তাহাজ্জুদ সালাতের ফজিলত by সাইয়্যেদা সুরাইয়া
আল্লাহ
সুবহানাহু-তায়ালা সূরা মুযযাম্মিলে রাসূলুল্লাহ সা:-কে উদ্দেশ্য করে
বলেছেন, ‘নিশ্চই রাতের এবাদত প্রবৃত্তি দলনে এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল’
(সূরা মুযযাম্মিল: ২) নাশিয়াতাল লাইল-সম্পর্কে আয়েশা রা: বলেন, ‘এর অর্থ
রাতের নিদ্রার পরে নামাজের জন্য গাত্রোথান করা।’ নবুওতের প্রাথমিক সময়ে
রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবা রা:-দের ওপর তাহাজ্জুদ সালাত ফরজ ছিল। নফল
ছিল না। তাহাজ্জুদের সালাত সম্পর্কে হারিস ইবনে হিশাম রা:-আয়েশা রা:-কে নবী
সা:-এর তাহাজ্জুদ সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আয়েশা রা: বলেন, ‘তুমি কি
সূরা মুযযাম্মিল পড়নি?’ হারিস ইবনে হিশাম রা: ‘হ্যাঁ পড়েছি।’ আয়েশা রা:
বলেন, ‘তাহলে শোন নবুওয়তের প্রাথমিক সময়ে নবী সা: এবং তাঁর সাহাবা রা:-গণ
তাহাজ্জুদের সালাত ফরজ হিসেবে আদায় করতেন। এমন কি তাদের পা পর্যন্ত ফুলে
যেত। বারো মাস পরে এ সূরার শেষের আয়াতগুলো নাজিল হয় এবং মহান আল্লাহ ভার
লাগব করে দেন। তাহাজ্জুদ সালাতকে তিনি ফরজ হিসেবে না রেখে নফল হিসেবে রেখে
দেন।’ (মুসনাদে আহমদ : সূত্র-তাফসিরে ইবন কাসির) রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবা
রা:-দের পা ফুলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে আল্লাহ সুবানাহু-তায়ালা সূরা
মুযযাম্মিলের প্রথমে নবী সা:-কে বলেন, ‘রাত্রিতে (নামাজের জন্য) দণ্ডায়মান
হও রাতের কিছু অংশ বাদ দিয়ে অর্ধ-রাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম। অথবা তার
চেয়ে কিছু বাড়িয়ে নাও।’ রাতের এই সালাতে দীর্ঘক্ষণ কিয়াম করার কারণে
(দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা) রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিদের পা ফুলে যেত।
মিরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পরে তাহাজ্জুদ সালাত ফরজ রহিত
হয়ে নফল হিসেবে থেকে যায়। আর এ জন্যই আয়েশা রা: বলেছেন, মহান আল্লাহ তায়ালা
ভার লাগব করে তাহাজ্জুদ সালাতকে ফরজ রহিত করেন এবং নফল হিসেবে তা রেখে
দেন। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এমন অনেকে আছেন যারা
তাহাজ্জুদ সালাতকে নবী সা:-এর জন্য আজীবন ফরজ সালাত বলে মনে করেন এবং এই
উম্মতের জন্য তাহাজ্জুদ সালাতকে নফল নামাজ মনে করেন। যে সালাতের দ্বারা
মুমিনের ফরজ এবাদতের ঘাটতি পূরণ করা হবে। নবী সা:-এর জন্য তাহাজ্জুদ সালাত
ফরজ না নফল ছিল তার উত্তর খোদ কুরআন কারিমেই রয়েছে। এ সম্পর্কে, আল্লাহ
সুবহানু-তায়ালার বাণী, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম কর, এটা তোমার
জন্য নফল (অতিরিক্ত) আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন
প্রশংসিত স্থানে’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯) নফল অর্থ অতিরিক্ত। অতিরিক্ত
ইবাদত দ্বারা নবী সা:-এর উম্মতের এবাদতের ঘাটতি পূরণ হতে পারে। কিন্তু নবী
করিম সা:-এর তো এবাদতের কোনো ঘাটতি ছিল না। তাহলে এই অতিরিক্ত পন্থার
মাধ্যমে রাসূল সা:-এর কোনো এবাদতের ঘাটতি পূরণ করা হবে? আর এই অতিরিক্ত
সালাত কেমন করে নবী সা: ওপর ফরজ হতে পারে? এমনি ধরনের বিভ্রান্তিমূলক
তথ্যের অপনোদন হওয়া দরকার। আমি নিজেও আগে এই তথ্যে বিশ্বাসী ছিলাম। পবিত্র
কুরআন ও হাদিসের ব্যাপক চর্চা না হলে এমন বিভ্রান্তি আমাদের ভেতর থেকেই
যাবে?
