কাঠমান্ডু ট্র্যাজেডি: লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা
কাঠমান্ডুতে
ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের মরদেহ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা।
কিন্তু পুড়ে যাওয়ায় অনেকের লাশ চিহ্নিত করার সুযোগ না থাকায় ডিএনএ টেস্টের
প্রয়োজন হবে। এতে লাশ পেতে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া যাদের লাশ
চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মরদেহ নেপালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে দেশে নিয়ে আসা
হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া
দ্রুত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা
এনিয়ে কাজ করছেন। গতকাল কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে নির্দেশনা
দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ঘটনার পরের দিন ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ হতাহতদের
স্বজনদের কাঠমান্ডু নিয়ে যায়। তারা কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বজনের
সেবা করছেন। বাকিরা আছেন স্বজনের লাশ বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায়। কাঠমান্ডু
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিহতদের লাশ রাখা হলেও ময়নাতদন্ত ও তদন্তের
আনুষ্ঠানিকতার কারণে স্বজনরা এখনো লাশ দেখার সুযোগ পাননি। এদিকে আহতদের
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে আজ একটি চিকিৎসক দল নেপাল যাচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসাধীন
তিনজনকে নেপাল থেকে সিঙ্গাপুর নেয়ার কথা জানিয়েছে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ।
বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আজ সারা দেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের
ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এদিকে ওই দুর্ঘটনার কারণে সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে
দেশে ফিরে আসার পর গতকাল ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী
এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে মুখ্য সচিব
নজিবুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত বাংলাদেশিদের দেশে আনার ব্যবস্থা করা
হচ্ছে এবং আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন
ইউনিটের দক্ষ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি চিকিৎসা দল কাঠমান্ডুতে পাঠানোর
জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং মৃতদের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহের জন্য পুলিশের
একটি দলকেও নেপাল পাঠানো হচ্ছে। আহতরা যদি রাজি হন তাহলে তাদের আমাদের
বার্ন ইউনিটে এনেও চিকিৎসা দেয়া হবে। কারণ আমাদের বার্ন ইউনিটে খুবই উন্নত
চিকিৎসা হয়।
দুর্ঘটনায় নিহতদের সবার মরদেহ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস। গতকাল নেপালের একটি হাসপাতালে দুর্ঘটনায় হতাহতদের খোঁজ নিতে এসে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্ত শেষ করতে আরো চার দিন সময় লাগবে। তারপর তারা স্বজনদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে তথ্য নিশ্চিত করে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। মরদেহ ফেরত পাঠাতে পরে হয়তো আরো ২-১ দিন বেশি লাগতে পারে। পুড়ে যাওয়ার কারণে যাদের মরদেহ শনাক্ত করতে ডিএনএ মেলানোর দরকার তাদের ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানান তিনি। মাশফি বিনতে শামস সাংবাদিকদের বলেন, সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৮ জনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। মরদেহ শনাক্ত করার পর দেশে কীভাবে পাঠানো হবে তা নিয়ে নেপাল ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। নেপালে স্বজনদের খোঁজে যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে না- এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক হাসপাতালে থাকছেন। দূতাবাসেও একটি কো-অর্ডিনেশন সেন্টার খোলা হয়েছে।
নয় সদস্যের চিকিৎসক দল আজ নেপাল যাচ্ছেন: নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত চিকিৎসাধীন যাত্রীদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে সে দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসকদের একটি দল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) অধ্যাপক ডা. এনায়েতুল হক এই দলের সমন্বয় করছেন। বার্ন বিশেষজ্ঞসহ নয় সদস্যের দল আজ বেলা সাড়ে ১১টার বিমানে নেপাল যাওয়ার কথা রয়েছে বলে অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশি যাত্রীদের ১০ জন আহত অবস্থায় দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটের আইসিইউ’র (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পাঁচটি বেড নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য প্রস্তুত রাখা আছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। চিকিৎসক দলের একজন সদস্য বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. লুৎফর কাদের লেলিন মানবজমিনকে বলেন, তারা নেপালে গিয়ে আহতদের পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদেরকে কি সেখানে রেখে চিকিৎসা দেয়ার মতো পরিস্থিতি আছে কিনা দেখবেন। তিনি আরো জানান, আইসিইউতে রাখা রোগীদের অবস্থা বুঝে শিফট করতে হয়। