রোহিঙ্গাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ
রোহিঙ্গাদের
হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে
দেয়াসহ সব ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। রাখাইন
রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এসব জঘন্য
অপরাধ সংঘটিত করা হয়েছে, প্রমাণিত হলে যা হবে গণহত্যা- জাতিসংঘের আন্ডার
সেক্রেটারি জেনারেল এবং মহাসচিবের গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক উপদেষ্টা অ্যাডামা
ডাইয়েং এসব কথা বলেছেন। তার সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায়, কেবল ধর্মের ভিন্নতার
কারণে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছে মিয়ানমার
এবং এখনও তাদের সে চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক
সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশগুলো যদি মিয়ানমারের সামরিক
বাহিনীর ঘৃণ্য এ চক্রান্ত বন্ধে এখনও এগিয়ে না আসে, তবে বিশ্বের সবচেয়ে
নিপীড়িত জাতিটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার দায় এড়াতে পারবে না তারা। যে কোনো
অপরাধের ক্ষেত্রে যদি দায়ীকে বিচারের মুখোমুখি করা না হয়, তবে দ্বিগুণ
উৎসাহে তারা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। মিয়ানমারের
সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। কাজেই আর বিলম্ব না করে
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বাংলাদেশে পালিয়ে
আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ কফি আনান কমিশনের সুপারিশের আলোকে সব
সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের নিজেদের বাস্তুভিটায় ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে
হবে। কেবল রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্যই নয়, ভবিষ্যতে কোনো দেশ যেন এ ধরনের
মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার সাহস না পায়, তা নিশ্চিত করার জন্যও
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাঁড় করানোসহ
প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এগিয়ে আসতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক, কথিত সন্ত্রাসের অজুহাতে মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে
নিশ্চিহ্ন করার খেলায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ঘরের ভেতরে রেখে তালা মেরে
আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং গোটা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়,
তখনও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার
জুজু তুলে তাদের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে দুই
প্রতিবেশী দেশ- চীন ও ভারত। ফলে মিয়ানমার বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাপকে
আমলে না নিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো গল্প ফেঁদেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক
উপদেষ্টার বক্তব্যের পর চীন, ভারত ও রাশিয়ার উচিত হবে মিয়ানমারের ওপর চাপ
প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখা। নিজেদের নানা সীমাবদ্ধতা
সত্ত্বেও এবং রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির পেছনে কোনো ধরনের দায় না থাকার পরও দশ
লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাসীকে মনে রাখতে
হবে, একটি দেশের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে এ বোঝা টানা সম্ভব নয়। অ্যাডামা
ডাইয়েংয়ের মতো আমাদেরও বিশ্বাস, সময়মতো বিশ্ববাসী কঠোর হলে রোহিঙ্গাদের ওপর
অমানুষিক নির্যাতন বন্ধ করা যেত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমান সময়েও
কিছু দেশ বাণিজ্যিক স্বার্থকে মানবতার ওপর স্থান দিচ্ছে। অতীতের অবস্থান
থেকে সরে এসে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা ও দেশগুলো গণহত্যার মতো
অপরাধে জড়িতদের জবাবদিহিতা এবং রোহিঙ্গাদের সব ধরনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত
করে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিলে তবেই তারা মানবতার
পক্ষে আছে বলা যাবে, অন্যথায় নয়।
No comments