রাতের এবাদত নবী সা: আজীবন আদায় করেছেন আল্লাহ সুবহানু-তায়ালার একজন
শোকর-গুজার বান্দা হিসেবে। রাতের কিয়ামে রাসূলুল্লাহ সা: পা ফুলে যেত,
এমনকি পা ফেটে রস বের হতো। এ দৃশ্য দেখে সাহাবা রা:-গণ প্রশ্ন করতেন, ‘ইয়া
রাসূলুল্লাহ সা: আপনার তো আগের পেছনের কোনো গুনাহ নেই তাহলে আপনি কেন এত
কষ্ট করছেন?’ রাসূলুল্লাহ সা:-এর উত্তর ছিল, ‘আমি কি শোকর গুজার বান্দা হবো
না!!!’ তাফসির সমূহে এ বিষয়ে বর্ণনা এসেছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু-তায়ালা
রাসূলুল্লাহ সা:-কে নবুওতের গুরুভার দায়িত্ব পালন করার মতো যোগ্যতা অর্জনের
উদ্দেশ্যেই এক বছর সময়কাল ধরে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় এবাদত হিসেবে তাহাজ্জুদ
সালাতের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ছিলেন। উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যাওয়ার
পরে ফরজ রহিত হয়ে তাহাজ্জুদ সালাত রাসূল সা:-এর জন্য নফল বা অতিরিক্ত
হিসেবে থেকে যায়। তাহাজ্জুদ সালাতের মাধ্যমে মানবের নফছ বা প্রবৃত্তি
দমন-দলন করা তথা পিষ্ট করা অতিশয় কার্যকর একটি অমোঘ দাওয়াই। তাহাজ্জুদ
সালাতের সময় রাতের নিদ্রার পরের সময়। হজরত আয়েশা রা: ইন্না নাশিয়াতাল লাইল
সম্পর্কে বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে রাতের নিদ্রার পরে গাত্রোথান করা। রাতের
প্রথম প্রহরে মানুষ কর্মব্যস্ততার সময় অতিবাহিত করে, ইশার নামাজসহ
আনুষঙ্গিক আরো বহু ব্যস্ততা রয়েছে কিন্তু রাত দ্বিপ্রহরের পরে রাতের গভীরতা
বৃদ্ধি পায়। এ সময় গাত্রোথান করে ঘুমের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে বান্দা যখন
তার রবের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য রাতের সালাতে দণ্ডায়মান হয়; তখন স্রষ্টার
সাথে সৃষ্টির এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এ সময় সালাত আদায়কারী তার নফছ
বা প্রবৃত্তিকে বশীভূত করার মাধ্যমে তার আরামের বিছানা ত্যাগ করতে সক্ষম
হয়। আর সালাতের প্রাণ হচ্ছে আল কুরআন। রাতের সালাতের পবিত্র কুরআন কারিমের
তেলাওয়াতের সুগভীর মূর্চ্ছনায় মানবাত্মা হয় প্রশান্ত-দিপ্তীময়। এ প্রশান্ত
আত্মাকে এই সালাত নিয়ে যায় এমন একটি রহস্যময় আলোকিত জগতে যে জগতের শ্রুত
এবং দৃশ্যমান তথ্যাবলি পবিত্র আল-কুরআনের ছত্রে ছত্রে বর্ণিত এবং উপস্থাপিত
হয়েছে। উপসংহারে বলা যায় ‘ইন্না নাশিয়াতুল লাইল-নিশ্চই রাতের নামাজ
প্রবৃত্তি দলনে অত্যন্ত কার্যকর।’ আল্লাহর এই বাণীর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক
এর ভাবার্থও বহুল বিস্তৃত। মানব মনে মন্দ কর্মের উসকানি দাতা নফছে আম্মারা
বশীভূত করতে পারলে, মানব সমাজের অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা, গুম-খুন,
অশ্লীলতা আর পাপাচারের উৎস মুখ বন্ধ হতে বাধ্য। এর পরেই মানব প্রবৃত্তি
পরিণত হয় তিরষ্কৃত আত্মা প্রশান্ত আত্মা ও সন্তোষ ভাজনে। তখন লোভ নয়
ত্যাগেই হয় মানব আত্মা মহীয়ান-গরীয়ান।
লেখক : প্রবন্ধকার
লেখক : প্রবন্ধকার
No comments