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বার্ন রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা আমাদের অনেক বেশি। নেপালে ডা. শঙ্কর রায় নামে শুধু একজন বার্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের পরিচালক বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, আামদের বার্ন ইউনিট একটি প্রতিষ্ঠিত ইউনিট। নেপালে সেই সেটআপ নেই। আমাদের মানবিক দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের একটি দল সেখানে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং বার্ন ইউনিটের পাঁচটি আইসিইউ বেড নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য প্রস্তুত রাখা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য নেপালে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র বা বার্ন হাসপাতাল নেই। ঢামেক বার্ন ইনস্টিউটের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ তথ্য জানিয়ে বলেন, তাদের জানা মতে নেপালে ডা. শঙ্কর রায় নামে শুধু একজন (বার্ন চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, বার্ন বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসকদের একটি দল নেপালে যাবেন এবং তারা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পরিস্থিতি ঠিক করবেন। তখন ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইউএস-বাংলার জিএম (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আহত যাত্রীরা এখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কার কি অবস্থা এই মুহূর্তে ধরে ধরে বলা যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে কাঠমান্ডুতে বিমান বিধ্বস্তে আহত বাংলাদেশি রেজওয়ানুল হক শাওনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়া হবে। এছাড়া বাংলাদেশি শাহরীন আহমেদকেও উন্নত চিকিৎসা দিতে দেশে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তার পরিবার। আরেক বাংলাদেশি ইমরান কবিরেরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে অন্য দেশে পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ঢাকায় একটি গণমাধ্যম শাওনের পরিবারের সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, রেজওয়ানুল হক শাওনকে বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর নেয়া হতে পারে। এজন্য কাঠমান্ডুর হাসপাতালের ছাড়পত্রসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা চলছিল।
তালিকা অনুসারে আহতরা হলেন, শাহরিন আহমেদ, শাহীন ব্যাপারী, ইয়াকুব আলী, রেজওয়ানুল হক, মেহেদি হাসান, এমরানা কবীর হাসি, কবীর হোসেন, সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, শেখ রাশেদ রোবায়েত ও আলমুন নাহার অ্যানি। তাদের মধ্যে রেজওয়ানুল হক ওম হাসপাতালে ও ইয়াকুব আলী নরভিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকিরা আছেন কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজে (কেএমসি)।
তদন্তের পর ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ: নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সোমবার ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তে নিহত ও আহতদের বীমা এবং ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ এখনো নির্ধারণ হয়নি। বীমা প্রতিষ্ঠানের তদন্তের পর ক্ষতিপূরণ বা বীমার পাওনা নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে, তা সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। গতকাল এসব কথা জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম।
তবে দুর্ঘটনার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোহসীন জানান, নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত প্রত্যেকের পরিবার সর্বনিম্ন ২৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ পাবেন। বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী এই টাকা দেয়া হবে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিটি যাত্রীর বীমা করেছে। সে অনুযায়ী প্রতি যাত্রী ক্ষতিপূরণ হিসেবে বীমার এই টাকা পাবেন। একই বিষয়ে কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠান কেএম ডাফটারে আমাদের বীমা করা আছে। এই প্রতিষ্ঠানের লোকাল এজেন্ট সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। বীমা কোম্পানি তাদের তদন্ত শেষে আহত ও নিহতরা কে কত পাবেন তা নির্ধারিত হবে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তদন্তের পর পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পাওনা বা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
ঘটনার পর থেকে ইউএস-বাংলা কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতালে আহত বিমান যাত্রীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করছে। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে দুইজন চিকিৎসক নিয়ে যান। আগামী দু’একদিনের মধ্যে আরো ৭ সদস্যের একটি টিম তারা কাঠমান্ডু নিয়ে যাবে।
যেভাবে বাইরে এলো এটিসির কথোপকথন: কাঠমান্ডুর এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসির সঙ্গে সোমবার ভেঙে পড়া ইউএস-বাংলার বিমানটির পাইলটের কথোপকথন দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ইউটিউবে। ওই কথোপকথন রেকর্ড করা বা পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশ করে দেয়াটা বেআইনি। কিন্তু ভারতের অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা বলছেন, ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন বা আইটিইউ’র নির্দেশিকা ভেঙেই এ ধরনের কথোপকথন শোনা এবং রেকর্ডিং করা বহু দেশেই চলছে, ভারতেও চলছে। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ইউএস-বাংলার পাইলট আর কাঠমান্ডু এটিসির এই কথোপকথন এমন একটি ওয়েবসাইটে প্রথম দেয়া হয়েছিল যে সাইটে বিশ্বের বহু এটিসির সঙ্গেই পাইলটদের কথাবার্তার রেকর্ডিং পাওয়া যায়। ওই ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা নানা দেশে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেন এটিসি এবং পাইলটদের মধ্যে কথোপকথন শোনা এবং তা লাইভস্ট্রিমিং করার জন্য। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যামেচার রেডিও’র অধিকর্তা এস. রামমোহন বলেন, এটিসি এবং পাইলট কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে কথা বলছেন, এটা যদি কেউ জানতে পারে আর তার কাছে যদি ভিএইচএফ রেডিও যন্ত্রপাতি থাকে, তাহলে এই কথোপকথন শোনা এবং রেকর্ড করা সম্ভব।
