাম্পকে নিয়ে ‘খেলতে চান’ তা হবে ‘আপনাদের
প্রশাসনের শেষ পরিণতি’। কিন্তু প্রত্যেকেরই শেষ লক্ষ্য সামরিক পথ, যা কিনা
একটি মারাত্মক বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। ট্রাম্প নিয়মিতভাবে পেছন দিক থেকে
খোঁচা মেরে আসছেন। উত্তর কোরিয়ানদের ক্ষেত্রে এটি একটি বাজে কাজ। তাকে
সচেতন হতে হবে, এতে আমেরিকার নিরাপত্তার বিষয় কতটুকু আছে তা নিয়ে চিন্তা
করতে হবে। নিজের ভালো ইমেজ তৈরির বিষয়ে তাকে কম মনোযোগী হতে হবে।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
বিল রিচার্ডসন : নিউ মেক্সিকোর সাবেক গভর্নর এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দূত
মিকি বার্গম্যান : রিচার্ডসন সেন্টার ফর গ্লোবাল এনগেজমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
বিল রিচার্ডসন : নিউ মেক্সিকোর সাবেক গভর্নর এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দূত
মিকি বার্গম্যান : রিচার্ডসন সেন্টার ফর গ্লোবাল এনগেজমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট
No comments