‘খোদা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন’
‘খোদা
আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমার কাজ কিছু হয়তো বাকি ছিল, সে কাজটুকু করার
জন্য খোদা আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন।’ দীর্ঘ ১১ দিন চিকিৎসা শেষে নিজের
কর্মস্থল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এ কথাগুলো বলে
নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড: মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, ‘যে আমাকে ছুরি দিয়ে হামলা করেছিল তার ওপর আমার কোন রাগ নেই
প্রতিহিংসা নেই। বরং তার প্রতি আমার এক ধরনের মায়া হচ্ছে করুণা হচ্ছে। তার
মাথায় হয়তো এটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, আমাকে মেরে ফেলতে পারলেই সে
বেহেস্তে চলে যাবে।’ বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে
আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘সাদাসিধে কথা’য় তিনি এসব কথা বলেন। এসময় মঞ্চে তার স্ত্রী
অধ্যাপক ড: ইয়াসমীন হক ও ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাকে যে মারতে চেয়েছিল সে হয়তো একা নয়। তার মতো
এরকম অনেকেই আছে। হয়তো এখানেই আশেপাশে কেউ আছে যে আরেকবার একটা এটেম্পট
নিতে চাইবে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তোমাদের মধ্যে যদি কোন
বিভ্রান্তি থাকে তোমরা প্লিজ আমার সাথে এসে দেখা করো, কথা বলো। আমি জানতে
চাই তোমাদের মনে কিসের এতো কষ্ট।’ হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তোমরা
আমাকে নাস্তিক বলো। আমি পবিত্র কোরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খুবই
মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সেখানে এরকম একটা আয়াত আছে, যে একজন মানুষকে হত্যা করলো
সে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলো। কেউ যদি এই আয়াতটা পড়ে তাহলে সে কিভাবে
একজন মানুষকে মারতে চাইবে? আরও বলা হয়েছে, যে মানুষকে বাঁচালো সে পুরো
মানবজাতিকেই বাঁচালো।’ তিনি বলেন, যারা হামলার পর থেকে আমার জন্য অনেক
খেটেছেন, কষ্ট করেছেন তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই। সিলেটের ওসমানী মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল ও সিএমএইচের চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাফর ইকবাল।
তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনী
দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখনকার সেনাবহিনী দেশকে সামনের দিকে
এগিয়ে নিয়ে যাবে আমার বিশ্বাস। বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধকে অন্তরে ধারণ
করে। তাদের অনেক সৈনিক, অফিসারের সাথে আমার আলাপ হয়েছে এ কয়দিনে। অধ্যাপক
জাফর ইকবাল তার বক্তব্যে ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষকদের
পেটানোর ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ঐদিনের পর থেকে আমি ও তোমাদের ম্যাডাম
(ইয়াসমিন হক) সবকিছু থেকে নিজেদের গুঁটিয়ে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যেখানে
ছাত্ররা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে সেখানে আর কোনকিছুতে যাব না। কিন্তু আজ
থেকে আমি তোমাদের সবকিছুতে থাকব, সকল অনুষ্ঠানে আমরা যাব।’
এর আগে বক্তব্য
রাখেন ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে অধ্যাপক
জাফর ইকবাল আমাদের মাঝে বেঁচে ফিরেছেন। অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপর হামলা
হয়েছিল কারণ তিনি সবসময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, মুক্তচিন্তা করেন। তার উপর
হামলা করে তার মুখ স্থব্ধ করে দিতে চেয়েছিল ওরা। অধ্যাপক জাফর ইকবালের
চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বাত্মক সাহায্য করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান
অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হক। তিনি বলেন, এর আগেও অনেক মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী,
সাহিত্যিক, দার্শনিকদের উপর হামলা হয়েছিল। তারা আর বেঁচে ফেরেননি। কিন্তু
আমরা জাফর ইকবালকে ফেরত পেয়েছি। তিনি সহযোগীতার জন্য সকল শিক্ষক,
শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এছাড়াও
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড: ইলিয়াস
উদ্দিন বিশ্বাস, প্রবীন সাংবাদিক আবেদ খান, সিএসই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক
ড. রেজা সেলিম. আয়শা তাসনিম, শিক্ষার্থী, ইয়াসের সরকার, ফয়সল আহমেদ,
শাহজাদী নওরীন প্রমুখ। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার
পরই বুধবার বেলা ১টায় বিমানযোগে সিলেটে এসে পৌঁছান অধ্যাপক জাফর ইকবাল।
সেখান থেকে বেলা দেড়টায় প্রথমে নিজের কোয়ার্টারে ও পরে বিকাল সাড়ে ৪টায়
ক্যম্পাসের মুক্তমঞ্চে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসে পৌঁছান।
উল্লেখ্য, গত ৩ মার্চ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ইলেকট্রিকাল
অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের ফেস্টিভাল চলাকালীন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর
ইকবালের মাথায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে এক তরুণ। অধ্যাপক ইকবালকে গুরুতর
আহত অবস্থায় প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উন্নত
চিকিৎসার জন্য ঢাকার সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। হামলার সময় ফয়জুর (২৪) নামের
হামলাকারীকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে শিক্ষার্থীরা।
হামলাকারী ফয়জুর, তার ভাই, বাবা-মা ও এক মামাকে বর্তমানে রিমান্ডে নিয়ে
জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
No comments