মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ সরকার by তৈমূর আলম খন্দকার

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ জাতীয় দৈনিকে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে- ‘দেশের সাতটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এর মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তিনটি বেসরকারি ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সাতটি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক সোনালী, রূপালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি সাত হাজার ৬২৬ কোটি কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং বেসরকারি তিনটি ব্যাংক- কমার্স, ফারমার্স আর আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৭৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ কথা জানান। স্বতন্ত্র সদস্য আবদুল মতিনের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ১৪০ কোটি ৪১ লাখ টাকা,
রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ৬৮৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২৭২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দুই হাজার ৫২২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ফারমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৭৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ৪৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০০৫-২০০৬ অর্থবছর থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার ১০ হাজার ২৭২ কোটি টাকার পুনঃমূলধনীকরণ সুবিধা দিয়েছে, যা ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোতে মূলধন হিসাবায়নে যুক্ত হয়েছে। তিনি জানান, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি ছিল সাত হাজার ৫৬৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত প্রভিশন রয়েছে এক হাজার ৭৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সামগ্রিকভাবে মোট ঘাটতি প্রভিশনের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৩৪৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দুই হাজার ৯০০ কোটি ৯১ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ২৪৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, বেসিক ব্যাংকের তিন হাজার ৪২১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১৯৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ৮৬১ কোটি ৬১ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৮৯ কোটি ৯ লাখ টাকা।’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ব্যাংক মূলধন ঘাটতির সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলেও ডিজিটাল চুরির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের কত টাকা পাচার হয়েছে এবং কত টাকা ফেরত এসেছে, সে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বর্ণিত ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রী তার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, তিনি কোনো কারণেই অপরাধী নন। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী (আবুল হোসেন), রেলমন্ত্রী (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ- দেশে এ ধরনের প্রথম ঘটনা। তবে প্রধান বিচারপতির (এস কে সিনহা) পদত্যাগের ভিন্ন কারণ, যার পেছনে সরকারপ্রধানের মান-অভিমান সক্রিয় ছিল বলেই জনগণ মনে করে।
কিন্তু অন্য পদত্যাগে প্রধানমন্ত্রী খুশি হননি, বরং সাফাই দিয়েছেন। তারপরও কেন তাদের পদত্যাগ, তা জাতির নিকট পরিষ্কার হয়নি। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চলে যাওয়ার পেছনে কাদের ব্যর্থতা বা অসাবধানতা বা যোগসাজশ রয়েছে বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না তাও রহস্য হিসেবে রয়ে গেল। হলমার্ক, ডেসটিনি হরিলুট ছাড়াও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে কারা জড়িতÑ এ তথ্যও আজ পর্যন্ত জাতির সামনে প্রকাশ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে কারণ কী? নিশ্চয়ই সরকারি ঘরানার লোকেরা এ কেলেঙ্কারিতে জড়িত, নতুবা শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে জনগণের যে আর্থিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হলো এবং অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, এর পরও কি শুধু দোষী ব্যক্তিদের জনগণ থেকে রক্ষা করার জন্য শেয়ার কেলেঙ্কারির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি? সরকার অনেক রিপোর্টই প্রকাশ করেনি, যেমন প্রকাশিত হয়নি পিলখানার বিডিআর ট্র্যাজেডির কাহিনী, প্রকাশ করা হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার রিপোর্ট, প্রকাশিত হয়নি ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির বিবরণ প্রভৃতি; এসব সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে রয়ে গেল। এদিকে, সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইতঃপূূর্বেও হয়েছে। কিন্তু কোনো দিন গণহারে এমনভাবে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার তথ্য সরকার বা প্রধানমন্ত্রী কি দিতে পারবেন? তিনি বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রী বা সচিব তো প্রশ্নপত্র ফাঁস করেননি। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে?‘ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে’ সরকার সর্ববিষয়ে রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করছে। শত ব্যর্থতার মধ্যেও সরকারের ভাবখানা এমন যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’বহির্ভূত কোনো কাজে সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা দূরের কথা, বর্তমান সরকার এর নামগন্ধও শুনতে চায় না। এই চেতনার দিকে যদি আমরা ফিরে তাকাই, তবে সংবিধানে এ সম্পর্কে যা বলা আছে তার ওপরই নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত নয় কি? সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সরকার সত্যিকার অর্থেই যদি লালন করে তবে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাহায্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার করার মতো বিষয়গুলো সরকার কোথায় নিশ্চিত করছে? যখন তখন ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের মাঠেই নামতে দিচ্ছে না সরকার। সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদে মৌলিক অধিকার তথা রাজনীতি করার অধিকার, অর্থাৎ মিছিল মিটিং, শোভাযাত্রা ইত্যাদি এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কার্যকর হচ্ছে কোথায়? ভাষার অধিকার, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার তথা সম্পদের সুষম বণ্টনের অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতেই বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল।
কিন্তু সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরং ধনীকে আরো ধনী করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংক লুট, বন লুট, পাহাড় লুট, এমনকি গ্রাম এলাকায়ও আবাসন প্রকল্পের নামে ধানী জমি ভূমিদস্যুরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ভূমিদস্যুরা খাল, বিল, নদীনালা ভরাট করে জাল দলিলের মাধ্যমে জনগণের কাছে অগ্রিম বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা মার্কসবাদ, লেনিনবাদ বা পুঁজিবাদ অর্থনীতির রাজনীতি- সবগুলোরই নিজস্ব একটি নিয়মনীতি রয়েছে, কিন্তু লুটেরাদের কোনো নিয়মনীতি বা আদর্শ নেই। তাদের ‘আদর্শ’- যেখানে যে অবস্থায় যা পাবে তা লুট করে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করো। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মতে, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৯ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে এ ঘাটতি কি জনগণের অর্থের ঘাটতি নয়? ব্যাংকিং সেক্টর এখন সরকারি ঘরানায় ধনিক শ্রেণীর হাতে বন্দী। এক ব্যাংকের ডিফল্টার অন্য ব্যাংকের ডাইরেক্টরÑ এমন কাহিনী আমাদের দেশেই রয়েছে। অধিক ইন্টারেস্ট প্রদানের লোভ দেখিয়ে আমানত ও ঋণ প্রদানের বহু ভুঁইফোড় কোম্পানি গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠেছে। তাদের বেশির ভাগই মূলধন অন্যত্র সরিয়ে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এ ধরনের কোম্পানি দ্বারাও আমানতদাররা পুঁজিপাট্টা সব হারিয়েছেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বা যেকোনো ব্যাংক ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়লে আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নে জনগণের আস্থা থাকবে কিভাবে? আর জনগণের সম্পদ রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই থাকবে কোথায়?
লেখক : বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
taimuralamkhandaker@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.