যে পথে রচিত হলো মহারাষ্ট্রের কৃষকদের অনন্য ইতিহাস by রমজান আলী
৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ সোচ্চার হয়েছিল দাবির লড়াইয়ে |
১৩
দফা দাবি নিয়ে কৃষকরা জেগে উঠেছিল রক্তিম আভার মতো। তাদের পা থেকে ঝরা
রক্তের ছোপ রাঙিয়ে দিয়ে গেছে নাসিক থেকে মুম্বাই-এর সুদীর্ঘ ১৮০ কিলোমিটার
পথ। ‘রুশ বিপ্লব’ এবং এর পরবর্তী সময়ের নেতৃত্বকে আদর্শ মেনে মিছিলে
আদিবাসী নারী-পুরুষেরা ধ্বনি তুলেছেন ‘আমিই লেনিন কিংবা আমিই স্ট্যালিন’
বলে। তবে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগের প্রেরণাকেই তারা রেখেছিলেন হৃদয়ে।
অভাবনীয় অদম্য প্রতিরোধের শক্তিকে সঙ্গী করে তারা হেঁটেছেন দাবি আদায়ের
মিছিলে। বুঝতে চেয়েছেন অপরের বেদনা। চাকচিক্যের মুম্বাই শহরের অগণিত মানুষ
তাই পৃষ্পবৃষ্টিতে সাদর অভ্যার্থনা জানায় তাদের। তৃষ্ণা আর অভূক্ত জীবনের
ধারাবাহিকতা ঘোচে ছাত্রদের তুলে দেওয়া জল কিংবা বিস্কুটের প্যাকেটে। এলিট
পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সংবাদমাধ্যমগুলোও তাই বদলে যায় মুহূর্তেই।
কালেভদ্রে সেখানে জায়গা পাওয়া কৃষকরা হয়ে ওঠে প্রধান খবর। এক পর্যায়ে সব
দাবি মানতে বাধ্য হয় বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার।
কোনও ভাঙচুর সহিসতা রক্তপাত নেই, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় তাদের সমস্ত দাবি মেনে নিতে। কী করে এমন অনন্য ইতিহাস রচনা করলেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা? ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের বিপন্নতার গভীরতা, আন্দোলনের অহিংস ও সুসংগঠিত প্রকৃতি এবং অন্য মানুষদের বিপন্নতার প্রতি আন্দোলনরত কৃষকদের দৃর্দান্ত মনযোগই ছিল এই বিজয়ের নেপথ্য কারণ।
কোনও ভাঙচুর সহিসতা রক্তপাত নেই, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় তাদের সমস্ত দাবি মেনে নিতে। কী করে এমন অনন্য ইতিহাস রচনা করলেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা? ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের বিপন্নতার গভীরতা, আন্দোলনের অহিংস ও সুসংগঠিত প্রকৃতি এবং অন্য মানুষদের বিপন্নতার প্রতি আন্দোলনরত কৃষকদের দৃর্দান্ত মনযোগই ছিল এই বিজয়ের নেপথ্য কারণ।
দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নারী-পুরুষ হেঁটেছেন পরস্পরের সহযাত্রী হয়ে |
সারাবিশ্বেই কৃষকরা বিপন্ন। তবে ভারতে এই বিপন্নতা অন্য অনেকের চেয়েই গভীর। ক্ষুদ্র কৃষকেরা সেখানে বাস করছেন দুর্যোগের কিনারায়। মহারাষ্ট্র সেই বিপন্নতার এক জীবন্ত দলিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র খড়া, বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা, করপোরেট বাজার ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে টিকতে না পারায় সেখানে আত্মহত্যা যেন এক রাজ্যটিতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ২৫ হাজারের বেশি কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। রাজ্য সরকার এ সংকট নিরসনের কয়েক দফা সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা তেমন কোনও কাজে আসেনি। গত বছরের জুন মাসেও কৃষকরা ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার পর তাদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) সঙ্গে যুক্ত অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা (এআইকেএস) দেশটির অন্যতম বড় ও প্রভাবশালী কৃষক সংগঠন। মুম্বাইয়ের উদ্দেশে এই লং মার্চের সংগঠকও এই এআইকেএস। সংগঠনের সভাপতি ড. অশোক ধবল বলেন, ‘এই আন্দোলন কৃষকদের সঙ্গে বিজেপি সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।’ তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, ‘শুধু রাজ্য সরকারের ওপর দায় চাপানো বাদ দিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকারকেও বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’