ইউএস-বাংলার কাঠমান্ডু ফ্লাইট বন্ধ: কাঠমান্ডুতে আপাতত ফ্লাইট না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। বিমান সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যস্থাপক (জিএম) কামরুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা-কাঠমান্ডু-ঢাকা রুটে আমাদের ফ্লাইট পরিচালনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউএস-বাংলার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বহরে চারটি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এবং চারটি বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে। একটি বিধ্বস্ত হওয়ায় এখন তাদের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা সাতটি। কাঠমান্ডু ফ্লাইট আপাতত বন্ধ রাখলেও অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটগুলো স্বাভাবিকভাবেই চলছে বলে জানান কামরুল।
দুর্ঘটনায় নিহতদের সবার মরদেহ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস। গতকাল নেপালের একটি হাসপাতালে দুর্ঘটনায় হতাহতদের খোঁজ নিতে এসে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্ত শেষ করতে আরো চার দিন সময় লাগবে। তারপর তারা স্বজনদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে তথ্য নিশ্চিত করে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। মরদেহ ফেরত পাঠাতে পরে হয়তো আরো ২-১ দিন বেশি লাগতে পারে। পুড়ে যাওয়ার কারণে যাদের মরদেহ শনাক্ত করতে ডিএনএ মেলানোর দরকার তাদের ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানান তিনি। মাশফি বিনতে শামস সাংবাদিকদের বলেন, সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৮ জনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। মরদেহ শনাক্ত করার পর দেশে কীভাবে পাঠানো হবে তা নিয়ে নেপাল ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। নেপালে স্বজনদের খোঁজে যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের সহযোগিতা করা হচ্ছে না- এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক হাসপাতালে থাকছেন। দূতাবাসেও একটি কো-অর্ডিনেশন সেন্টার খোলা হয়েছে।
নয় সদস্যের চিকিৎসক দল আজ নেপাল যাচ্ছেন: নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত চিকিৎসাধীন যাত্রীদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে সে দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসকদের একটি দল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) অধ্যাপক ডা. এনায়েতুল হক এই দলের সমন্বয় করছেন। বার্ন বিশেষজ্ঞসহ নয় সদস্যের দল আজ বেলা সাড়ে ১১টার বিমানে নেপাল যাওয়ার কথা রয়েছে বলে অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশি যাত্রীদের ১০ জন আহত অবস্থায় দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটের আইসিইউ’র (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পাঁচটি বেড নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য প্রস্তুত রাখা আছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। চিকিৎসক দলের একজন সদস্য বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. লুৎফর কাদের লেলিন মানবজমিনকে বলেন, তারা নেপালে গিয়ে আহতদের পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদেরকে কি সেখানে রেখে চিকিৎসা দেয়ার মতো পরিস্থিতি আছে কিনা দেখবেন। তিনি আরো জানান, আইসিইউতে রাখা রোগীদের অবস্থা বুঝে শিফট করতে হয়। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বার্ন রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা আমাদের অনেক বেশি। নেপালে ডা. শঙ্কর রায় নামে শুধু একজন বার্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের পরিচালক বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, আামদের বার্ন ইউনিট একটি প্রতিষ্ঠিত ইউনিট। নেপালে সেই সেটআপ নেই। আমাদের মানবিক দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের একটি দল সেখানে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং বার্ন ইউনিটের পাঁচটি আইসিইউ বেড নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য প্রস্তুত রাখা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য নেপালে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র বা বার্ন হাসপাতাল নেই। ঢামেক বার্ন ইনস্টিউটের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ তথ্য জানিয়ে বলেন, তাদের জানা মতে নেপালে ডা. শঙ্কর রায় নামে শুধু একজন (বার্ন চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, বার্ন বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসকদের একটি দল নেপালে যাবেন এবং তারা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পরিস্থিতি ঠিক করবেন। তখন ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইউএস-বাংলার জিএম (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আহত যাত্রীরা এখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কার কি অবস্থা এই মুহূর্তে ধরে ধরে বলা যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে কাঠমান্ডুতে বিমান বিধ্বস্তে আহত বাংলাদেশি রেজওয়ানুল হক শাওনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেয়া হবে। এছাড়া বাংলাদেশি শাহরীন আহমেদকেও উন্নত চিকিৎসা দিতে দেশে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তার পরিবার। আরেক বাংলাদেশি ইমরান কবিরেরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে অন্য দেশে পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ঢাকায় একটি গণমাধ্যম শাওনের পরিবারের সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, রেজওয়ানুল হক শাওনকে বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর নেয়া হতে পারে। এজন্য কাঠমান্ডুর হাসপাতালের ছাড়পত্রসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা চলছিল।
