তিন উপনির্বাচনেই ভরাডুবি বিজেপির, ধরাশায়ী যোগীর গোরক্ষপুরেও
তিনটি
উপনির্বাচন। তাতে সরকার পরিবর্তনের কোনো শঙ্কা নেই। কিন্তু যেভাবে ফলাফল
নির্ধারিত হয়েছে, তাতে ভারতীয় রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা
দিয়েছে। সেইসাথে সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রশ্নেরও। ভারতের উত্তরপ্রদেশে তাহলে
মোদি ম্যাজিক বলে কিছুই ছিল না? নেহাৎ দুই প্রধান দল সমাজবাদী পার্টি ও
বহুজন সমাজ পার্টির মধ্যে ভোট বিভাজনের কারণেই লোকসভা ও বিধানসভা দুটি
নির্বাচনেই বিজেপির জয়জয়কার হয়েছে? নাকি চার বছরের মধ্যেই মোদি ম্যাজিক
উধাও? এবং মোদি ম্যাজিক এখন কাজ করছে না বিহারেও? মোদি সরকারের বিরুদ্ধে
ক্ষোভের প্রকাশ কি তীব্র আকার নিয়েছে? কারণ একের পর এক রাজ্যের
উপনির্বাচনেই বিজেপি লাগাতার হেরে চলেছে। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর, ফুলপুর
ও বিহারের আরারিয়া লোকসভা উপনির্বাচনে আজ বিজেপি গোহারা হেরে যাওয়ার পর
এই বহুবিধ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহলে। যেভাবে মোদির দল
পর্যুদস্ত হয়েছে জোটের কাছে, তারপর নরেন্দ্র মোদির একক জনপ্রিয়তা এবং
বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়েও তুমুল জল্পনা শুরু করেছে। আগামীদিনে মহাজোট অথবা
তৃতীয় ফ্রন্ট যাই হোক, সম্মিলিত বিরোধী জোটের কাছে বিজেপি যে হেরে যেতে
পারে এরকম আশার প্রমাণস্বরূপ বুধবারের ফলাফলকে সামনে রেখেই জোট সম্ভাবনা
আরও তীব্র হয়েছে। বুধবার প্রকাশিত ফলাফলে উত্তরপ্রদেশের দুটি লোকসভা আসনের
উপনির্বাচনেই বিজেপি প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। দুটি আসনই বিজেপির থেকে
ছিনিয়ে নিয়েছে সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির জোট।
একই চিত্র
বিহারেও। একটি লোকসভা এবং দুটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয়েছিল বিহারে।
তার মধ্যে দুটি আসনেই বিজেপি হেরে গিয়েছে। একটিমাত্র বিধানসভা আসনে জিতেছে
বিজেপি। ফলে পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনের পরিণাম বিপুল ধাক্কা দিয়েছে
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহকে। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের ফলাফলে বিজেপি
আতঙ্কিত। কারণ গোরক্ষপুরে বিজেপি ৩০ বছরে কোনো দিন পরাজিত হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোরক্ষপুরের এমপি ছিলেন এই সেদিনও।
গোরক্ষপুর মঠের আজও তিনি প্রধান মোহন্ত। সেই গোরক্ষপুর লোকসভা আসনই যে
হাতছাড়া হয়েছে তাই নয়, ওই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত গোরক্ষপুর শহর
কেন্দ্রটি ছাড়া বাকি চার বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপি প্রার্থী হেরে গিয়েছেন।
গোরক্ষপুর ছিল যোগী আদিত্যনাথের কাছে প্রেস্টিজ ফাইট। তিনি প্রচারে
বলেছিলেন, মনে রাখবেন এখানে যেই প্রার্থী হন আসল প্রার্থী আমিই। সেই
যোগীকে প্রত্যাখান করেছে তাঁর নিজের কেন্দ্র। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে আজকের
পরাজয় স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথের। ফুলপুরের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এখানে এমপি
ছিলেন উত্তরপ্রদেশের উপ মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির কেশবপ্রসাদ মৌর্য। ২০১৪ সালে
বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। উপমুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় আসনটি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সেই আসনে এবার জোটপ্রার্থী বিপুল মার্জিনে হারিয়ে দিয়েছে বিজেপিকে।
উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে খোদ মু্খ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীর আসনই যদি
বিজেপি রক্ষা করতে না পারে, তাহলে বাকি ৭৮টি আসনে সমাজবাদী ও বহুজন
সমাজবাদী পার্টির জোট হয়ে গেলে ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশের ফলাফল কী হবে ভেবে
আজ থেকেই আতঙ্কগ্রস্ত বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। বিহারের রাজনৈতিক সমীকরণও
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে গেল আজকের ফলাফলে। এখানে জেহানাবাদ বিধানসভা ও
আরারিয়া লোকসভা আসনে লালুপ্রসাদ যাদবের দল জয়ী হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট
করে। হেরে গিয়েছে এনডিএ। একমাত্র ভাবুয়া বিধানসভা আসনে জিতেছে বিজেপি। এই
ফলাফল থেকে সবথেকে বড় যে বার্তা এসেছে তা হল, লালুপ্রসাদ যাদব জেলবন্দি হয়ে
থাকলেও তার ভোটব্যাংক সামান্যতম চিড় ধরেনি। বরং তার পুত্র তেজস্বী যাদব
হয়ে উঠেছেন নতুন যাদবকুলপতি। এই জয় তারই নেতৃত্বে। আবার উল্টোদিকে সবথেকে
বিপাকে পড়তে চলেছেন নীতীশ কুমার। কারণ বিজেপি তাঁকে জোটে টেনে কোনও লাভই
করতে পারল না। ফলে নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ যথেষ্ট সংশয়াচ্ছন্ন।
কারণ এরপর লড়াই হবে তেজস্বী বনাম বিজেপির। নীতীশ গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছেন
ভোটমানচিত্রে। এবং বিজেপির কাছে উদ্বেগ হলো বিহারে লালুপ্রসাদ ও নীতীশ
কুমারের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করেও জয়ী হতে পারছে না তারা। বরং লালুপ্রসাদ
যাদবের দলের ভোট আরো বেড়েছে। সুতরাং ২০১৯ সালে দেশজুড়ে মহাজোট হলে, কিংবা
তৃতীয় ফ্রন্ট যে নরেন্দ্র মোদির কাছে বড়সড় চ্যালেঞ্জই হতে চলেছে তা নিয়ে
সন্দেহ নেই। তাহলে আজকের ফল দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা মন্তব্যই কি
সত্যি হবে? তিনি বলেছেন, এই হল শেষের শুরু! ফলাফলে আপ্লুত নেত্রী একাধিক
জাতীয় স্তরের নেতার সঙ্গে লোকসভা ভোটে শক্তিশালী জোট গড়া নিয়ে কথাও বলেন।
কিন্তু এসব ছাপিয়ে এই উপনির্বাচনের ফল মোদির কাছে অলক্ষ্যে বৃহত্তর যে
বিপদসঙ্কেত এনেছে সেটি লোকসভায় দলের একক গরিষ্ঠতা। উত্তরপ্রদেশে দুটি আসন
হারানোর পর এখন লোকসভায় বিজেপির একক শক্তি ২৭৪! একক গরিষ্ঠতার থেকে মাত্র
দুটি বেশি! সুতরাং বলাই বাহুল্য এবার শরিকদের চাপ, যা আরো বাড়তে চলেছে!
No comments