কৃষকদের দাবির কেন্দ্রে ছিল, কৃষকদের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ ঋণ মওকুফ করা, বনাঞ্চলে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের দখলকৃত জমির ওপর বৈধ অধিকার সুরক্ষায় ২০০৬ সালে প্রণীত বন অধিকার আইনের বাস্তবায়ন এবং এস সোয়ামিনাঠান কমিশনের ২০০৬ সালের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। ওই সুপারিশমালায় জমির মালিকানায় ভারসাম্য আনা, কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও কৃষক পরিবারকে একটি স্থিতিশীল জীবীকার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
আত্মহত্যা যেন মহারাষ্ট্রের কৃষকদের জন্য উৎসব |
সোমবার দুপুরে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভার ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের সঙ্গে দেখা করেন।ভারতের সেচমন্ত্রী গিরিশ মহাজন বলেন, সরকার তাদের সব দাবি পূরণ করতে রাজি হয়েছে।বৈঠকটিকে কৃষকরা তাদের বিজয় হিসেবে দেখছেন।
অতীতে এমন শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সমাজের অন্যান্যদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে নিজেদের দাবি আদায়ের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুব একটা নেই৷ দেশজুড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে৷ তাই পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য দিনের বেলায় পথ দখল না করে আজাদ ময়দানে রাত কাটান কৃষকরা৷ তারপর সারারাত ধরে পথ হাঁটা৷ গরিব, নিপীড়িত কৃষকদের এই সামাজিক চেতনা দেখে অভিভুত মুম্বইবাসীও৷ রক্তঝরা পা-গুলোর সেবাযত্ন করতে এগিয়ে এলো অর্ধেক মুম্বই৷
সে এক অদ্ভুত দৃশ্য৷ আইআইটি বম্বের ছাত্ররা সেখানে আন্দোলনকারী কৃষকদের জন্য খাবার দাবার নিয়ে হাজির হলেন৷ কৃষকদের জন্য জুতো নিয়ে হাজির হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷
মুম্বাইয়ের লঙ মার্চে নিজে অংশ নিয়েছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক পি সাইনাথ বলছেন, সব কিছু তুচ্ছ করে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেন কৃষকরা। চারপাশের মানুষকে কৃষক সমাজের মন্ত্রণার হদিশ দিলেন। এতেই তাদের আবেগের গভীরতা ধরা পড়ে। ধরা যায় তাদের বিপন্নতাও। এদিকে আবার আন্দোলনকারী কৃষকদের পাশে সব রকম ভাবে দাঁড়িয়েছে মুম্বাইবাসী।
বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে অনন্য ইতিহাস রচনা করলেন কৃষকরা |
বিশিষ্ট সাংবাদিক ভোলানাথ ঘোড়ই মনে করছেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের লং-মার্চ সারা পৃথিবীকে আন্দোলন শিখিয়ে দিলো৷ খুব সম্প্রতি ভারতে কিছুটা রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন হয়েছে৷ তারপর বামপন্থা ধ্বংস হয়ে গেল, মন একটা প্রচার চলছিল৷ অন্যদিকে, গত কয়েক বছর ধরে অতি ডানপন্থি শক্তি অর্থবলের সঙ্গে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা চলছে৷ কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেল, প্রকৃত ক্ষিদের আন্দোলন হলে সাম্প্রদায়িকতা বানের জলের মতো ভেসে যায়৷''
No comments