তালিকা অনুসারে আহতরা হলেন, শাহরিন আহমেদ, শাহীন ব্যাপারী, ইয়াকুব আলী, রেজওয়ানুল হক, মেহেদি হাসান, এমরানা কবীর হাসি, কবীর হোসেন, সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, শেখ রাশেদ রোবায়েত ও আলমুন নাহার অ্যানি। তাদের মধ্যে রেজওয়ানুল হক ওম হাসপাতালে ও ইয়াকুব আলী নরভিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকিরা আছেন কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজে (কেএমসি)।
তদন্তের পর ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ: নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সোমবার ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তে নিহত ও আহতদের বীমা এবং ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ এখনো নির্ধারণ হয়নি। বীমা প্রতিষ্ঠানের তদন্তের পর ক্ষতিপূরণ বা বীমার পাওনা নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে, তা সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। গতকাল এসব কথা জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম।
তবে দুর্ঘটনার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোহসীন জানান, নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত প্রত্যেকের পরিবার সর্বনিম্ন ২৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ পাবেন। বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী এই টাকা দেয়া হবে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিটি যাত্রীর বীমা করেছে। সে অনুযায়ী প্রতি যাত্রী ক্ষতিপূরণ হিসেবে বীমার এই টাকা পাবেন। একই বিষয়ে কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠান কেএম ডাফটারে আমাদের বীমা করা আছে। এই প্রতিষ্ঠানের লোকাল এজেন্ট সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। বীমা কোম্পানি তাদের তদন্ত শেষে আহত ও নিহতরা কে কত পাবেন তা নির্ধারিত হবে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তদন্তের পর পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পাওনা বা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
ঘটনার পর থেকে ইউএস-বাংলা কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতালে আহত বিমান যাত্রীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করছে। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে দুইজন চিকিৎসক নিয়ে যান। আগামী দু’একদিনের মধ্যে আরো ৭ সদস্যের একটি টিম তারা কাঠমান্ডু নিয়ে যাবে।
যেভাবে বাইরে এলো এটিসির কথোপকথন: কাঠমান্ডুর এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসির সঙ্গে সোমবার ভেঙে পড়া ইউএস-বাংলার বিমানটির পাইলটের কথোপকথন দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ইউটিউবে। ওই কথোপকথন রেকর্ড করা বা পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশ করে দেয়াটা বেআইনি। কিন্তু ভারতের অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা বলছেন, ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন বা আইটিইউ’র নির্দেশিকা ভেঙেই এ ধরনের কথোপকথন শোনা এবং রেকর্ডিং করা বহু দেশেই চলছে, ভারতেও চলছে। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ইউএস-বাংলার পাইলট আর কাঠমান্ডু এটিসির এই কথোপকথন এমন একটি ওয়েবসাইটে প্রথম দেয়া হয়েছিল যে সাইটে বিশ্বের বহু এটিসির সঙ্গেই পাইলটদের কথাবার্তার রেকর্ডিং পাওয়া যায়। ওই ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা নানা দেশে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেন এটিসি এবং পাইলটদের মধ্যে কথোপকথন শোনা এবং তা লাইভস্ট্রিমিং করার জন্য। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যামেচার রেডিও’র অধিকর্তা এস. রামমোহন বলেন, এটিসি এবং পাইলট কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে কথা বলছেন, এটা যদি কেউ জানতে পারে আর তার কাছে যদি ভিএইচএফ রেডিও যন্ত্রপাতি থাকে, তাহলে এই কথোপকথন শোনা এবং রেকর্ড করা সম্ভব।
ইউএস-বাংলার কাঠমান্ডু ফ্লাইট বন্ধ: কাঠমান্ডুতে আপাতত ফ্লাইট না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। বিমান সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যস্থাপক (জিএম) কামরুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা-কাঠমান্ডু-ঢাকা রুটে আমাদের ফ্লাইট পরিচালনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউএস-বাংলার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বহরে চারটি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এবং চারটি বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে। একটি বিধ্বস্ত হওয়ায় এখন তাদের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা সাতটি। কাঠমান্ডু ফ্লাইট আপাতত বন্ধ রাখলেও অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটগুলো স্বাভাবিকভাবেই চলছে বলে জানান কামরুল।
No comments